বুধবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

কুকুর শাবকের সাবালকত্বের অন্তরালে!

গোলাম মাওলা রনি

কুকুর শাবকের সাবালকত্বের অন্তরালে!

কুকুর শাবক তার সাবালকত্ব প্রাপ্তির দিন থেকে তিন পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে চতুর্থ পা-টি উঁচু করে শরীরটিকে ডান দিকে হেলিয়ে জলবিয়োগ আরম্ভ করে। কুকুরের এই অভ্যাসটি সাবালকত্ব প্রাপ্তির ক্ষণ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রশ্ন হলো— এই অদ্ভুত অভ্যাসের মাধ্যমে কুকুরের চরিত্র, কর্মক্ষমতা এবং দৃঢ়তার কি এমন বৈশিষ্ট্যের পরিচয় মেলে যা থেকে মানবজাতি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে? বিষয়টি নিঃসন্দেহে জটিল, আনকোরা এবং একই সঙ্গে উৎসাহব্যঞ্জক।

আমরা সবাই জানি যে, কুকুর একটি শিকারি প্রাণী। শুধু শিকারি বললে ভুল হবে— এটি এক অনন্য, আশ্চর্য এবং অতুলনীয় দক্ষ শিকারি প্রাণী। কুকুরের শিকার করার ক্ষমতার সঙ্গে এটির বুদ্ধিমত্তা, অসাধারণ ঘ্রাণশক্তি এবং প্রাণশক্তি, প্রভুভক্তি, কৃতজ্ঞতাবোধ এবং শেখার আগ্রহের কারণে প্রাণীটি মানব সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কুকুরকে পোষ মানিয়ে এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে এমন দুর্ধর্ষ, দুরন্ত এবং অসম্ভব সব কর্ম করানো সম্ভব যা প্রকৃতির অন্য কোনো প্রাণীকে দিয়ে সম্ভব নয়। এদের চরিত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো— এরা প্রকৃতি প্রদত্ত সব অন্তর্নিহিত ক্ষমতা এবং গুণাবলি শরীর-মন ও মস্তিষ্কে ধারণ করেও বিড়াল এবং খরগোশের ন্যায় নিরীহ, অনুগত এবং মানুষের আদরণীয় গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে। অন্যদিকে, এগুলো যদি ক্রোধান্ধ হয়ে পড়ে তবে নেকড়ে, বাঘ এবং সিংহের চেয়েও নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করতে পারে।

কুকুরের আরেকটি উত্তম বৈশিষ্ট্য হলো— এরা চোর-ডাকাত অপরাধী শনাক্ত করতে পারে। এদের দৃষ্টিশক্তি, ঘ্রাণশক্তি এবং স্পর্শশক্তি মানুষের ভালোমন্দ আন্দাজ করতে পারে। মানুষের পদ-পদবি এবং ক্ষমতাও এরা বুঝতে পারে। ভালো মানুষকে সম্মান ও সমীহ করার অন্তর্নিহিত গুণাবলি এবং মন্দ মানুষের প্রতি আক্রমণাত্মক মনোভাব পোষণ এদের সহজাত বৈশিষ্ট্য। ফলে সেই অনাদিকাল থেকে কোনো বেওয়ারিশ বা বন্যকুকুর কোনো দিন রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী বিশিষ্টজন, সর্বজনশ্রদ্ধেয় ধর্মীয় নেতা, সমাজপতি, মান্যগণ্য ব্যক্তিবর্গ, অবোধ শিশু এবং অসহায় নারীকে দংশন করেনি। তবে মন্দ মানুষ কর্তৃক প্রশিক্ষিত পোষা কুকুরের কথা আলাদা— এরা নিজেদের প্রভুর হুকুমে সবকিছু করতে পারে আর এ জন্যই মানুষ্য সমাজ তাদের স্বজাতিকে যদি নির্মমভাবে হেয় করতে চায় তবে পোষা কুকুরের সঙ্গে তুলনার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে।

কুকুরের মন্দ অভ্যাসগুলোর মধ্যে অন্ধ প্রভুভক্তি, অকারণে লেজ নাড়ানো এবং জিহ্বা বের করা ও ক্ষমতার পদলেহন করা অন্যতম। এরা ভালো-মন্দ যাই হোক— কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তির ওপর অযাচিত আক্রমণ চালায় না। এমনকি পাগল হয়ে গেলেও এরা বিশেষ শ্রেণি-পেশার মানুষকে কামড়ায় না। ফলে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া পাগলা কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত জলাতঙ্ক রোগীদের তালিকায় কিছু প্রবল ক্ষমতাধর শ্রেণি-পেশার মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রশিক্ষণ না থাকলে পোষা কুকুর প্রায়ই প্রতিপক্ষের ঘুষ দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে নিজেদের মালিকদের বিপদে ফেলে দেয়। লোভের কারণে নিজেরাও মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

কুকুরের দোষগুণ বর্ণনার জন্য আমরা আর অগ্রসর হব না। শিরোনামটিকে যুক্তিগ্রাহ্য করে ব্যাখ্যা করার জন্য যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকু তথ্যউপাত্ত উল্লেখ করা হলো। এ অবস্থায় আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, কুকুরের শরীর-মন এবং মস্তিষ্কে পরস্পরবিরোধী কিছু ব্যতিক্রমধর্মী দোষগুণ যথা- আক্রমণ করা এবং প্রতিহত করা, শত্রুতা ও বন্ধুত্ব করার ক্ষমতা, উপকার ও ক্ষতি করার ক্ষমতা, অনুগত এবং অবাধ্য হওয়ার প্রবল ক্ষমতা, আনন্দ প্রদান অথবা বিরক্ত করার ক্ষমতা, ভয় প্রদর্শন এবং নিরাপত্তাদানের ক্ষমতা প্রভৃতি প্রবলভাবে বিরাজ করে। এসব কারণে শিকারি এবং সক্ষম কুকুরের শরীর ও মনের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অন্তর্নিহিত প্রকৃতি প্রদত্ত সক্ষমতা রয়েছে। তিন পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ শরীরটাকে কিঞ্চিৎ বাঁকা করে এবং শরীরের পেছনের অংশ বেশি বাঁকা করে এবং মাথাটিকে সোজা রেখে সাবালক কুকুর জলবিয়োগের মাধ্যমে নিজের শরীর, অভ্যাস, ইচ্ছাশক্তি, স্মরণশক্তি ও স্নায়ুর সক্ষমতা এবং সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করার অসাধারণ সক্ষমতা প্রদর্শন করে থাকে।

সাবালক কুকুরের জলবিয়োগের মধ্যে প্রকৃতি তার অপরাপর সৃষ্টির জন্য অনন্য শিক্ষণীয় বিষয় লুকিয়ে রেখেছেন। এ কারণেই মহাজ্ঞানী ইমামে আজম আবু হানিফা (রা.) তার ভক্তের কাছ থেকে কুকুর শাবকের সাবালকত্ব প্রাপ্তির রহস্য সংক্রান্ত প্রশ্ন শুনে বিরক্ত না হয়ে উল্টো প্রশ্নের জবাব খোঁজার জন্য বছরের পর বছর রাস্তায় ঘুরেছেন। পরবর্তীতে জনৈক মুচির কাছ থেকে জবাব লাভের পর নিজের চিন্তাশক্তিকে থামিয়ে দেননি। বিষয়টি নিয়ে সুগভীর চিন্তা এবং গবেষণার কারণে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি অসাধারণ একটি বিষয় জেনেছেন এবং সেই সুবাদে ব্যতিক্রমধর্মী একটি হেকমতের সন্ধান লাভের চেষ্টা করেছেন। ইমামে আজমের এই চিন্তাশীলতার জন্যই তিনি আলেমকুল শিরোমণি হতে পেরেছেন এবং চারিত্রিক উদারতার কল্যাণে মুচিকে শিক্ষক হিসেবে মর্যাদা দিতে পেরেছেন।

আজকের শিরোনামের বিষয়ে আমার উপলব্ধির সঙ্গে কতজন একমত হবেন তা বলতে পারব না। তবে বিষয়টি নিয়ে যদি সম্মানিত পাঠক একটু চিন্তাভাবনা করেন সেক্ষেত্রে লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না। মানুষের চরিত্রে সব সময়ই ভালো-মন্দ উভয় দোষগুণের সমাহার থাকে। শতভাগ ভালো মানুষ যেমন নেই তেমনি শতভাগ খারাপ মানুষের অস্তিত্ব অসম্ভব। যে সব মানুষ নিজের ভালো কর্ম ও মন্দ কর্মের সমন্বয় করতে জানেন— ভালো মন্দকে আলাদা করা বা রাখার সক্ষমতা অর্জন করেন এবং সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মন্দ কর্মকে আড়াল রাখা অথবা মন্দ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখার সক্ষমতা অর্জন করে নিজের শরীর-মন ও মস্তিষ্কের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন— তারাই জমিনে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান এবং নিজেদের আলোয় অন্যকে উদ্ভাসিত করতে পারেন।

কুকুরের জলবিয়োগের ঘটনাটিকে যদি রূপক হিসেবে গ্রহণ করি তবে এ কথা বলা যায় যে, সাবালক কুকুর নিজের তরল বর্জ্য-ত্যাগের সময় তার শরীর-মন ও মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ সবলতা, সতর্কতা এবং সক্ষমতা প্রদর্শন করে। কোনো প্রাণীর তরল বর্জ্য বলতে কেবল জলবিয়োগকে বোঝায় না। শরীরের যাবতীয় তরল ও বায়বীয় বিষয়াদি এবং বস্তুসামগ্রী যখন শরীর-মন ও মস্তিষ্ক ধারণ করতে পারে না— প্রকৃতির প্রয়োজনে অথবা ঘটনা পরম্পরায় কিংবা হঠাৎ উদ্ভূত কোনো পরিস্থিতির কারণে যেগুলো বের হয়ে যায় অথবা বের করে দেওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে তখন সেগুলোকে তরল বর্জ্য বলা হয়ে থাকে। তরলের একাধিক রূপ থাকে। তরলের কঠিন বা বায়বীয় হওয়া যেমন স্বাভাবিক তদ্রূপ তরল বস্তুর হঠাৎ করে ধূমায়িত হওয়ার ঘটনাও বিরল নয়।

মানবের জলবিয়োগ কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝার জন্য হুজুরে পাক (সা.)-এর একটি হাদিস বর্ণনা করা যেতে পারে। তিনি বলেন, বেশিরভাগ মানুষের কবরের আজাবের প্রধান কারণ হবে তাদের অসতর্ক ও অসংযত প্রস্রাব। ইসলামের বিধান মতে, পবিত্রতার জন্য মুমিন মুত্তাকিরা জলবিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাবধানতা এবং সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন। এটি শরীর থেকে নিঃস্বরিত হলে ওজু ফরজ হয়ে পড়ে। এটি শরীরের কোনো অংশে কিংবা পরিধেয় বস্ত্রে লেগে গেলে তা ধৌত না করা পর্যন্ত শরীর এবং পরিধেয় বস্ত্র অপবিত্র থেকে যায়। অন্যদিকে জলবিয়োগের ধরন প্রকৃতির ওপর মানব শিশুর সাবালকত্বের লক্ষণ ফুটে ওঠে কিন্তু প্রকৃতি এক্ষেত্রে তাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাহায্য করে না। সে পরিবার এবং পরিবেশ থেকে বিষয়টি শিখে নেয়। অন্যদিকে, বর্জ্য ত্যাগের সক্ষমতা অর্জনের বিষয়টি মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত চেষ্টা-তদ্বির ও সাফল্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতি এক্ষেত্রে মানুষকে সাহায্য করে মাত্র— অন্য প্রাণীর মতো বাধ্য করে না।

মানুষের বায়বীয় বর্জ্যের মধ্যে যেগুলোর নাম আমরা সচরাচর উল্লেখ করে থাকি তা নিয়ে আলোচনার দরকার আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু সেসব বিষয়কে সাধারণ মানুষ কোনো দিন বর্জ্য হিসেবে মনে করে না, বরং পরম রত্ন হিসেবে ধারণ করে সেসব বিষয়াদি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করে শিরোনামের যথার্থতা প্রমাণের চেষ্টা করব। মানুষের রাগ, ক্রোধ, হিংসা, লোভ, লালসা, কামনা-বাসনা এবং অলীক কল্পনাগুলো এক ধরনের বায়বীয় বর্জ্য। মানুষ যতদিন পর্যন্ত দেহ-মন ও মস্তিষ্কে নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে এসব বর্জ্য নিরাপদে ত্যাগ করতে না পারে ততদিন পর্যন্ত মানুষ হিসেবে তার সাবালকত্ব অর্জিত হয় না। মানুষের বায়বীয় বর্জ্য অর্থাৎ লোভ-লালসা, হিংসা-অহংকার এবং হামবড়া ভাব তাকে সারাটি জীবন কীরূপে নাবালক বানিয়ে রাখে তা হজরত আলী (রা.)-এর একটি অমিয় বাণী পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়। তিনি বলেন, এক হাজারটি উত্তম কর্ম নিয়ে গর্ব করার তুলনায় একটি মন্দ কর্মকে ঘৃণা করতে পারা এক হাজার গুণ উত্তম। ভালো কাজ করা নিয়ে আত্মতুষ্টি, উচ্ছ্বাস প্রকাশ, প্রশংসার আশা-আকাঙ্ক্ষা, গর্ব করা অথবা নিজেকে জাহির করার মাধ্যমে মানুষ কর্মটির সৌন্দর্য এবং পরিণতির অবস্থা এমন করে ফেলে যা আমরা সচরাচর করে থাকি খাবার টেবিলে পরিবেশিত উত্তম ও সুস্বাদু খাবারগুলোর সঙ্গে। মুখের মধ্যে খাবারগুলো ঢুকিয়ে চিবানোর সময় খাদ্যগুলোর অনুভূতির কথা জিজ্ঞাসা করলে ওগুলো যে জবাব দেবে ঠিক একই জবাব পাওয়া যাবে ভালো কাজগুলোর কাছ থেকে যখন কাজের কর্তা নিজ মুখে, নিজ দোহ এবং চোখে ভালো কাজের গর্ব মেখে দশমুখে তা প্রচারের ব্যবস্থা করেন।

ভালো কাজের সৌন্দর্যহানি এবং অন্তর্নিহিত বেদনার চেয়ে সেগুলোর পরিণতি হয় আরও নোংরা এবং বীভৎস। চিবানো খাবার গলধকরণ করার পর বমন করলে অথবা হজমের পর বর্জন করলে যে বীভৎস রূপ ধারণ করে তদ্রূপ ভালো ভালো কাজগুলো কেবল তাদের কর্তাদের নাবালকত্বের কারণে অধিকতর বীভৎস, বিরক্তিকর এবং মৃণার বস্তুতে পরিণত হয়। এ ব্যাপারে হজরত শেখ সাদী (রহ.) বিখ্যাত গুলিস্তান নামক পুস্তকের একটি রুহানি গল্প প্রসঙ্গক্রমে বর্ণনা করা যেতে পারে।

জনৈক আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে গভীর বনের মধ্য দিয়ে দুর্গম একটি পথ পাড়ি দিচ্ছিলেন। রাস্তাটি ছিল প্রচণ্ড সরু যা দিয়ে কোনোমতে একজন লোক যেতে পারে। এটি ছিল পাহাড়ি উপত্যকা। ফলে সেই সরুপথে চলতে গিয়ে কেউ যদি একটু অমনোযোগী হয় অথবা শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারায় তবে মুহূর্তের মধ্যে তাকে কয়েক হাজার ফুট নিচে পড়ে গিয়ে ভবলীলা সাঙ্গ করতে হবে। একে তো বনজঙ্গল, তার ওপর পাহাড়ি সরুপথ। ফলে পদে পদে পা পেছলানো কিংবা মাথাঘুরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কার সঙ্গে ছিল বন্যপ্রাণী এবং সাপের ভয়। আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ এবং তার ভক্ত মুরিদগণ অতি সাবধানে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলেন। সবার সামনে চলা ভক্তটি হঠাৎ ওমা! ওয়াক থু-ওয়াক থু বলে চিৎকার শুরু করলেন। তিনি কয়েক পা পিছিয়ে এসে খুবই সতর্কতার সঙ্গে ইউটার্ন অর্থাৎ উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে থেমে পড়লেন।

সম্মুখের পথিক থেমে যাওয়ার কারণে পুরো কাফেলা দুর্গম গিরি সংকটে থেমে যেতে বাধ্য হলো। সবাই চিৎকার করে জানতে চাইল কী হয়েছে? প্রথম ব্যক্তি বললেন কে যেন একগাছা হেগে পুরো রাস্তা জড়িয়ে রেখে গেছে। যেমনি বীভৎস তেমনি দুর্গন্ধ। ওটার দিকে নজর দেওয়া হলে মাথায় চক্কর দেবে-নাক বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে পা ফসকে গিরিখাদে পড়ে যেতে হবে। অন্যদিকে, ওটার দিকে নজর না দিয়ে অথবা চোখ বন্ধ করে সংকট পাড়ি দেওয়া আরও ঝুঁকির। প্রথম ব্যক্তির বক্তব্য শোনার পর পুরো কাফেলার মধ্যে ভাইরাসের মতো দুর্গন্ধ এবং দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারীর বীভৎস কুিসত রূপের কাল্পিক অভিশাপ ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ল। সবাই মিলে ছি ছি-ওয়াক থু! কী করা যায়—এখন কী হবে ইত্যাদি বলে হায় হায় আরম্ভ করে দিল।

মুরিদগণের অভিযোগ শুনে কাফেলার মধ্যস্থলে থাকা আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ সবাইকে চুপ থাকার নির্দেশ দিলেন। তিনি অতি সতর্কতার সঙ্গে সবাইকে অতিক্রম করে কাফেলার একদম সামনে চলে এলেন। নিজের মাথার পাগড়ি খুলে ময়লাযুক্ত দুর্গন্ধময় স্থানটি ঢেকে দিলেন। তারপর নিজে সে স্থান অতিক্রম করলেন এবং মুরিদগণকে একইভাবে তা অতিক্রম করার নির্দেশ জারি করলেন।

ফলে পুরো কাফেলা সংকটময় স্থানটি অতিক্রম করে অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত এবং নিরাপদ একটি স্থানে উপনীত হলো। এ অবস্থায় আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অঝরে কান্না আরম্ভ করলেন। তার ভক্ত মুরিদানবৃন্দ ভারি আশ্চর্য হয়ে হুজুরের কাছে কান্নার নেপথ্য কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ কান্না থামিয়ে যে কথা বললেন তা মানবজাতির সাবালকত্ব ও নাবালকত্বের এক অনন্য দলিল হিসেবে যুগযুগান্তরে সমাদৃত হয়ে এসেছে। তিনি বললেন—

‘ওহে আমার ভক্ত ও মুরিদান! আমি যখন মনুষ্য মনের ওপর পাগড়ি বিছিয়ে যেগুলোর গন্ধ এবং বীভৎস অবস্থাকে ঢেকে দিচ্ছিলাম তখন সেগুলো কুদরতি শক্তিতে জবানপ্রাপ্ত হয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে— ওহে মানুষ! কী করছ! আগে আমার কথা শোন। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে আমি ছিলাম সবচেয়ে আকর্ষণীয় সৌন্দর্যমণ্ডিত এবং সুঘ্রাণযুক্ত বস্তু। আমাকে পাওয়ার জন্য এবং খাওয়ার জন্য দুনিয়ার তাবৎ মানুষের অস্থির ব্যাকুলতা, লোভ, লালসা, আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনা এবং ক্ষুণ্নিবৃত্তির নিদারুণ ছটফটানি ছিল লক্ষ্য করার মতো। প্রকৃতির সান্নিধ্যে আমার যে অপার রূপলাবণ্য এবং অনুপম সৌন্দর্য ও সুঘ্রাণ ছিল তা মানুষের স্পর্শ পেয়ে এবং মানুষের সান্নিধ্যে এসে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এমনই বিকট, বিশ্রী এবং দুর্গন্ধময় হয়ে পড়েছে যে, মানুষই তা সহ্য করতে পারছে না। সুতরাং হে মানুষ! জবাব দাও— আমার এই সর্বনাশ কে ঘটাল— কেন ঘটাল এবং কীভাবে ঘটাল?’

     লেখক : কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর