রবিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

দেওবন্দ মাদ্রাসাও সরকারি নিয়ম মেনেই স্বীকৃতি নিয়েছে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

দেওবন্দ মাদ্রাসাও সরকারি নিয়ম মেনেই স্বীকৃতি নিয়েছে

সাম্প্রতিক সময়ে কওমি শিক্ষার্থীদের সনদের স্বীকৃতি একটি আলোচিত ইস্যু। কয়েক মাস ধরেই স্বীকৃতির বিষয়ে সম্মানিত কওমি মুরব্বিরা সিদ্ধান্তে পৌঁছার চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন। মূলত কওমি আলেমদের চিন্তাগত অনৈক্যের কারণেই স্বীকৃতির বিষয়টি এখন ‘আলোচিত বিষয়ের’ গণ্ডি পেরিয়ে দেশবাসীর কাছে সমালোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ বড় নির্মম বাস্তব। অবস্থা এমন পর্যায় পৌঁছেছে যে, স্বীকৃতির প্রশ্নে খোদ কওমি শিক্ষার্থীরাই এখন মুখ লুকাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে কয়েক দিন পরে আলেম এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের চিন্তা নেতিবাচকের শেষ সীমায় পৌঁছবে।  দেশ-জাতি ও ইসলামের বৃহৎ স্বার্থেই ‘স্বীকৃতির’ প্রশ্নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ‘স্বীকৃতি’ নেওয়া মানে পিছিয়ে পড়া নয় বরং অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া— এ বিষয়টি ভালো করে বুঝতে হবে আধুনিক আলেমদের। কওমি মুরব্বিরা ভাবছেন, সরকারি স্বীকৃতি নিলে বুঝি আলিয়া মাদ্রাসা এবং স্কুল-কলেজের মতো ধর্মীয় শিক্ষায় বিপর্যয় নেমে আসবে। বিষয়টি আসলে তা নয়। এর বাস্তব উদাহরণ হলো, এখনো অসংখ্য আলিয়া মাদ্রাসা আছে যেগুলো যথাযথ পরিবেশেই দ্বীনের সঠিক জ্ঞান চর্চা করছে। আচ্ছা বলুন তো— আমি যদি আমার ধর্মীয় রীতিনীতি ঠিক রাখি কেউ কি আমাকে পরিবর্তন করাতে পারবে? পারবে না। কওমি মুরব্বিদের ভয় হলো— সরকারি স্বীকৃতি নিলে বিভিন্ন ‘কিতাব’ উঠিয়ে দিয়ে অন্য ‘বই’ সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হবে। যদি তাই হয়, তবে সমস্যা কোথায়? বড় বড় স্কুলগুলো যেভাবে সিলেবাসের বাইরেও অনেক বই পড়াচ্ছে কওমি মাদ্রাসাও সেভাবেই পড়াবে। এমনিভাবে সম্ভাব্য ও উদ্ভূত যে কোনো সমস্যারই কৌশলী সমাধান প্রয়োগ করে এগিয়ে নিতে হবে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা। যুগোপযোগী করতে হবে কোরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকে। স্বীকৃতি না থাকার কারণে জাতির মেধাবী শ্রেষ্ঠ সন্তানরা দেশ গড়ার মহান কাজে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। পারছে না মক্কা-মদিনাসহ দেশ এবং দেশের বাইরের খ্যাতনামা বিদ্যাপীঠে উচ্চ ডিগ্রি অর্জনের আবেদন করতেও। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ বারবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে। কওমি পড়ুয়ারা যদি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে দায়িত্ব পালন করতে পারত, তবে কি দেশে এত দুর্নীতি থাকত? এই বিশাল ‘সৎ’ জনগোষ্ঠীকে যদি দেশের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তর করা যায়, তবে তো দেশেরই কল্যাণ হবে। ইসলামেরই সুনাম হবে। মূলত কওমি মাদ্রাসার অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই স্বীকৃতির প্রয়োজন। ‘স্বীকৃতি নেই’ মানে হলো এ প্রতিষ্ঠানের বৈধতা নেই। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীও। তাহলে মাদ্রাসা শিক্ষা কেন পিছিয়ে থাকবে? ইংরেজি শিক্ষা থেকে শুরু করে অনেক কিছুর বিরুদ্ধে অনেকে ফতোয়াবাজি করেছি। কোনো বিষয় বুঝে না আসলেই ‘হারাম! হারাম’ বলা যেন কারও কারও ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। কথাগুলো লিখতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আরও বেশি কষ্ট হয়, যখন আমাদের এই ফতোয়াবাজির কারণে অন্যরা হাসে আর বলে, ‘দ্যাখো! মোল্লারা বলেছিল, এটা হারাম, এখন তারাই আবার এর চর্চা করছে।’ সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন স্বীকৃতির পানি ‘ঘোলা’ হবে এবং আমরাই স্বীকৃতির জন্য ওঠেপড়ে লাগব। তখনো আমাদের দেখে হাসাহাসি করবে জাতি।

স্বীকৃতির বিষয়ে যতটুকু দেখেছি, শুধুমাত্র সম্মানিত মুরব্বি আলেমদের অভ্যন্তরীণ ‘দ্বন্দ্বে’র কারণেই কেউ কিছু বলছে না। মুখে কিছু না বললেও ভিতরে ভিতরে ঠিকই তারা দগ্ধ হচ্ছে। এভাবে বেশি দিন চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। তাহলে মুরব্বিদের নিজেদের সন্তানরাই আর সম্মান করবে না যা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে মাত্র। পরিশেষে বলতে চাই, স্বীকৃতি পেতে হলে সরকারের নিয়ম মেনে কিছু ‘ছাড়’ দিতেই হবে। এতে আহামরি ক্ষতি হওয়ার অবকাশ নেই। মনে রাখতে হবে, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষকতা করতে হলেও একটা বিধি ব্যবস্থায় না গেলে সম্ভব নয়। সবার মনে রাখা উচিত সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা যায়; কিন্তু মানুষ নিজের অজান্তেই যুগজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়ায়। সংস্কার মানে যুগ জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রস্তুত করা। মানুষ ধীরে ধীরে পাল্টে যায়; কিন্তু সত্য-মিথ্যা ও হক বাতিলে সংজ্ঞা পাল্টায় না। মৌলিক বিশ্বাস পাল্টায় না। কওমি শিক্ষাধারায় কতটা সংস্কারের ছোঁয়া লাগালে মৌলিকত্ব ক্ষুণ্ন হবে না, সেটাও নিশ্চিত করার দায়দায়িত্ব ওলামা নেতৃত্বকেই নিতে হবে। অন্যদিকে যেহেতু আলেম সমাজ দেওবন্দ ধারার অনুসরণ করতে আগ্রহী, তাই ভারত ও উত্তর প্রদেশের রাজ্য সরকারের নীতি অনুসরণ এ ক্ষেত্রে একটা পথ হতে পারে। দেশের গ্রহণযোগ্য আলেমদের নিয়ে গঠিত একটি কমিটির ওপর এ ব্যাপারে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া যায়।

অন্যদিকে আর একটি বিষয় আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আলেম সমাজ অদৃশ্য কিন্তু প্রভাবক সেই সামাজিক শক্তি গণশিক্ষায় ব্যাপক অবদান রাখছেন নীতিনৈতিকতার চাষ করছেন। ধর্মীয় শিক্ষার একটি মৌলিক ধারা সরব ও সজীব রেখেছেন তারা। এখানে আঘাত করলে যে সামাজিক অস্থিরতা ও অবক্ষয় দেখা দেবে তার প্রভাব পড়বে রাজনীতিতেও। এর কোনো ইতিবাচক সুফল নেই। পরিশেষে আমার প্রাণপ্রিয় সম্মানিত কওমি মুরব্বিদের বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই দেওবন্দ মাদ্রাসাও তো সরকারি নিয়ম মেনেই স্বীকৃতি নিয়েছে। কই তাদের তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না।  স্বীকৃতি না থাকার কারণে যে ক্ষতি এখন হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে হবে তা নিয়েই সবাইকে ভাবতে হবে।  সব দ্বিধা ভেঙে আলোর মুখ দেখুক কওমি শিক্ষার্থী এবং তাদের প্রিয় ‘সনদ’— এ প্রার্থনা করছি মহান প্রভুর দরবারে।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর