শুক্রবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

নকল ও ভেজাল ওষুধ : জানাতে চাই ও জানতে চাই

ড. এ কে লুত্ফুল কবির

নকল ও ভেজাল ওষুধ : জানাতে চাই ও জানতে চাই

পত্রিকার কিছু শিরোনাম দেখে আমরা আঁতকে উঠি। যেমন : নকল ভেজাল ওষুধে বাজার সয়লাব, নামি-দামি কোম্পানির ওষুধেও ভেজাল, ভেজাল খাদ্য এবং নকল ওষুধ তৈরি ও বিক্রি বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং অবাধে বিক্রি হচ্ছে ভেজাল ওষুধ ইত্যাদি। সম্প্রতি আমার এক আত্মীয় জানালেন, তিনি দৈনিক ৭-৮ প্রকার ওষুধ খান।  পত্রিকায় ওষুধসংক্রান্ত সংবাদ দেখে মাসখানেক ধরে ওষুধ আর খাচ্ছেন না। ক্রমেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। বললাম ওষুধ না খেলে তো এমন হবেই। দম নিয়ে বললেন, ‘ভেজাল ও নকল ওষুধ কি?’ বললাম, আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সব ওষুধই নকল, তবে ভেজাল কিনা বলতে পারব না। এ কথা শুনে চমকে উঠলেন। প্রিয় পাঠক, আপনারাও হয়তো বিস্মিত হয়েছেন। আসলে দেশের সবকটি ওষুধ কোম্পানিই আবিষ্কারক কোম্পানির ওষুধের ফর্মুলা হুবহু (কপি) তৈরি করে। সেই অর্থে সব ওষুধই নকল (একই ফর্মুলায় তৈরি), কেউ নতুন ওষুধ (জেনেরিক) উৎপাদন করে না। তবে হ্যাঁ, নকল ওষুধ বলতে আজকাল বুঝানো হয়, একটি কোম্পানির উৎপাদিত ওষুধের প্যাকেট বা মোড়ক বদল করে অন্য কোম্পানি যদি বাজারে দেয়, যা কোনো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি কখনো করে না, একশ্রেণির অসাধু চক্র মানুষকে প্রতারিত করতেই এটি করে থাকে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের কড়া নজরদারিতে বন্ধ করা সম্ভব। ভেজাল ওষুধ সম্পর্কে এক সাংবাদিক বন্ধু জানতে চাইলে বললাম, ওষুধ ভেজাল হওয়ার সুযোগ নেই কারণ আমাদের কোম্পানিগুলো ওষুধ তৈরির মূল উপাদান ও অন্যান্য উপাদানসমূহের অধিকাংশ আমদানি করে, নিজেরা উৎপাদন করে না, শুধু বিভিন্ন ডোসেজ ফর্ম হিসেবে বাজারজাত করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ, যার একটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল উপাদান প্রোপ্রানলল। এখানে প্রোপ্রানলল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধের এপিআই থাকলে তখন বলা যেতে পারে ভেজাল, যা কোনো ওষুধ কোম্পানি করে বলে মনে করি না কারণ ওই সংযুক্ত এপিআইটিও কিনতে হবে, এতে তার উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। সাংবাদিক বন্ধুটি আমার কথায় সহমত পোষণ করলেন না। তিনি জানালেন, ২০০৯ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। কমিটি ৭৩টি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন শেষে ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে। এরপর দশম জাতীয় সংসদ গঠিত হলে ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করতে সংসদীয় কমিটি পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। দেড় বছরে ৮৪টি কারখানা পরিদর্শন করে তাদের প্রতিবেদন সংসদীয় কমিটির কাছে জমা দেয়। আপনার মতে ওষুধে যদি ভেজাল না-ই থাকে, তাহলে সরকারের এতসব কর্মযজ্ঞ করার দরকার কি ছিল। প্রত্যুত্তরে বললাম, কমিটি যদি ৭৩টি কোম্পানিকে ত্রুটিপূর্ণ চিহ্নিত করে তাহলে বলব এগুলো ছিল অবকাঠামোগত ত্রুটি যেমন  ভবনের নির্মাণ ত্রুটি, মেশিন অকেজো হওয়া বা দক্ষ লোকবলের অপর্যাপ্ততা ইত্যাদি। এতেও তৃপ্ত না হয়ে যুক্ত করলেন, বিশেষজ্ঞ পরিদর্শক দলের প্রতিবেদনে জানা যায়, জিএমপি মানদণ্ড অনুযায়ী ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে কিনা কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে তাই মূল্যায়ন করা হয়েছে। তাকে বললাম, আমি আপনার পরের কথায় একমত কারণ জিএমপি বা গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা বিশেষজ্ঞ কমিটি সেটাই খালি চোখে দেখেছে বা পর্যবেক্ষণ করেছে বলে আমিও শুনেছি। এ প্রসঙ্গে তাকে বছরখানেক আগে সারা দেশে যখন মাছ-মাংস ও ফলমূলে ফরমালিন ব্যবহার নিয়ে তোলপাড় চলছিল সে সময়ের কথা বললাম। তখন ফরমালিন শনাক্তকরণের উদ্দেশ্যে কীট ব্যবহারের মাধ্যমে তদন্ত দল বাজার ঘুরে খাদ্যে ফরমালিন পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছিলেন। আরও নিশ্চিত হতে খাদ্যদ্রব্যের নমুনা বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহপূর্বক ল্যাবে পরীক্ষা করা হয় এবং গবেষণালব্ধ ফলাফল সবার জ্ঞাতার্থে জাতীয় পত্রিকায় সরবরাহ করায় ফরমালিনের ব্যবহার রোধকল্পে জনসাধারণের  মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়। আমার বন্ধুর বক্তব্যে ছাত্রজীবনের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। শহীদ মিনারের উল্টা দিকে টিয়া পাখি দিয়ে ভাগ্য গণনা করতে এক বন্ধুসহ যাই। হাত দেখে তিনি জানালেন, আমাদের উভয়ের ভবিষ্যতে বিদেশ গমনের অফুরান সম্ভাবনা। এক রিকশাচালক তার হাতটিও বাড়িয়ে দিলেন। টিয়া পাখির ভাগ্যগণক জানালেন, ভবিষ্যতে একাধিক বিবাহ বন্ধনের সম্ভাবনা আছে। উল্লেখ্য, ভাগ্যগণক সেই ব্যক্তিটি কোনো এক ফাঁকে প্রত্যেকের পেশাটা জেনে নিতেন সুকৌশলে। তখন আঁচ করতে না পারলেও এখন বুঝি, সেই ভাগ্য বিশেষজ্ঞের পাণ্ডিত্যটা কি ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রের (বিশেষত ফার্মেসির) ভবিষ্যতে বিদেশ গমনের সম্ভাবনা আর ঢাকা শহরে রিকশাচালকের একাধিক বিবাহযোগের (কমপক্ষে গ্রামে ও শহরে) ভবিষ্যদ্বাণী করা সত্যি বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ছাড়া সম্ভব নয়। আপাত দৃষ্টিতে একটি কারখানা পরিদর্শন করে অবকাঠামোগত সুবিধাদি, দক্ষ লোকবল ও যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য বিষয় আছে কি নেই পর্যবেক্ষণ করা যায়, তবে প্রতিষ্ঠানটির ওষুধে ভেজাল আছে কিনা বা প্রতিষ্ঠানটি ভেজাল ওষুধ তৈরি করছে কিনা তা এক কথায় বলে দেওয়া বোধকরি টিয়া পাখির ভাগ্য গণনার মতোই। একটি ওষুধে কি কি উপাদান আছে বা কি অনুপাতে মেশানো হয়েছে কিংবা কোন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত হয়েছে তা জানার জন্য ওষুধটির নমুনা গবেষণার দাবি রাখে। এটি কেবল অত্যাধুনিক মেশিনারিজ সমৃদ্ধ গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক একজন গবেষকের পক্ষেই বলা সম্ভব। বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশে এ জাতীয় কোনো গবেষণালব্ধ মন্তব্য আমরা দেখিনি, এমনকি দেশি-বিদেশি কোনো গবেষণাগারের রেফারেন্সও উল্লেখ করা হয়নি। এ ছাড়া ওষুধে ভেজাল নিরূপণকারী কোন ধরনের কীট (ফরমালিন শনাক্তকরণের মতো) ব্যবহারের কথাও শোনা যায়নি। তাহলে একটি ওষুধে ভেজাল রয়েছে কিংবা প্রতিষ্ঠানটি নিজেই ভেজাল বা কোম্পানির মালিক ভেজাল না নির্ভেজাল জাতীয় কথা বলে কোনো কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়া কতটা যৌক্তিক। এতে মানুষের মধ্যে ওষুধ এবং কোম্পানিসমূহ সম্পর্কে নেতিবাচক ও ভীতিকর ধারণা জন্মাবে এবং আমার আত্মীয়ের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও ওষুধ সেবন করা ছেড়ে দেবে বা বিদেশি ওষুধের ওপর নির্ভরতা বাড়বে। এতে একদিকে সম্ভাবনাময় এ খাতটি যেমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে এবং দেশে-বিদেশে এর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, অন্যদিকে রাষ্ট্র বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হবে। বন্ধুটি আমার খানিক থমকে গিয়ে ওষুধ সম্পর্কিত আমার জ্ঞান নিয়েই এবার প্রশ্ন তুললেন এবং পরে যা বলেন তা আরও ভয়ানক। আমাদের দেশে ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ফার্মেসি বিভাগ যাত্রা শুরুর পর ফার্মাসিস্টরা ওষুধশিল্পে কাজ করে দেশের ওষুধের বার্ষিক চাহিদার ৯৭% ওষুধ দেশেই উৎপাদন করছে, এমনকি বিশ্বের ১১৭টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। একসময় বাংলাদেশকে ৮০% এরও বেশি ওষুধ আমদানি করতে হতো, যার মধ্যে অন্যতম ছিল এন্টিক্যান্সার ওষুধ। আমার জানামতে বিকন ও টেকনো ড্রাগস নামক দেশীয় দুটি কোম্পানি এন্টিক্যান্সার জাতীয় ওষুধ উৎপাদন শুরু করে। একসময় বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো যে ওষুধ বিক্রি করত প্রায় লাখ টাকার উপরে সেই একই ওষুধ দেশীয় কোম্পানি বাজারে দেয় মাত্র ৫০-৬০ হাজার টাকায়। বিষয়টি নিয়ে আমাদের বিভাগের সহকর্মী ও অন্য ফার্মাসিস্টদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। একজন সিনিয়র সহকর্মী বলেই ফেললেন, প্রায় অর্ধেক দামে কীভাবে এটি সম্ভব, এতে কি ওষুধ আছে না অন্য কিছু? বিতর্কের অবসান হলো মাসছয়েক পর, যখন সেই সহকর্মীর এক আত্মীয়ের ক্যান্সার ধরা পড়ল। আর্থিক বিবেচনায় ও চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে টেকনো ড্রাগসের ওষুধ দিয়ে কেমোথেরাপি দেওয়া শুরু হলো। তিনি (ক্যান্সারে আক্রান্ত)  এখনো সুস্থ আছেন বলা জানা যায়। বলাবাহুল্য, টেকনো ড্রাগসের মালিক আমাদের বিভাগের ছাত্র ছিলেন বলে সেই সহকর্মীর আত্মীয় নামমাত্র মূল্যে ওষুধগুলো পেয়ে আসছিলেন। পত্রিকার রিপোর্ট দেখে মনে সন্দেহ হলে এক অনকোলজিস্ট বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আসলেই টেকনো ড্রাগসসহ দেশীয় কোম্পানির এন্টিক্যান্সার ওষুধের সমস্যা আছে কিনা? আমার সেই মেজর (ডা.) বন্ধুটি জানান, তিনি গত ৭ বছর ধরে দেশীয় কোম্পানি ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ লেখেন না, এর মধ্যে টেকনো ড্রাগও আছে। রোগীর কাছ থেকে কোন অভিযোগও নাকি পাননি আর ওষুধের কার্যকারিতা নিয়েও কখনো সন্দেহ হয়নি বলে যুক্ত করেন তিনি।

পত্রিকান্তরে জানা যায়, কয়েকটি কোম্পানি তৈরি করছে ভেজাল ওষুধ। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে টেকনো ড্রাগসের উৎপাদিত জন্মবিরতিকরণ ওষুধ সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মাধ্যমে ৮ বছর ধরে সারা দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বন্ধুর কাছ থেকে উপসংহারে পৌঁছলাম এই বলে যে, আপনার কথামতো টেকনোর ভেজাল ওষুধ খেয়ে গত ৮ বছরে দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ তো দূরের কথা, শুমারি অনুযায়ী তা বেড়ে দাঁড়ানোর কথা ছিল ৩০ কোটিতে। তাহলে দেশের ক্রমবর্ধমান এ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করল কে? আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের দৈত্য, না হয় দেশের মানুষ (স্বামী-স্ত্রী) গত ৮ বছর জৈবিক কার্যক্রম থেকে বিরত ছিল বা বিগত ৯৬ মাস ২৪ ঘণ্টা রোজাব্রত পালন করেছিল? বন্ধুটি এবার স্মিত হেসে ফোন রেখে দিলেন।  পরিশেষে নকল ও ভেজাল শব্দগুলোর যত্রতত্র ব্যবহার না করে বিকল্প হিসেবে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে না এমন শব্দ যেমন— মানহীন বা নিম্নমানের ওষুধ জাতীয় শব্দ ব্যবহারে সাধারণ মানুষ অহেতুক আতঙ্কিত ও বিভ্রান্ত হবেন না।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক

সর্বশেষ খবর