বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী

৭০ বছর আগে যারা ছিল হানাদার, তারা এখন হয়েছে সন্ত্রাসবাদী। আর ’৭১ সালে যারা ছিল রাজাকার এখন তারা হয়েছে  জামায়াত। প্রথমটা কাশ্মীরে এবং দ্বিতীয়টা বাংলাদেশে। এর ফলে গোটা বিশ্বকে নতুন করে বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। রূপ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিপদের মাত্রাও যে বহুগুণ বেড়েছে, তা বুঝতে পারছে না বর্তমান শাসক দল। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে, পাকিস্তানের শাসক দল ইসলাম বিপন্ন ধুয়া তুলে বারবার সন্ত্রাসবাদীদের ভারতবর্ষের কাশ্মীরে অশান্ত করার জন্য একটার পর একটা নাশকতামূলক ঘটনা ঘটিয়েছে। প্রথমে পাঠানকোট, এরপরে উরি। সবশেষে কাশ্মীরের পাম্পোরায় সন্ত্রাসবাদীরা লুকিয়ে থেকে অশান্তির বাতাবরণ সৃষ্টিই শুধু করেনি, এই অশান্ত যে মানব সভ্যতার প্রধান শত্রু তা কে কাকে বোঝাবে। নরেন্দ্র মোদি নওয়াজ শরিফকে? না শরিফ মোদিকে? আর এ নিয়েই যত গোলমাল।

কথায় বলে, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। এই ৭০ বছরে বিপাশা, ঝিলাম নদীর জল বারবার রক্তাক্ত হয়েছে। মাঝপথে যে সার্জিক্যাল স্ট্রাইককে কেন্দ্র করে মোদি এবং তার সরকার যেভাবে দেশকে উত্তেজিত করে চলেছে, তাতে শান্তির পরিবর্তে অশান্তির বাতাবরণই প্রকাশ্যে এসে গেছে। ৭০ বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে অশান্তির বীজ যারা বপন করেছে, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাময়িকভাবে তাদের দেশে নির্বাচন আসন্ন হওয়াতে আপাতত নতুন ধরনের কূটনৈতিক কৌশল নিয়েছে। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে মোদি মুখে বলেছেন, বুক চাপড়াবেন না। কিন্তু মোদি মন্ত্রিসভার সব সদস্যই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে দাবি করেছেন, ভারত এই প্রথম নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করল। তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিক্কর (যিনি গোয়ার আরএসএস প্রধান) প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে বলে যাচ্ছেন, এর আগে ভারতের তরফে কোনো সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হয়নি। এটা মোদির সাফল্য। সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের দিন মোদি নিজে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংকে যাবতীয় ঘটনা জানিয়েছিলেন। বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ১০ নম্বর জনপথে গিয়ে সোনিয়া গান্ধীকে জানান। তখনো পর্যন্ত কিছুই প্রকাশ্যে আসেনি। সোনিয়া এক বিবৃতিতে ভারতীয় জওয়ানদের সাহসিকতা এবং আত্মত্যাগের ভূয়সী প্রশংসা করেন। কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধীও জওয়ানদের উজ্জীবিত করেন। অন্যান্য বিরোধী দলের নেতৃত্বও জওয়ানদের ভূমিকার প্রশংসা করেন। কিন্তু আগে বলেছি, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। বিজেপি এবং আরএসএস কোমর বেঁধে প্রচার শুরু করে কেবল উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের নির্বাচনকে মাথায় রেখে।

পরিস্থিতি এমন জায়গায় তারা নিয়ে গেছে যে, সরকারের কাছে নির্বাচনে যাওয়ার মতো কোনো ইস্যু নেই। তাই যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে তারা বারবার সার্জিক্যাল স্ট্রাইককেই তুলে ধরেছে। শুধু তাই নয়; স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে দিল্লির রামলীলা ময়দানে রাবণ বধের যে কর্মসূচি থাকে, তা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় উত্তরপ্রদেশের লক্ষেৗতে। স্বয়ং মোদি সেখানে গিয়ে দশেরা উৎসব পালন করেন। মুখে নিরাপত্তার কথা বললেও এই সিদ্ধান্তের পেছনেও ছিল কূটরাজনৈতিক চাল। সামনেই উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচন। তাই দশেরার রাবণ বধ কর্মসূচি সে রাজ্যেই নিয়ে গেছেন নরেন্দ্র মোদি। সেখানে যা হওয়ার তাই হয়েছে। দশেরার উৎসবে কার্যত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের আনন্দ উদযাপন করা হয়েছে। সেখানে বক্তৃতা করতে গিয়ে মোদি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের বিষয়টি সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন। ভারতে পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীদের হামলার থেকেও বেশি জোর দিয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদের বিপদ প্রসঙ্গে। পাকিস্তানকে সরাসরি আক্রমণ না করে মোদি সন্ত্রাসবাদের শিকার সিরিয়ার নিরপরাধ মানুষের দুর্দশার কথা তুলে ধরেছেন। সেই সঙ্গে বলেছেন, সন্ত্রাসের কোনো সীমানা হয় না। যদি কোনো দেশ মনে করে তারা সন্ত্রাসবাদ থেকে মুক্ত, তাহলে তারা বড় ভুল করবে। অনেকে মনে করছেন, পাকিস্তানকে উপলক্ষ করে আসলে চীনকেই বার্তা দিতে চেয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।  এদিকে রামলীলা ময়দান থেকে রাবণ বধ কর্মসূচি উত্তরপ্রদেশে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চাল ধরে ফেলেছে উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক দলগুলোও। লক্ষেৗর বিশাল জমায়েতে বারবার উরি প্রসঙ্গ টেনে বাস্তবে নরেন্দ্র মোদি সমস্ত স্পটলাইটের আলো বিজেপির দিকে টেনে নিতে চেয়েছেন। পরিস্থিতি যখন এতটাই জটিল হয়ে উঠেছে যে, সে সময় কিছুটা বাধ্য হয়েই মুখ খুলেছেন দেশের প্রাক্তন নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন। তিনি এক বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, মনমোহন সিংয়ের আমলে চারবার সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হয়েছিল। শেষ অপারেশন হয় ২০১১ সালে। সেবার নিয়ন্ত্রণ রেখার ভিতরে গিয়ে ৫০ পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেছিল ভারতীয় সেনারা।

এ ছাড়াও যখন এইচডি দেবগৌড়া প্রধানমন্ত্রী এবং মুলায়ম সিং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন, তখনো একবার নিয়ন্ত্রণ রেখা পার করে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছিলেন ভারতীয় জওয়ানরা। ভারতের আরেক প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেএন দীক্ষিত, যিনি বাংলাদেশেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তার বইয়ে লিখেছেন— ভারতের কাশ্মীর নীতি এবং সেখানকার মানুষের ওপর পাকিস্তানের সন্ত্রাসের ব্যাপারে আমেরিকার মানুষ ও সেখানকার রাজনীতিকদের বোঝাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলেন। আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। এ ঘটনা চাপা দেওয়ার জন্য সিদ্ধার্থ শঙ্করের কিছু স্তাবক অসত্য প্রচার করে গেছেন। ভারতের শীর্ষ কূটনীতিকরা যে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের কাজে ক্ষুব্ধ তাও গোপন রাখেননি জেএন দীক্ষিত। তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যথেষ্ট ভালো কাজ করেছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত নরসিমা রাও। কিন্তু তিনি সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়কে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলেন। তিনি ওয়াশিংটনে বসে টেলিফোনে নরসিমা রাওয়ের রাজনৈতিক সচিব জিতেন্দ্র প্রসাদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতেন। এই সুযোগে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ একাধিক অভিযোগ করে এসেছে। আর তাদের সাহায্য করেছে সিআইএর দক্ষিণ এশিয়ার ভারপ্রাপ্ত এক অফিসার। ৭০ বছর ধরে নানামুনী নানাভাবে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন। অথচ তারা ইতিহাসের প্রকৃত ঘটনা মন দিয়ে পড়েননি বা শোনেননি।

আগেই পাকিস্তানের হানাদার পাঠানোর কথা উল্লেখ করেছি। ৭০ বছর আগে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহটি কাশ্মীরের জনগণের কাছে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওই সপ্তাহে যখন পাকিস্তানি হানাদাররা কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের উপকণ্ঠে হামলা চালায়, তখন ওই রাজ্যের মহারাজা হরি সিং জম্মু ও কাশ্মীর ভারতে অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা করেন। ভারতীয় সেনা শ্রীনগরে গিয়ে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ওই যুদ্ধে কাশ্মীরে শেখ আবদুল্লার নেতৃত্বে জনগণ ভারতীয় বাহিনীকে সক্রিয় সহযোগিতা করে। আর এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছিলেন লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রামাণ্য তথ্য থেকে দেখা যায়, অখণ্ড ভারতের ৫৩০টি দেশীয় রাজ্যের মধ্যে জম্মু-কাশ্মীর একটি। স্বাধীনতা লাভের সময় দেশীয় রাজ্যগুলোকে হয় ভারতের আর না হয় পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে বলা হয়। এ বিষয়ে দেশীয় নৃপতিদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হতো। ভারত স্বাধীনতা আইনে এ ব্যাপারে শর্ত বলে কিছু ছিল না। বরং ভারত উপমহাদেশের পাকিস্তান বা ভারত রাষ্ট্রের গভর্নর জেনারেল দ্বারা দেশীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তি গৃহীত হওয়ার পর ওই রাজ্য ভারত বা পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরাজ্য বলে বিবেচিত হতো। রাজ্যের অন্তর্ভুক্তিতে জনগণের ইচ্ছে-অনিচ্ছে প্রকাশের কোনো অবকাশ ছিল না। এমনকি তাদের ধর্মমতের বিষয়টিও সেক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক ছিল না। কাশ্মীরের ভারতে অন্তর্ভুক্তি সমর্থন করেছিল রাজ্যের বৃহত্তম এবং জনপ্রিয়তম সংগঠন শেখ আবদুল্লার ন্যাশনাল কনফারেন্স। প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিক্কর এবং অমিত শাহরা যতই গলা ফাটিয়ে বলুন, মনমোহন সিংয়ের আমলে কোনো সার্জিক্যাল অপারেশন হয়নি, সে ব্যাপারে এখনো মুখ খোলেননি লালকৃষ্ণ আদবানি, অরুণ জেটলি এবং সুষমা স্বরাজ। কারণ ড. মহমোহন সিং যখন সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেন, তখন এই তিনজনের সঙ্গেই তিনি কথা বলেছিলেন। এমনকি ২০১২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে সমস্যা মেটানোর জন্য মনমোহন ঢাকা গিয়েছিলেন, তখন তিস্তাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এই তিনজনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। এই তিন নেতাই সেদিন বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার সিদ্ধান্ত সঠিক এবং সদর্থক।

তাহলে যে প্রশ্নটি দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরছে, তা হলো বিজেপির তিনটি নীতিকে সামনে রেখে মোদি ক্ষমতায় এসেছিলেন। কাশ্মীর থেকে সংবিধানের ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার, অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ এবং অভিন্ন দেওয়ানি নীতি চালু করা। মোদি ক্ষমতায় এসে বুঝতে পেরেছেন, এই তিনটি বড় কঠিন কাজ। ২০১৪ সালে তিনি শতকরা ২৮% ভোট পান। আর ৬৮% ভোট পায় বিরোধীরা। অর্থাৎ ৬৮% লোক ওই তিন প্রস্তাব মানে না। সেই কারণেই কি মোদি বাহিনী নতুন করে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের খেলায় মেতেছে? কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধী বলেছেন, ভারতীয় সেনাদের রক্ত নিয়ে মোদির দালালি ভারতের মানুষ মেনে নেবে না। এখন দেশে একটাই আলোচিত বিষয়— সার্জিক্যাল অপারেশন।

     লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর