শিরোনাম
সোমবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

অর্থবহ নির্বাচনের স্বার্থে করণীয়

অ্যাডভোকেট মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন

অর্থবহ নির্বাচনের স্বার্থে করণীয়

ইদানীং সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বক্তব্য রেখেছেন। একজন অভিজ্ঞ ও মার্জিত রাজনীতিবিদ ব্যক্তি হিসেবে তার বক্তব্য সঙ্গত কারণেই গুরুত্ব বহন করে। তিনি সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন ‘সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য’।  এ ব্যাপারে তিনি নির্বাচন কমিশনকে বুঝিয়েছেন। আমাদের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত আইনের বিধানবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন।’ এ বিধানটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, সংসদে আইন প্রণয়নের মধ্যদিয়েই নির্বাচন কমিশনারদের যোগ্যতা যাচাইয়ের বিধান রেখেই নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আসলে কি সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের বাধ্যবাধকতায় ওই ধরনের কোনো আইন সংসদে পাস হয়েছে। না হয়ে থাকলে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দান কতটুকু সমর্থনযোগ্য, আইনগত সঠিক ও নৈতিকতার ভিত্তিতে। ইদানীং অনেকেই সার্চ কমিটির কথা বলেছেন। আসলে সার্চ কমিটি গঠনের কোনো বিধানই সংবিধানে নেই। এই ব্যাপারে সংবিধান অনুযায়ী আইন তৈরি না করে, সার্চ কমিটি গঠন সংবিধান পরিপন্থী। আর যদি করা হয় সেটা হবে আর একটি ঠুঁটো জগন্নাথ মার্কা নির্বাচন কমিশন যা জনগণ প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার কথা লিখে সময় নষ্ট না করে শুধু বলব এই নির্বাচন কমিশনের একজন ‘নির্বাচন কর্মকর্তাকে বাঁশখালীর একজন সংসদ সদস্য শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে গুরুতর আহত করেছেন। সারা জাতি সেটা প্রত্যক্ষ করেছে আর নির্বাচন কমিশন দায়সারাগোছের একটা মামলা করেই তার দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে। সেই সংসদ সদস্যের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেনি। এই ঘটনা প্রমাণ করে নির্বাচন কমিশন একটা হাস্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এ ব্যাপারে একটি স্থায়ী শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়েই একটি অর্থবহ নির্বাচন আশা করা যায়। গতবারের সার্চ কমিটিতে যে চারজন সদস্য রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়েছেন, তন্মধ্যে চেয়ারম্যান পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অব বাংলাদেশ বলতে গেলে তারাই সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত যাদের মতামত কতটুকু গুরুত্ব বহন করে জানি না। পাশাপাশি শ্রীলঙ্কায় নয় সদস্যের নির্বাচন কমিশন তন্মধ্যে তিনজন বিচার বিভাগ থেকে, তিনজন প্রশাসনিক বিভাগ ও তিনজন আইন বিভাগ থেকে গঠন করা হয়। অন্যদিকে বিশ্বের অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে তিন সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন, যাদের থেকে প্রতি বছর একজন বিদায় নেন। অন্য আর একজন তদস্থলে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি সেখানে ঝুসনড়ষ অব ন্যাশনাল ইন্টিগ্রিটি যার ফলে পৃথিবীতে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন একটি শক্তিশালী নিরপেক্ষ ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন হিসেবে নিজের সুনাম ও খ্যাতির অধিকারী। অন্যদিকে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনও একটি স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত, স্থায়ী এবং সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত যা পাকিস্তান সংবিধানের ২১৩, ২১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী চার প্রদেশের চারজন হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন এবং প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতা প্রত্যেকে তিনজন করে নাম প্রস্তাব করেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য এবং প্রত্যেকেই একজন করে সদস্যের নাম পাঠান যা কিনা সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা করেই এক একজন কমিশনারের নিয়োগ দান চূড়ান্ত করেন। অথচ আমাদের দেশে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সংবিধান পরিপন্থী তথাকথিত সার্চ কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে দলীয় আনুগত্যশীল লোকজনের মধ্য থেকে গঠন করা হয়েছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন। বর্তমানে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে কাজ করার প্রথম অন্তরায় হচ্ছে পঞ্চদশ সংশোধনী যা কিনা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করাটা সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে, যে সংশোধনী শুধু জনগণের ভোটের অধিকার সুপরিকল্পিতভাবে কেড়ে নেয়নি, বরঞ্চ পঞ্চদশ সংশোধনীর ৫৩টি অনুচ্ছেদ চিরকালের জন্য সংশোধন অযোগ্য করেছে। যার ফলে এই সংশোধনীর কোনো সর্বজনীনতা নেই। সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদ না ভেঙে নির্বাচন হয় না, আর সেখানে পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদ বহাল রেখেই সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা রেখেছে যা কিনা সংসদ নির্বাচনকে একটি প্রশ্নবিদ্ধ প্রহসনের নির্বাচনে পরিণত করেছে। একটি অর্থবহ, সবার অংশগ্রহণ সংবলিত নির্বাচনই জাতির এই সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ। সে জন্য দরকার জনগণের আস্থাশীল একটি নির্বাচন কমিশন। যার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়ে কমিশন গঠন করা হলে জনগণের আস্থা তৈরি হবে, তবে জনগণের আস্থা থাকলেও সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। জনগণের আস্থাহীন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। শুধু জনগণের গণতন্ত্রের ট্রেনে যাত্রী হওয়ার মধ্যে সমাধান নিহিত। বর্তমান সরকার পর পর কয়েকটি নির্বাচন করে প্রমাণ করেছে অসাংবিধানিক স্বৈরাচার থেকে তথাকথিত সাংবিধানিক স্বৈরাচার আরও ভয়ানক। গণতন্ত্রকে পুঁজি করে অনেক স্বৈরশাসক গণতন্ত্রের নামে মৌলিক গণতন্ত্র, Presidential Democracy, Controlled বা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের রূপ দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার নিষ্ফল প্রয়াস চালিয়েছে, কিন্তু ভয়ানক গণবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসকেরা রাজনীতি অঙ্গন থেকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। বর্তমানে উন্নয়নের গণতন্ত্রের নামে যে দৃশ্য বিগত নির্বাচনগুলোতে জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে তাতে আমার বিশ্বাস শুধু সত্যিকারের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখে একটি অর্থবহ নির্বাচনের জন্য সুশীল সমাজ এবং দেশের জনগণের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে সংবিধানের বাধ্যবাধকতা মেনে আইন তৈরি করে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি শক্তিশালী, নিরপেক্ষ ও স্বায়ত্তশাসিত নির্বাচন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়েই সমাধানের পথ বের করতে হবে। আমাদের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতান্ত্রিক দেশ যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চয়তা থাকবে, আর সেই সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে ১৯৯১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বিএনপি সরকার সংসদে ১২তম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে এদেশে পুনরায় গণতান্ত্রিক সংসদীয় পদ্ধতির সরকার চালু করেছিল। এমনকি জনগণ যাতে সাংবিধানিকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে সে জন্য সংবিধানে ১৩তম সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিল। আর তদবিপরীতে বর্তমান সরকার ২০১১ সালের ৩০ জুন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর নবসংস্করণ হিসেবে ১৫তম সংশোধনী এনে গণতন্ত্রের অবাধে চলার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাজনৈতিক সরকারের (ক্ষমতাসীন সরকারের) অধীনে নির্বাচনের বিধান গোটা জাতিকে এক সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে, গণভোটের মতো জনগণের একটি সাংবিধানিক অধিকার বিলুপ্ত করা হয়েছে। গণতন্ত্রের পথ হারিয়ে দেশ আজ এক অনিশ্চয়তার দিকে ধাবমান। এ সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ। সংলাপ আর সেই সংলাপ শুরু করা যেতে পারে এদেশের সংবিধান প্রণেতাগণ, সুশীল সমাজ এবং সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতিবৃন্দ, অবসরপ্রাপ্ত আপিল বিভাগের বিচারকবৃন্দ, প্রবীণ সাংবাদিকবৃন্দ, জাতীয় দৈনিকের প্রথিতযশা সম্পাদকমণ্ডলীদের নিয়ে। আলোচনায় গোলটেবিল বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসবে এর সমাধান, জাতি দেখবে আশার আলো, জনগণ ফিরে পাবে স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার অধিকার আর যোগ হবে উন্নয়নের গণতন্ত্রের বদলে গণতন্ত্র তারপর উন্নয়ন। জাতি মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে প্রত্যাশা করে ভারতের টিএন সেশনের মতো একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার যিনি ভারতের ইতিহাসে নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত ও কলুষমুক্ত করতে অত্যন্ত কঠোর ভূমিকা পালন করেছেন। যিনি ১৯৯০-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ভারতে নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকারের স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করিয়ে গেছেন। টিএন সেশন ছিলেন একজন সচিব।

আমাদের দেশে এরকম অনেক সৎ, নিষ্ঠাবান এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অবসরপ্রাপ্ত সচিব আছেন যারা তাদের চাকরি জীবনে কারও লেজুড়বৃত্তি করেনি। সদিচ্ছা থাকলে সে রকম একজনকে বেছে নিতে কোনো অসুবিধা হবে না। এক বর্বরতম পৈশাচিক গণহত্যার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের জন্ম যার মূলমন্ত্র হচ্ছে গণতন্ত্র, আর আজ সেই গণতন্ত্র লাইফ সাপোর্টে। গণতন্ত্রই হচ্ছে বিশ্বে রাষ্ট্র পরিচালনায় একমাত্র উত্তম ব্যবস্থা। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র থেকে কোনো বিচ্যুতিই তার পরিপূরক নয়। তাই আজকের সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে খুঁজে বের করতে হবে আর একজন বাংলাদেশি টিএন সেশন, যিনি পক্ষপাতহীন অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে উপহার দেবেন। এক ঐতিহাসিক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পথহারা বাংলাদেশ তার সঠিক পথ খুঁজে পাবে।

লেখক : সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী

সর্বশেষ খবর