বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’

মাত্র বিশ-বাইশ বছরের ব্যবধানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভূত অগ্রগতি ও পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করে রীতিমতো বিস্ময়বোধ করেন ইন্দ্রজীতপুরের ওয়াকিলউদ্দীন সাহেব। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহোদয়ের বর্ণ পরিচয় প্রথম ভাগ পড়ে অক্ষর জ্ঞান, দ্বিতীয় ভাগ পড়ে বানানরীতি এবং সীতানাথ বসাকের বাল্যশিক্ষা পড়ে নীতিজ্ঞান  আত্মস্থ করছিলেন। তার তালপাতায় মখশ করে করে হাতের লেখা এবং পাথরের শ্লেটে চক পেন্সিল ঘষে ঘষে অঙ্ক ও আঁকাজোকা শেখা। বাষট্টি বছর বয়সে আজ তিনি দেখছেন এখন ছড়া শুনে এবং ছবি দেখে অক্ষর শেখা যায়। আর বানান? তা আর শিখতে হচ্ছে না, কম্পিউটার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ কাজটি করে দিচ্ছে। হাতের লেখার দরকারই নেই, কেননা কম্পিউটারও বিনা বাদ প্রতিবাদে এ কাজ করে দিচ্ছে ছাপার অক্ষরে। ওয়াকিলউদ্দীন তাদের সময়ে পায়ে হেঁটে সদরের লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়ার বই ধার নিয়ে আসতেন, সেখানে বসে নোট নিতেন, তারপর ক্লাসের হোমওয়ার্ক তৈরি করতেন। এখন যেন সার্ফ এক্সেলের মতো ‘গুগল আঙ্কেল’ আছেন না, তার কাছে যা জানতে চাওয়া হবে, আলাউদ্দীনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো সব সামনে এনে হাজির করছেন সেখান থেকে ‘কাট অ্যান্ড পেস্ট’ করে মুহূর্তের মধ্যে বড় বড় প্রতিবেদন প্রজেক্ট তৈরি হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এখন যে টার্ম পেপার- থিসিস লিখতে দেওয়া হয় তা তারা বাড়তি কোনো ঘাঁটাঘাঁটি ও পড়াশোনা ব্যতিরেকে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তৈরি করে দিতে পারে। ওয়াকিলউদ্দীন সাহেব সেদিন দেখলেন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া তার এক নাতি স্পাইরেল বাইন্ডিং করা প্রকল্প দাখিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিষয়-ঐবধষঃয পধত্ব ধহফ ঐুমরবহব. তার স্কুল থেকে তাকে এটি করতে দিয়েছে। গুগল থেকে পুরো টেক্স্ট এবং প্রাসঙ্গিক ছবি ডাউনলোড করে সেটি কাট পেস্টের মাধ্যমে তৈরি হবে এ প্রজেক্ট। অথচ এ দ্বিতীয় শ্রেণিতে তো দূরের কথা আই এ পড়ার সময়ও এভাবে এ ধরনের প্রজেক্ট তৈরি করার কথা ওয়াকিলউদ্দীনদের মাথাতেই আসেনি।

ওয়াকিলউদ্দীন সাহেবের ধারণা- তাদের সময় নিজের থেকে অতি ইচড়েপাকা সৃজনশীল প্রকৃতির এ ধরনের কাজ করার চল ছিল না, ছিল বড়জোর কোনো মহাজন বাক্যের ভাব সম্প্রসারণের দায়দায়িত্ব যা তাদের শেখানো হতো চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণি পর্যায়ে। তার উপলব্ধি তাদের সময়কার বিদ্যা শিক্ষা দেওয়া নেওয়ার পথ পদ্ধতিটা ছিল একটু কম স্মার্ট- অর্থাৎ পিছিয়ে পড়া ভাব আর এখনকারটা অতি স্মার্ট, বড্ড বেশি দ্রুত এগোনোর প্রয়াস। বাস্তববাদী মধ্যপন্থিদের মতে এ দুটোই খারাপ। অর্থাৎ তাদের মতে শেখার জিনিস শেখার মতো করে, আনন্দের সঙ্গে, মনোযোগের সঙ্গে শিখতে ও শেখাতে হবে। কেননা যা কিছু শিখতে ও শিখাতে হবে তার সঙ্গে নিজের মন ও চিন্তাশক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সাজুয্য (কমপ্যার্টিবল) রেখে না হলে এ শেখাটা মনের মধ্যে, মূল্যবোধের বলয়ে, চিন্তার চৌহদ্দিতে, উপলব্ধির খতিয়ানে স্থায়ীভাবে পত্তন হবে না। আর তা না হলে এ শেখা কোনো কিছু উপলব্ধি ও সৃষ্টির জন্য পুষ্টিকর পাথেয় হিসেবে পাওয়া যাবে না।

ওয়াকিলউদ্দীন সাহেবরা কম্পিউটার দেখেছেন ও এর সম্বন্ধে সবে জেনেছেন গেল শতকের আশির দশকে, এটি ব্যবহার করতে শিখেছেন নব্বইয়ের দশকে। আশির দশকের মাঝামাঝিতে অক্সফোর্ডে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে উকিলউদ্দীন সাহেব ব্যালান্সশিট করা শেখেন সুপারক্যালক এ, নব্বুইয়ের দশকে দেশে দেখেন লোটাস ১২,  এখন একসেল শিট এ রাখা হচ্ছে সব হিসাব কিতাব। বলাবাহুল্য তিন দশকের মধ্যে  কম্পিউটার এখন তাদের জীবনের সব কিছুতে নাক গলানোর হিম্মত রাখে। ডেক্সটপ, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, নোটপ্যাডে পরিণত হতে হতে এখন আইপ্যাড এমনকি মোবাইল ফোন সব কিছুতে এখন তাদের সঙ্গীসাথী হতে চলছে। ইতিমধ্যে মোবাইল ফোন বা টেকনোলজি এগিয়ে এসেছে আরও সদর্পে সগৌরবে। এই মাত্র চার পাঁচ বছরে মোবাইল ফোন-এ্যাপস এর সাহায্যে কত কিছুই না সবার দৃষ্টিসীমায় এনে দিচ্ছে। এ মুহূর্তে অবস্থা এমন যে এখন খবরের কাগজ আলাদা করে কিনে পড়তে হবে না, বই কিনে শেলফ ভরতে হবে না, টিভিও দেখা লাগবে না (বেচারা রেডিও এখন ফুর্তি ফার্তির কাজে বিকৃত ও ফাস্ট উচ্চারণে বেগার খাটছে) সব কিছু এখন মোবাইল ফোনে এমনকি সেখানে পুরো সিনেমাও পর্যন্ত দেখা  যায়। ছোট্ট একটা চিপসের মধ্যে দুনিয়ার তাবৎ তথ্য-উপাত্ত ঢোকানো যাচ্ছে। নিজের বা নিজেদের ছবি  নিজে তোলা ক্ষেত্রে সেলফি নামের এক পুজনীয় পদ্ধতি এই মাত্র কদিন আগে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।  ওয়াকিলউদ্দীন সাহেবের দুই বছরের  নাতনিটা পর্যন্ত এখন যখন তখন সেলফি তুলতে চায়। দ্রুত কত সহজলভ্য হয়ে যাচ্ছে কত কিছু! সব কিছু দোরগোড়ায় আসায় প্রযুক্তি ব্যবহারে এখন একটা সমস্যা দাঁড়িয়েছে, এসব ব্যবহারে ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ পরিবেশ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। কম্পিউটার ও মোবাইল টেকনোলোজি এখন যে কোনো  তথ্য-উপাত্ত অতি সহজে পাইয়ে দিতে গিয়ে সেখানে ভালো ও মন্দকে মিলিয়ে একত্রে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। নিজের ব্যক্তিগত একান্ত গোপনীয় বিষয় আশয়ও অন্যের এখতিয়ারে চলে যাচ্ছে। এসব তথ্য ও ছবি অপব্যবহার করে ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাকে তাকে। যাবতীয় সচিত্র প্রতিবেদন সহজলভ্য করে ভিডিওতে ছেড়ে দিচ্ছেন মি. ইউটিউব। এখানে ভালো বা প্রয়োজনীয় তথ্য প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে মন্দ ছবি, খারাপ প্রবণতা ও প্রতিক্রিয়াশীল ছবি ও তথ্যাদিও একই সঙ্গে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো সবখানে সহজপ্রাপ্য ও সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। ওয়াকিলউদ্দীন সাহেব হয়তো শচিন কর্তার একটা গান শুনতে চাইলেন, ইউটিউবে সচিত্র পাওয়া যায়- পেলেন, কিন্তু সেটি ডাউনলোড করার সঙ্গে সঙ্গে তার পাশে আজেবাজে অনেক বিষয়ের সচিত্র প্রতিবেদনের পসরা এসে হাজির। শচিন কর্তার গান শোনার অবসরে তার চোখ চলে যেতে চাইল সেসব নোংরা বিষয় আশয়ে-গান শোনার সঙ্গে সঙ্গে এই বয়সেও তিনি লোভ সংবরণ করতে পারলেন না...। তার আশঙ্কা অমূলক নয়, আজকালকার কিশোর ও যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে এ টেকনোলজি তাদের প্রচণ্ডভাবে ইচড়েপাকার পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। এসব ভেবে আজকাল ক্যাডেট কলেজসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে ও গৃহে অনেক অভিভাবক বাচ্চাদের ল্যাপটপ কিংবা মোবাইলে খারাপ কিছু ডাউনলোড করতে না দেওয়ার পথ-ঘাট বা বন্ধ করার উপায় খুঁজছেন। সর্বত্র ভালো আর মন্দ এমনভাবে পরস্পর প্রযুক্ত হয়ে আছে যে এদের আলাদা করার সহজ পথ পাওয়া যাচ্ছে না। শ্যামের বাঁশি শুনে তার প্রেমে পড়ায় রাধার জাত কুলমান সব যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। এখন শ্যাম রায়কে রাখতে গেলে কমলিনি রাধার কুল থাকে না। উপায় কী? উপায় বের করতেই হবে নইলে প্রযুক্তির দুষ্ট ভাইরাস ভালো দিকগুলোকে ব্যবহারে এমন বাদ সাধবে যে শেষে আম ছালা দুটোই যাবে। বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্রটির সার্বিক আত্মমর্যাদা রক্ষার অবস্থাটিও শ্যাম রাখি না কুল রাখির পর্যায়ে। সেই প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে বাংলার সহায় সম্পদ ও প্রাকৃতিক প্রাচুর্যের প্রতি চোখ সবার। স্বয়ং সম্রাট আওরঙ্গজেবও জানতেন ও মানতেন ভারতবর্ষের সব প্রদেশের মধ্যে সুবা বাঙ্গালাই সেরা। মোগল সম্রাটের কাছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে বাংলাতেই ব্যবসা বাণিজ্যের লাইসেন্স চেয়েছিলেন। উপমহাদেশে বাংলাদেশের জিও পলিটিক্যাল অবস্থানও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দূরের ও কাছের সৌন্দর্য ও সম্পদ পিয়াসীরা তার চার ধারে সব সময় ঘুর ঘুর করে। তার সকল সৌভাগ্যে ভাগ বসাতে আসতে চায় সবাই কিন্তু একই সম্পদ ও সৌন্দর্য একসঙ্গে একাধিক চোখে উপভোগ্য হয় না। বাংলার সম্পদ ও সৌন্দর্য বাইরের বণিক, সওদাগর, ধর্মপ্রচারক, শাসক, প্রশাসক, বর্গি হার্মাদ, হানাদার সবাই টেনেছে। ১৯৭১ এর আগে সমতটের এ ভূখণ্ডটি কোনোদিন ‘ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রিক সীমানায়’ সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। ব্রিটিশ ভারত বিভাগের পর একই রাষ্ট্রভুক্ত হয়েও পশ্চিম পাকিস্তান তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)-কে শোষণ করেছে। আর সেই শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে ‘স্বাধীন আশায় পথচলার’ অধিকার অর্জনের সংগ্রামে অর্থাৎ যাবতীয় বঞ্চনা বণ্টন  বৈষম্য থেকে মুক্তি লাভের লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয় বাঙালি জাতিকে। স্বাধীনতা লাভের পর স্বাধীন আশায় পথ চলতে নিজের সব স্বার্থ সংরক্ষণ করে সার্বভৌমত্ব ও আত্মমর্যাদা উপভোগের প্রকৃত পথ পাওয়ার প্রচেষ্টায় এখনো বাংলাদেশ। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে একই সমতলে দাঁড়াতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী এ দেশের অর্থনীতিকে। তাকে উন্নয়নের পথে থাকতে হলে, এগোতে হলে অন্যরে (অন্যায়ভাবে) সৌভাগ্যের ভাগ দেওয়ার প্রশ্ন, আগ্রহ-আবদার ও হুমকি থেকেই যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতির স্বয়ম্ভর হওয়ার প্রয়াস প্রচেষ্টায় প্রায়শ ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ ধরনের অবস্থায় এসে দাঁড়াতে হচ্ছে। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় রক্তদানের স্মৃতিতে ভাস্বর জাতির আত্মমর্যাদা, স্বকীয় ও স্বাধীনতা বজায় রাখার সংগ্রামে ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ পরিস্থিতিতে যথাসতর্কতা অবলম্বনের অবকাশ থেকেই যাবে। সর্বৈবভাবে দেশের আর্থ-সামাজিক সংহতি বজায়, আবহমান সংস্কৃতি ভাষা-কৃষ্টি-কালচার যথাযথ সংরক্ষণ এবং বিদেশি চ্যানেলের জোয়ারে ভেসে আসা অপসংস্কৃতি, দেশি উন্নয়নে বিদেশি স্বার্থের কূটকৌশলে দান অনুদান অনুপ্রবেশের ব্যাপারে, জোয়ারে একাকার হয়ে যাওয়া অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির বন্যার সঙ্গে অসাবধানতার শৈবালধাম এসে যেন অবসাদ অপঘাত সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টিক্ষেপের বিকল্প নেই। তথ্য ও প্রযুক্তির ভালো দিক আমাদের সমৃদ্ধির সড়কে নিয়ে যাক, কিন্তু সেসবের মন্দ দিক যেন আমাদের মনোযোগ, মেধা ও সৃজনশীল উদ্যোগ ভাবনা আমাদের যেন বিপথগামী করতে না পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে বাংলাদেশের বর্তমান সময় সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে। 

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর