মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা

স্বপন দাশগুপ্ত

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা

চীন ও ভিয়েতনাম ছাড়া বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যে দেশ সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আমাদের পাশের ভারত ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাদের স্বাধীনতা পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ দেশের মুক্তিকামী জনতা দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেয়। নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা। জয় বাংলা স্লোগান ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের রণধ্বনি। শুধু প্রশিক্ষণ গ্রহণের সময় নয়, পুরো যুদ্ধের সময়ই একজন মুক্তিযোদ্ধা, আরেকজন মুক্তিযোদ্ধার কুশলাদি জানতে চাইতেন এই স্লোগানের মাধ্যমে। কোনো কিছু পাওয়ার আশায় নয়, জীবন বাজি রেখে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের জন্য যুদ্ধ করছেন।

দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধারা চেয়েছিলেন জাতির জনকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি শোষণহীন ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু সাড়ে তিন বছরের মাথায় কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্য নির্মমভাবে হত্যা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের জন্য উদ্যোগ নিলেও সে উদ্যোগ আর বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ফলপ্রসূ হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে, তারাই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাকে ব্যবহার করেছে নিজেদের স্বার্থে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের কথা বলে ওই সরকারগুলো স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন করেছে। ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতার ২৫ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধুর কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার শপথ নেন। জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারই প্রথম দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। না চাইতেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সম্মানী ভাতা ৩০০০ টাকা প্রদানের উদ্যোগ নেন তিনি। এবার এ সম্মানী ভাতা ১০ হাজার টাকায় উন্নীত করেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাই তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ চৌধুরীর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পত্রিকা ‘মুক্তিবার্তা’য় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ছাপা হয়। এরপর ছাপা হয় সবুজ বইয়ে এবং চূড়ান্তভাবে ছাপা হয় লাল বইয়ে। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়। ২০০০ সালে লাল বইয়ে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৫৪ হাজারে। তবে কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধা নানান কারণে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ওই তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি। ওই তালিকা প্রকাশের সময় সংসদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘যারা তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেননি, তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ থাকবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০১ সালে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন না হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের ওই প্রক্রিয়া ভেস্তে যায়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে ব্যবহার করে তাদের পছন্দমাফিক মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করতে থাকে। সর্বশেষ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ১২ হাজারে। ওই সরকারের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকাভুক্তির জন্য কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের নাম নিয়ে প্রতিটি উপজেলায় সব মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতিতে বৈঠক ডেকে প্রত্যেকের মতামতের ভিত্তিতে তালিকা প্রণয়ন করা হয়। কেউ যদি কোনো আবেদনের ব্যাপারে আপত্তি তুলতেন, তখন ওই নাম অন্তর্ভুক্ত না করে আবার যাচাই-বাছাইয়ের জন্য রাখা হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের ওই সভায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত থাকতেন। এই পদ্ধতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম চূড়ান্ত করে কেন্দ্রে পাঠানো হতো। কেন্দ্রীয়ভাবে এই মুক্তিযোদ্ধাদের নাম মুক্তিবার্তায় ছাপা হতো। এরপর কেউ যদি কারও নাম সম্পর্কে আপত্তি জানাতেন তাহলে ওই নাম সংসদের সবুজ বইয়ে ছাপা হতো না। সবুজ বইয়ে ছাপানোর পর কেউ কোনো নামের ব্যাপারে আপত্তি জানালে ওই নাম বাদ দিয়ে লাল বইয়ে ছাপানো হতো।

এই প্রক্রিয়ায় সরকারি প্রশাসনকে (জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার) কখনই ব্যবহার করা হতো না। তবে কারও ব্যাপারে তদন্ত করতে হলে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তা নেওয়া হতো। এভাবেই লাল বইয়ে ছাপিয়ে চূড়ান্ত করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের জন্য সরকারি প্রশাসন ব্যবহার করে। এ কারণে ওই সরকার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও তাদের পছন্দমাফিক কমান্ডারের মাধ্যমে আবেদনকারীদের নাম চূড়ান্ত করে জেলা কমিটির কাছে পাঠায়। জেলা কমিটি ওই নামগুলো কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়। আর এভাবেই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নাম চূড়ান্ত করে গেজেটে প্রকাশ করে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার আবার ক্ষমতায় গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা সমাপ্ত করার উদ্যোগ নেয়। কথা ছিল ওই সরকারের আমলেই তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে তালিকা শেষ করার উদ্যোগ ভেস্তে যায়। ২০১৪ সালে আবার ক্ষমতায় এসে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে সরকারিভাবে বলা হয়, ‘এই তালিকা প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের লাল বইকেই চূড়ান্ত বলে ধরে নেওয়া হবে।’ সম্ভবত এবার লাল বই প্রণয়ন করার পদ্ধতি অনুসরণ করেই মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করা হবে। এভাবে তালিকা প্রণীত হলেই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আর বিভ্রান্তির অবকাশ থাকবে না।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সম্মানী ভাতা, বোনাস প্রদানসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। সরকারি যানবাহনে যাতায়াতের সুবিধা প্রদান, চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা দেওয়া এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন রাজপথের নাম তাদের নামানুসারে করা হয়। সরকারিভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তালিকা চূড়ান্ত করে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত সরকার। এ ছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ভাস্কর্য নির্মাণ করেছে তারা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মতো বাংলাদেশেও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্মানী ভাতা নির্ধারণ, বোনাস প্রদান, প্রতিটি উপজেলায় স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ করে ওই উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের নাম তাতে লিপিবদ্ধ করা, যাতায়াত ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং বাসস্থানসহ মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শেষ করা যেত। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যাদের কোনো বাসস্থান নেই, সেসব মুক্তিযোদ্ধার জন্য সরকারি উদ্যোগে বাসস্থান নির্মাণের উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। এই উদ্যোগ এখনো চলমান। এজন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ওই প্রকল্প অনুযায়ী প্রতিটি উপজেলায় বাসস্থান নির্মাণের কাজ করছে সরকার। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের বিষয় বঙ্গবন্ধুকন্যার ইচ্ছা থাকলেও বর্তমান সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা কারও কারও কারসাজি ও বিরোধিতার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কল্যাণমুখী কোনো কাজই এগোচ্ছে না। দাবি উত্থাপনের আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বোনাস চালু করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও দুটি ঈদ কিংবা পূজায় বোনাস দেওয়ার কথা মুক্তিযোদ্ধাদের। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ, একজন মন্ত্রী ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের এপিএস ছিলেন, পরে এরশাদ সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন, তার অনিচ্ছায় ওই বোনাস নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া হয়নি। একটি প্রবাদ আছে, ‘যার কারণে রামের মা, তাকে তুমি চিনলে না’ এই প্রবাদবাক্যটি ওই মন্ত্রীর স্মরণ করা উচিত। তিনি আজ মন্ত্রী হয়েছেন, কিন্তু পাকিস্তান থাকলে তিনি কী হতেন তা মনে রাখতে হবে তাকে। শুনেছি, বঙ্গবন্ধুকন্যা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মাসিক ২০ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ওই সম্মানী ভাতা নির্ধারণ করা যায়নি। মন্ত্রিসভার অনেকেই নাকি এর বিরোধিতা করেছেন। দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কত হবে? সর্বোচ্চ ২ লাখ থেকে সোয়া ২ লাখ। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন, তাদের সম্মানী ভাতা ও বোনাস দিলে বাজেটে আর কত টাকা লাগত?

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের গত দুটি নির্বাচন নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। ওই দুটি নির্বাচনে মুক্তিযোদ্ধাদের মতামতের প্রতিফলন ঘটতে দেওয়া হয়নি। এবার সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন হওয়া উচিত। যত তাড়াতাড়ি এই নির্বাচন হবে, ততই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মঙ্গল হবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে এ বিষয়টির দিকেও নজর দিতে হবে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা যেমন চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা পোষ্যদের অধিকার নিশ্চিত করেছেন, তেমন মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন ও কল্যাণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সরকারের কারও কারও বিরোধিতার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন ও কল্যাণে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না তিনি। আগামী পাঁচ বছরে অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধারই স্বাভাবিক মৃত্যু হবে। এই সরকার বর্তমান মেয়াদে যদি মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়গুলো সমাধান করে না যায়, তাহলে তারা চিরকালই অবহেলিত থেকে যাবেন।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর