বুধবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা
মতামত

আর নয় কৃষি জমির অপচয়

মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি

আর নয় কৃষি জমির অপচয়

বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর দেশ। অথচ, দেশের ফসলি জমির পরিমাণ ক্রমেই কমছে। আবাসিক চাহিদা, শিল্প কল-কারখানা স্থাপন ও রাস্তাঘাট তৈরির কারণে ফসলি জমির ওপর চাপ বাড়ছে। গত এক দশকে প্রতিবছর গড়ে ৬৮ হাজার ৭০০ হেক্টর ফসলি জমি কমেছে। ১৯৭৬ সালে কৃষি জমির পরিমাণ ছিল ৯৭ লাখ ৬১ হাজার ৪৫০ হেক্টর। ২০০০ সাল পর্যন্ত ৩ লাখ ২১ হাজার ৯০৯ হেক্টর কমে দাঁড়ায় ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার ৫৪১ হেক্টরে। কিন্তু পরবর্তী মাত্র ১০ বছরে ২০১০ সাল নাগাদ ৬ লাখ ৮৭ হাজার ৬০৪ হেক্টর কমে মোট কৃষি জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ লাখ ৫১ হাজার ৯৩৭ হেক্টর। ১৯৭৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরে যে পরিমাণ কৃষি জমি কমেছে, পরের ১০ বছরে কমার পরিমাণ পাঁচ গুণ বেশি। ইউএনডিপির (২০০৩) প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতিবছর ১ শতাংশ কৃষি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় তাদের ওয়েব পোর্টালে জানিয়েছে, দেশে মোট আবাদযোগ্য জমি ৮৫০৫২৭৮.১৪ হেক্টর, মোট সেচকৃত জমি ৭১২৪৮৯৫.৪১ হেক্টর, আবাদযোগ্য পতিত জমি ২০৪৩৬৬.১৪ হেক্টর। দেশজুড়ে প্রতিদিন কমছে কৃষি জমি। দেশের মোট দরিদ্রের ৮২ শতাংশ লোক গ্রামে আর ১৮ শতাংশ শহরে বাস করে। এ বৃহত্তম জনগোষ্ঠী কৃষি কাজের ওপর নির্ভর করে জীবন-জীবিকা চালায়। এখন আমাদের বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হয় না দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন হওয়ায় এবং এতে বিদেশ-নির্ভরতা কমছে আর গ্রামীণ কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। দেশে বর্তমানে বিদ্যমান ইটভাটার অধিকাংশই অবৈধ। যেখানে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে কাঠ। যদিও কয়লা পোড়ানোর আইনগত নির্দেশ থাকলেও সুযোগ পেয়ে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। ভাটি মালিকদের সামাজিক অবস্থান এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে এসব অবৈধ ইটভাটা। যা আইনের তোয়াক্কা না করে স্থাপন করা হয়েছে লোকালয়, কৃষি জমি, পাহাড়ের ঢালে এবং বনাঞ্চলের আশপাশে। আবার কোথাও অবৈধভাবে কৃষি জমি এবং লোকালয়ে স্থাপন করা হয়েছে ইটভাটা। জমির উপরিভাগের ১০ থেকে ১৫ ইঞ্চির মধ্যে থাকে পলিমাটি। যাকে বলা হয় মাটির প্রাণ। মাটি কাটার ফলে কমে যায় জমির উর্বরা শক্তি; যা পঞ্চাশ বছরেও পূরণ করা সম্ভব নয়। দেশে চাহিদানুযায়ী ইট প্রস্তুত করতে ১২৭ কোটি সিএফটি মাটির দরকার হয়। যার বেশিরভাগই কৃষি জমির উপরি ভাগ থেকে সংগৃহীত। ফসলি জমিতে ইটভাটি চালু করায় এর বিষাক্ত ধোঁয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জমির ফসল। ইট যেহেতু পোড়াতে হয় দীর্ঘক্ষণ ধরে উত্তপ্ত আগুনে, তাই আশপাশের জমির পানি যায় শুকিয়ে এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামতে থাকে নিচে।

সরকার এখন দেশের কৃষি জমি সংরক্ষণের দিকে নজর দিয়েছে। যেখানে সেখানে কৃষি জমিতে যার খুশি যেমন তেমনভাবে যাতে ইটভাটা, অপরিকল্পিত শিল্প-কারখানা এবং আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলতে না পারে সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের শতকরা ৮৫ ভাগ লোক কৃষিজীবী এবং কৃষিখাত আমাদের মোট কর্মসংস্থানের শতকরা ৭০ ভাগ জোগান দেয়। এ ছাড়াও কৃষি হচ্ছে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান উৎস। তদুপরি আমাদের এ ভূখণ্ডটি বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলসমূহের অন্যতম। মাথাপিছু আমাদের জমির পরিমাণ এক একরের এক-তৃতীয়াংশ থেকেও কম। আবার ভূমিহীনতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে, আমাদের জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ ভূমিহীন ও প্রায় ভূমিহীন। নদীর ভাঙন, শহর সম্প্রসারণ, শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠাসহ প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট বিভিন্ন কারণে আমাদের আবাদি জমির পরিমাণ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ফলে চার দশক আগে আমাদের কৃষি জমির পরিমাণ যেখানে প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ একর ছিল বর্তমানে তা এসে ২ কোটি ১৭ লাখ একরে দাঁড়িয়েছে। এ পরিমাণও নিম্নমুখী। পক্ষান্তরে গত চার দশকে আমাদের জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে এবং তাদের সঙ্গে বেড়েছে খাদ্য চাহিদা। এ অবস্থায় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ভবিষ্যৎ খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য কৃষি জমি রক্ষা করা ছাড়া আমাদের সামনে দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। সারা দুনিয়াতেই সব রাষ্ট্রের ভূমি ব্যবহার বিধি রয়েছে যা আমাদের নেই। এ ব্যবহার বিধিটিও চূড়ান্ত করা প্রয়োজন এবং এক্ষেত্রে পল্লী এলাকার ভবিষ্যৎ গৃহায়ণ চাহিদা পূরণের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে একটি বাস্তব, কার্যকর ও ফলপ্রসূ গৃহায়ণ নীতিমালা তৈরি করাও জরুরি।

বর্তমানে বাংলাদেশ খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং একই সঙ্গে আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের সংখ্যা বাড়তে থাকায় খাদ্যের চাহিদা বাড়তেই থাকবে। একই সঙ্গে বাড়তে থাকবে পুষ্টিকর নানা ধরনের খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা। এর জোগানের জন্যও ক্রমাগত চাপ পড়তে থাকবে জমির ওপর। কিন্তু শিল্প, অবকাঠামো ও সেবাসহ বিভিন্ন খাতের জন্যও নতুন নতুন জমি চাই। তার জোগান দেওয়া সহজ কাজ নয়। এ প্রক্রিয়ায় সামাজিক সংঘাতের আশঙ্কাও থেকে যায়।  কৃষি খাত আমাদের বড় শক্তি। এ খাত কেবল মুখের গ্রাস জোগায় না, শিল্প ও রপ্তানি খাতের বিকাশেরও বড় উৎস। একই সঙ্গে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির প্রতিও মনোযোগ বাড়াতে হবে। একই জমিতে চাই আরও বেশি ফলন এবং এ জন্য বিনিয়োগ যেমন বাড়াতে হবে তেমনি বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সুফল কাজে লাগানোর ওপরও সর্বোচ্চ জোর দিতে হবে। জন্মহার হ্রাসেও চাই আরও সচেতনতা সৃষ্টি, যাতে তৃণমূলেও এ উদ্যোগ যথাযথ সাফল্য খুঁজে পায়।কৃষি জমি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়ায় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এ মুহূর্তে মোটামুটিভাবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষি জমি হ্রাসের পরিণতিতে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পেলে এ ক্ষেত্রে সংকট দেখা দেবে। দেশের জনসংখ্যা যেখানে বেড়েই চলেছে সেখানে কৃষি জমি হ্রাস পেলে খাদ্য চাহিদা পূরণে সংকট হওয়ারই কথা। বিষয়টি মনে রেখে কৃষি জমির অপচয় রোধে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে। আবাসিক চাহিদা অবশ্যই একটি মৌলিক চাহিদা এবং এটি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। তবে কৃষি জমির ওপর চাপ কমিয়ে কীভাবে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে।

     লেখক :  প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সাবেক মন্ত্রী

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর