মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা
মতামত

রাজনীতিতে শতভাগ শুদ্ধতা আশা করা কতটা যৌক্তিক!

মোশাররফ হোসেন মুসা

উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় জনৈক প্রবীণ রাজনীতিকের মুখে শোনা একটি কথা বেদবাক্য মনে করে দীর্ঘদিন বন্ধু-বান্ধবের কাছে বিতরণ করেছি, তা হলো— ‘দেশপ্রেমের পরীক্ষায় একশ নম্বরের মধ্যে একশই পেতে হয়। নিরানব্বই পেলেও তাকে পাস মার্ক দেওয়া চলে না।’ পরে বুঝেছি তিনি মতবাদী দর্শন থেকে কথাটি বলেছিলেন। একই দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে কতিপয় রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবী সরকারের কাছে শতভাগ শুদ্ধতার শাসন আশা করে ক্ষোভ-আক্ষেপ ব্যক্ত করে থাকেন। যেহেতু গণতন্ত্রে ভালো-মন্দ, পাপী-তাপী, আস্তিক-নাস্তিকসহ সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে সে কারণে এই শাসনে শতভাগ শুদ্ধতা আশা করা যুক্তিযুক্ত নয়। তা ছাড়া শুদ্ধতার বিষয়টিও আপেক্ষিক।

আবরাহামিক ধর্মসমূহে বলা হয়েছে : ‘অ্যাডামস ও ইভ’ স্বর্গে চরম সুখে বসবাস করেছিলেন। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় নিষিদ্ধ ফল খাওয়ায় সৃষ্টিকর্তা শাস্তিস্বরূপ তাদের মর্ত্যে নিক্ষেপ করেন। অর্থাৎ মর্ত্য হলো পাপের জায়গা। যেহেতু আদম ও হাওয়া পাপ করেছেন সে কারণে তাদের ঔরসে কখনো শতভাগ শুদ্ধ ব্যক্তির জন্ম হতে পারে না। এ দর্শন থেকেই পাপীদের শুদ্ধ করার জন্য প্রেরিত পুরুষ পাঠানোর নিয়ম চালু হয়। হিন্দুধর্মে সে রকম কথা না থাকলেও ‘অবতার’ আগমনের কথা বলা আছে। বৌদ্ধধর্ম ঈশ্বরে বিশ্বাসী নয়। তবে এ ধর্মের অনুসারীরা মনে করেন, ‘পৃথিবী পাপে পূর্ণ, আরেকটি পাপ করা মানে পৃথিবীতে আরেকটি পাপ বৃদ্ধি পাওয়া। সবাই যদি শুদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করে তবেই পৃথিবীটা বাসযোগ্য ও আনন্দময় হবে।’ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে ধর্মকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। দলগুলোতে কতকগুলো নির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয় মৌলবাদী নীতি রয়েছে। যেমন, ইরানে ধর্মীয় মতাদর্শ বিশ্বাসীই কেবল ভোটে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়। আপাতদৃষ্টিতে পার্লামেন্ট আর মজলিসে শূরা দেশ করলেও পর্দার অন্তরালে রয়েছেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী একজন আধ্যাত্মিক ধর্মীয় নেতা (ইমাম)। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী মাওলানা মওদুদির মতাদর্শে বিশ্বাসী। মওদুদির একটি বইয়ের মুখবন্ধে লেখা আছে : ‘একটি মুসলিমপ্রধান দেশে আধা-মুসলিম, আধা ইমান-আকিদাসম্পন্ন লোকের সংখ্যা বেশি থাকে। সে কারণে তাদের ভোটে একজন খাঁটি মুসলিম নির্বাচিত হয়ে কখনো পার্লামেন্টে আসতে পারবে না। সেজন্য বিপ্লবের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে।’ সম্ভবত সে কারণেই জামায়াতে ইসলামীর প্রিয় স্লোগান— ‘সৎ লোকের শাসন চাই’। কমিউনিস্ট পার্টিগুলোতেও একই দর্শন বিদ্যমান। এসব পার্টির সদস্যরাও মনে করেন, ‘একটি দেশে শ্রমিক শ্রেণির চেতনাসম্পন্ন লোকের সংখ্যা খুবই কম থাকে। তাদের ভোটে কখনো একজন সাচ্চা কমিউনিস্ট নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে আসতে পারে না। সেজন্য বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিকরাজ কায়েম করতে হবে।’ মহান দার্শনিক প্লেটো খ্রিস্টপূর্ব আমলেই এসব কথা অন্যভাবে বলে গেছেন। সে কারণে এ-জাতীয় দর্শনকে প্লেটোবাদী দর্শন বলা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান তত্ত্বে যাই-ই লেখা থাকুক না কেন, বাস্তব চিত্র ভিন্ন। যারা ধর্মে বিশ্বাস করেন তারা কিন্তু নিজেদের পাপীই মনে করেন। সেহেতু প্রতি প্রার্থনায় ঈশ্বরের কাছে মার্জনা চাওয়া প্রার্থনার একটি অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। অর্থাৎ তারা নিজেকে যেমন পাপ থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করেন, তেমন পাপীদের (তাদের দৃষ্টিতে) ধর্মের পথে আনার চেষ্টাও করেন। সে কারণে রেনেসাঁপন্থিরা মনে করেন, পাপী-তাপী নিয়েই পৃথিবী। অন্যদিকে প্রগতিপন্থিদের চেষ্টা থাকে কীভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে উন্নত করা যায়। লক্ষ্য করার বিষয়, সামরিক সরকারগুলো ক্ষমতায় আসে সন্ত্রাস-দুর্নীতি বিনাশ করে একটি শুদ্ধ সমাজ গঠনের আশ্বাস দিয়ে (গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটি বড় এনজিও অনির্বাচিত সরকারের সমর্থনে দেশের সর্বস্তরে সুনীতি-শুদ্ধাচার বাস্তবায়নের জন্য একটি কর্মকৌশল তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল)।

কিন্তু জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করে আবারও গণতান্ত্রিক শাসনেই ফিরে যায়। এসব বিষয় জানা থাকার পরও তারা কেন যে গণতান্ত্রিক শাসনকে অনুপযোগী শাসন মনে করছেন তা বোধগম্য নয়। অনেকে মনে করেন, এই মতান্ধতার কারণেই তারা বড় দলগুলোর বিকল্প কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বী কোনোটাই হতে পারছে না। তবে উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ সেটাই যে দেশের শাসকরা নিজস্ব মূল্যবোধগুলো অক্ষুণ্ন রেখে জনগণকে একটু একটু করে উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। বর্তমান সরকারের আমলে উন্নয়ন হচ্ছে দীর্ঘকালের অর্জিত মূল্যবোধগুলো ধ্বংস করে, যা কাম্য নয়। সে কারণে সরকারের কাছে শতভাগ শুদ্ধতা আশা না করে সবার উচিত হবে ক্রমান্বয়ে উন্নতির জন্য একটি উপযুক্ত দিকনির্দেশনা দেওয়া এবং সে লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা।

লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক।

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর