সোমবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিশ্বের ২০ সমৃদ্ধ দেশের একটি হবে বাংলাদেশ

আ হ ম মুস্তফা কামাল

বিশ্বের ২০ সমৃদ্ধ দেশের একটি হবে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ আজ বিশ্বে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকার যতবারই ক্ষমতায় এসেছে, ততবারই বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার সুরক্ষা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে  দৃশ্যমান  উন্নয়ন অর্জনে সক্ষম হয়েছে। গত সাত বছরে সারা বিশ্বে গড়ে জিডিপিতে ৬ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে মাত্র ১৭টি দেশ। তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বর্তমানে জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে উন্নীত হয়েছে। বর্তমান সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের সময় জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালিত হয়েছিল ৩ হাজার ২৬০ মেগাওয়াট। সে সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। আজকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। দেশের ৭৮ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের হয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন গোলাম রাব্বানী

 

 

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বিগত বছরগুলোতে অর্থনীতির ক্ষেত্রে আপনাদের সফলতার বিশেষ বিশেষ এলাকাসমূহ সম্পর্কে যদি আমাদের একটু ধারণা দেন?

মুস্তফা কামাল : আওয়ামী লীগ সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকার যতবারই ক্ষমতায় এসেছে, ততবারই বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার সুরক্ষা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান উন্নয়ন অর্জনে সক্ষম হয়েছে। বর্তমান সরকার দক্ষতার সঙ্গে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে যে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে তা দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এখন দৃশ্যমান। গত সাত বছরে সারা বিশ্বে গড়ে জিডিপিতে ছয় শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে মাত্র ১৭টি দেশ। তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সারা বিশ্বে ২০০৮ সালের সৃষ্ট অর্থনৈতিক মহামন্দা মোকাবিলা করে আমাদের এই অর্জন সারা বিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছে। এখানে উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আমাদের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি কখনো ৫ ভাগের ওপরে যায়নি। এখন শুধু ৬ ভাগ নয়, ৬-এর বৃত্ত ভেঙে গত অর্থবছর (২০১৫-১৬) জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে উন্নীত হয়েছে, যা ছিল ৭.১ ভাগ। চলতি বছর আমাদের জিডিপিতে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৭.২ ভাগ। পরবর্তী বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা গড়ে ৭.৪ ভাগ। ২০২০ সালে আমাদের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষ বছরে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে শতকরা ৮ ভাগ। এরপর ২০৩০ পর্যন্ত জিডিপিতে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ৮.৫ ভাগ হারে অর্জন করবে বলে আমরা আশা করছি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ২০০৯-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে আপনাদের সরকার যে রূপকল্প-২০২১, যাকে আপনারা বলে থাকেন দিনবদলের সনদ, সেখানে যে সব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার মাঝে মৌলিক এলাকাগুলোতে আপনাদের সক্ষমতা সম্পর্কে আমরা জানতে চাই।

মুস্তফা কামাল : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন সারা বিশ্ব ছিল অর্থনৈতিকভাবে মহামন্দায় আক্রান্ত। আমাদের দেশের অর্থনীতিও ছিল মন্দাকবলিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই সুচিন্তিত অর্থনৈতিক কৌশল অবলম্বন করে। এ ধারাবাহিকতায় প্রণীত হয় একটি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ও ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। এ দুটি পরিকল্পনার হাত ধরে এগোতে থাকে বাংলাদেশ।

জাতির প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ সুষ্ঠু মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতি অনুসরণ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে ও টাকার মুদ্রামান স্থিতিশীল রেখে দেশের জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে সরকার সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। প্রথমে যে লক্ষ্যটি সরকারের সামনে চলে আসে সেটি হচ্ছে দারিদ্র্যসীমাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। আমরা পৃথিবীর সব দেশের আগে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হয়েছি। যার জন্য আমরা সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছি।

দিনবদলের সনদে আমরা যা যা বলেছিলাম এবং এর বিপরীতে আমরা যা যা অর্জন করেছি তা একটি বিরাট ক্যানভাস। আমি জানি সে বিষয়টি ব্যাখ্যার সুযোগ এখানে নেই। তাই ছোট্ট পরিসরে অর্থনীতির মৌলিক এলাকাগুলোতে আমাদের অগ্রগতি আপনাদের মাধ্যমে জাতির সামনে তুলে ধরতে চাই :

(ক) ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য প্রাইমারি শিক্ষা নিশ্চিত করা, শতভাগ ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠানো- এ লক্ষ্যটি ইতিমধ্যে দারুণভাবে সফল হয়েছে। এখন আমাদের শতকরা ৯৯ জন ছেলেমেয়ে নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে।

(খ) সনদে বলা হয়েছিল ২০২১ সালের মধ্যে প্রত্যেক ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হবে। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের সময় জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালিত হয়েছিল ৩ হাজার ২৬০ মেগাওয়াট। সে সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। আজকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। জাতীয় গ্রিডে এখন ৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালিত হয়। এখন দেশের ৭৮ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। ইনশাল্লাহ ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত হবে।

(গ) সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার, যা আজ বাস্তবে রূপান্তরিত হয়েছে। আজ দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল তথ্য সেবাকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। সবাই ঘরে বসে আউট সোর্সিংয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পাচ্ছে। এ তথ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে গ্রামীণ জনপদের মানুষ খুব সহজেই সরকারি ফরম, ই-জিপি পাসপোর্ট-ভিসা সংক্রান্ত তথ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইন, চাকরির খবর, নাগরিকত্ব সনদ, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলসহ অন্যান্য সরকারি সেবা পাচ্ছেন। বর্তমানে মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি ২৬ লাখ, যা ২০০৮-০৯ সালে ছিল ৫ কোটি ২৪ লাখ। বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটি ৩৪ লাখ। বছরভিত্তিক টেলিঘনত্ব ২০০৯ সালে ছিল ৩১.৯৫%, যা বর্তমানে প্রায় ৭৯.৩০%।

(ঘ) দেশে দারিদ্র্যসীমা কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ছিল সেই রূপকল্পে। আপনারা এর মধ্যে অবগত হয়েছেন যে, ২০০৫ সালে যেখানে হতদরিদ্রের সংখ্যা ছিল ২৫ ভাগ সেখানে বর্তমানে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে আজ তা ১২.৯ ভাগ। এখানে উল্লেখ্য, সারা বিশ্বে দারিদ্র্যসীমাও ১২ ভাগের কাছাকাছি। সেই নিরিখে আমরা বিশ্বের সঙ্গে সমান্তরাল অবস্থানে অবস্থান করছি।

(ঙ) রূপকল্প ২০২১-এ বলা হয়েছিল, ২০২১ সালে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা হবে। এরই মাঝে আপনারা জেনেছেন যে, ২০১৫ সালের জুলাই মাসের আগে পৃথিবীর অর্থনীতির মাপকাঠিতে বাংলাদেশ ছিল এবটি হতদরিদ্র দেশ। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনাদের সরকারের সময় আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সফলতা এবং এসবের অর্জনের পেছনে মূল ভূমিকা কাদের ছিল বলে আপনি মনে করেন?

মুস্তফা কামাল : ধারাবাহিকভাবে গত সাত বছর আমাদের উন্নয়ন সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। আমি মনে করি এই অর্জনের পেছনে মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে এদেশের মানুষ : এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, পোশাককর্মী, শিক্ষক, সুশীল সমাজ, প্রচার মাধ্যম এবং আমাদের বেসরকারি খাত। সবার সক্রিয় অংশগ্রহণে এটি অর্জিত হয়েছে। এ অর্জন গর্ব করার মতো। কয়েকটি তথ্য উপস্থাপন করলে এ বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে :

* সাত বছর আগে বর্তমান সরকারের যাত্রা শুরুর সময় মূল্যস্ফীতি ছিল শতকরা ৯ ভাগের মতো। এখন যা সাড়ে ৫ ভাগের কাছাকাছি।

* বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে ১ হাজার ৪৬৬ ডলারে দাঁড়িয়েছে যা ২০০৬-০৭ সালে ছিল ৫৯৮ ডলার।

* বর্তমান সরকার রপ্তানি বাণিজ্য শুরু করেছিল ১৪ বিলিয়ন ডলার দিয়ে। গত বছর রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৪ বিলিয়ন ডলার যা আড়াই গুণের মতো।

* ২০০৯ সালে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এর আকার দাঁড়ায় ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা।

* গত সাত বছরে আমাদের রাজস্ব খাতে প্রবৃদ্ধি শতকরা ১৫ ভাগের মতো।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে বার্ষিক রাজস্ব আয় ছিল ৬৯ হাজার কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

* আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ছিল ৫.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, বর্তমানে তা ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওপর।

* সাত বছর আগে প্রবাসী আয় ছিল ৮ বিলিয়ন ডলারের মতো। এখন যা ১৫ বিলিয়ন ডলার।

* গত সাত বছরে আমাদের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট সব বছরেই ছিল Positive Trajectory তে।

* টাকার মান ছিল স্থিতিশীল।

* ২০১৫-এর তুলনায় ২০১৬-তে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৪৪ ভাগ।

* ২০০৬ সালে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল ছিল ৬৬.৫ বছর যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৭০.৯ বছর।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যের পেছনে অন্তর্নিহিত শক্তিগুলো কী বলে আপনি মনে করেন?

মুস্তফা কামাল : দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। সম্পদ পরিস্থিতির সীমাবদ্ধতায় দরিদ্র মোকাবিলা সব সময় সরকারের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ।

* দারিদ্র্য বিমোচন বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য একটি অগ্রগতি। এর পেছনে সরকারের উচ্চমাত্রায় ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, বেসরকারি পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগ এবং একই সঙ্গে সামাজিক উদ্যোগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

* বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম সফলতার পেছনে যে মূল শক্তিটি নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে সেটি হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তা, দেশের মানুষের প্রতি মমত্ববোধ এবং একজন সুদক্ষ রাজনীতিবিদ হিসেবে তার ভূমিকা। বাংলাদেশে সরকারের গৃহীত প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনায় গণমানুষকে সম্পৃক্ত করে কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পরিকল্পনার লক্ষ্য যেমন ছিল মানুষকে উন্নত জীবনের সুযোগ করে দেওয়া তেমনিভাবে প্রতিটি লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মানুষকেই অন্তর্ভুক্ত করে কার্যক্রম চালানো হয়েছে। এতে করে প্রতিটি কর্মসূচির সঙ্গে দেশের মানুষ স্ব-উদ্যোগেই একাত্মতা প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : চীনের প্রেসিডেন্ট এবং বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সাম্প্র্রতিক সফরকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

মুস্তফা কামাল : চীন এবং বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সফর দুটি হচ্ছে বর্তমান সরকারের সফল অর্থনৈতিক কূটনীতির বহিঃপ্রকাশ। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত। বিগত সাত বছরে গড়ে ৬ ভাগের ওপর স্থিতিশীল জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী সতেরটি দেশের অন্যতম দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। দারিদ্র্য নিরসন ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বব্যাপী প্রশংসা লাভ করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে শুরু করে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশকে সাধুবাদ জানিয়েছে। গত সাত বছরে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসব বিষয়ে দেশের সাফল্যে আটবার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন। তাই সঙ্গত কারণেই আমাদের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা, অবকাঠামো খাতসহ অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে অসাধারণ সফলতার কারণে বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশীদার হতে এখন অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করছেন। চীন তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের উন্নয়নে তাদের হাত প্রসারিত করেছে। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক এখন বেশ জোরালো এবং বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণও অনেক।

বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে : পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে একটা ভুল বোঝাবুঝি থেকে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। যা বিশ্বব্যাংক পরবর্তীতে বুঝতে পারে এবং এ বিষয়ে ইতিমধ্যে তারা অনেকবার দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আমি বিশ্বাস করি বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশে এই সফরের মধ্যদিয়ে পদ্মা সেতু সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির বিষয়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে গেল। জাতির সামনে আজ বিষয়টি পরিষ্কার যে, পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কখনো কোনো সদিচ্ছার অভাব ছিল না অথবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো ধরনের অস্বচ্ছতা ছিল না।

বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক ২৩.৯৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ উন্নয়ন সহায়তা প্রদান করেছে। এবারও বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট তার বাংলাদেশ সফরকালে এটুকু আশ্বস্ত করেছেন যে, তারা বাংলাদেশের উন্নয়নে সত্যিকারভাবে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

এখানে একটি বিষয়ে বলা দরকার এবার বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে আসার আগে মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বকে জানালেন যে, ‘আমি বাংলাদেশে একটি বিস্ময়ের বিস্ময় আবিষ্কার করতে যাচ্ছি’। তিনি এলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করলেন এবং যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘বাংলাদেশের অগ্রগতি সারা বিশ্বের জন্য অনুকরণীয়’। বাংলাদেশকে অনুসরণ করে অন্যদেরও তাদের অর্থনীতি ঢেলে সাজাতে বলেছেন। বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘আমরাও তাদের এই সাফল্যগাথা অনুসরণে কাজ করব।’

বাংলাদেশ প্রতিদিন : চীনের উন্নয়ন সহায়তাকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে কি না?

মুস্তফা কামাল : চীনের উন্নয়ন সহায়তার দুটি ভাগ রয়েছে। একদিকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য সহায়তা অন্যদিকে বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে সহায়তা। এ দুটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ তাদের সক্ষমতার পরিচয় ইতিমধ্যে রেখেছে।

বর্তমান সরকারের আমলে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোগত উন্নয়নে অপ্রতিরোধ্য গতি এসেছে। ২০০৯ সালে যেখানে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। ২০১৫-১৬-তে এর আকার দাঁড়ায় ৯১ হাজার কোটি টাকা আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আলোচ্য এডিপির আকার নির্ধারিত হয়েছে। ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর উন্নয়ন বাজেটে সরকারের বরাদ্দ বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি এডিপি বাস্তবায়ন হারও আশানুরূপভাবে বাড়ছে। ২০০৯-১০ এর আগে যেখানে এ হার কখনো ৮০ ভাগ বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি, এখন সেটি কোনো বছরেই ৯০ ভাগের নিচে নামছে না। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়নের হার ছিল প্রায় ৯৩%।

তাই উন্নয়ন সহায়তার আলোকে প্রকল্প ও কার্যক্রম বাস্তবায়নের সক্ষমতা পুরোপুরি আমাদের রয়েছে। পাশাপাশি ব্যবসা ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বর্তমান সরকার সাত বছর আগে যখন যাত্রা শুরু করে তখন আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৪ বিলিয়ন ডলার। গত বছর রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৪ বিলিয়ন ডলার যা শুরুর বছরের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। আমরা যে গতিতে এগোচ্ছি তাতে ২০২১ সালে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য ৫০-৫৫ বিলিয়ন ডলারের কম হবে না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে অন্যতম প্রধান নিয়ামক হচ্ছে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ। যা দীর্ঘদিন ধরে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেই। এক্ষেত্রে আপনাদের সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?

মুস্তফা কামাল : দেশের ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে প্রয়োজনীয় নীতিগত সহায়তা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার ফলশ্রুতিতে উৎপাদনশীলতা ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। সার্বিক জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে শিল্পের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা প্রদান, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে অধিক গুরুত্ব দেওয়া এবং শিল্প খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দক্ষতা উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে; বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা সরকার গ্রহণ করেছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়িত হলে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি ১ কোটি লোকের কর্মসংস্থান হবে।

আরও একটি বিষয় এখানে বলা যায়, অর্থনীতিতে উচ্চতর প্রবৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ অবশ্যই প্রয়োজন। পাশাপাশি মাথাপিছু উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিও প্রয়োজন। সরকার এ লক্ষ্যে মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক/কারগরি শিক্ষা, বিষয়ভিত্তিক গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। সাত বছর আগে যেখানে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার ছিল মাত্র ১ ভাগের মতো এখন তা ১০ ভাগে উন্নীত হয়েছে। ২০২১ সালে এটা শতকরা ২০ ভাগে উন্নীত হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আগামী দিনগুলোতে দেশের উন্নয়নে আপনাদের সরকারের লক্ষ্য কী?

মুস্তফা কামাল : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব সময় আমাদের জন্য, আগামীর জন্য Objective and number based উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেন। এর আগে আমরা ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিলাম। এখন আমাদের সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে ২০৩০ এর মাঝে বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক দেশে রূপান্তরিত করা এবং ২০৩০ এর মাঝে দেশকে পূর্ণমাত্রায় দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত করা যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার একটি অংশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্য এরই মাঝে ২০৪১ সালের অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রাও ঠিক করে দিয়েছেন। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের উন্নত দেশের একটি দেশ। একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ।

আপনারা জানেন প্রতিবছর বিশ্বব্যাংক জিডিপির ভিত্তিতে বিশ্বের ৫০টি দেশের একটি অবস্থান নির্ধারণ করে থাকে। Purchasing Power Parity (PPP) ভিত্তিতে বিশ্বে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩তম এবং জিডিপির আকার হচ্ছে ৬৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ধারাবাহিকতায় ২০৩০ সালে পৃথিবীর অর্থনীতির আঙিনায় বাংলাদেশের অবস্থান হবে ২৫তম এবং আমাদের জিডিপির আকার হবে ১.৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০৪১ সালে আমাদের জিডিপির আকার হবে ২.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং বাংলাদেশ সেসময় বিশ্বের সমৃদ্ধিশালী ২০টি দেশের একটি দেশ, ইনশাল্লাহ।

সর্বশেষ খবর