নিশ্চয়ই নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃজনে ও রাত-দিনের পালাক্রমে আগমন ও প্রস্থানে বহু নিদর্শন আছে ওইসব বুদ্ধিমানের জন্য— যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে (সর্বাবস্থায়) আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে (এবং তা লক্ষ্য করে বলে ওঠে)— হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি এসব উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেননি। আপনি অনর্থক কাজ থেকে পবিত্র। (সুরা আলে ইমরান : ১৯০-১৯১)
আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। আর আমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন আসমান, জমিন, আগুন, পানি, মাটি, বাতাস ইত্যাদি ছাড়াও লাখ লাখ মাখলুক। দুনিয়াতে যা কিছু আমরা মানুষের আবিষ্কার বলে মনে করি সেগুলোও মূলত আল্লাহতায়ালারই সৃষ্টি। কারণ তিনিই একমাত্র স্রষ্টা। তিনি ছাড়া আর কোনো সৃৃষ্টিকর্তা নেই। তিনিই কালের স্রষ্টা, কালের সব নবআবিষ্কারও তারই সৃষ্টির সহায়তায় সৃষ্ট।
পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, তিনিই সেই সত্তা, যিনি পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। (সুরা বাকারা : ২৯)এখানে এ বিষয়ের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে যে, মানুষ জগতের যা কিছু দ্বারা উপকার লাভ করে তা সবই আল্লাহতায়ালার দান। এর প্রত্যেকটি জিনিস আল্লাহতায়ালার তাওহিদ ও একত্বের সাক্ষ্য দেয়। এতদসত্ত্বেও তার সঙ্গে কুফরি কর্মপন্থা অবলম্বন করা কত বড়ই না অকৃতজ্ঞতা!
এখন প্রযুক্তির যুগ। প্রযুক্তির কল্যাণে গোটা বিশ্বই এখন একটি প্লাটফর্মে পরিণত হয়েছে। মুহূর্তেই নেওয়া যায় যে কোনো দেশের খবর। হাজার মাইল দূরে থেকেও প্রিয়জনের সঙ্গে ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমে দেখা করা যায়। পৃথিবীর তাবৎ আবিষ্কার, প্রযুক্তির এসব উন্নয়ন সবই মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ নেয়ামত। যার শুকরিয়া আদায় করা প্রতিটি বান্দার জন্য আবশ্যক। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর তবে তোমাদের (নেয়ামত) আরও বাড়িয়ে দেব। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর। (সুরা ইব্রাহিম : ৭)
শুকরিয়ার সর্বনিম্ন স্তর হলো, আল্লাহর নেয়ামতকে সঠিক স্থানে ও সঠিকভাবে ব্যবহার করা, আল্লাহর নাফরমানিতে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা।
গুগলের প্রতিষ্ঠাতা মি. ল্যারি পেইজ এবং সের্গেই ব্রিন তাদের কোম্পানির একটি মূলমন্ত্র ঠিক করেছেন, ‘ডোন্ট বি ইভিল’ যার অর্থ হলো, মন্দ হইয়ো না। তাদের এই মূলমন্ত্রটি প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি চূড়ান্ত দিকনির্দেশনাও বটে। এটি প্রযুক্তি ব্যবহারের দুটি শর্তের একটির সঙ্গে আংশিক মিলে যায়। প্রযুক্তিকে (আল্লাহর নেয়ামতকে) আল্লাহর নাফরমানি তথা কোনো মন্দ কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
আল্লাহর নেয়ামতের সঠিক ব্যবহারও শুকরিয়ার একটি স্তর। কিন্তু তাতে এতটাই মগ্ন হওয়া যাবে না যে নেয়ামতদাতাকেই ভুলিয়ে দেয়। (এটি প্রযুক্তি ব্যবহারের দ্বিতীয় শর্ত, যা মুফতি আজম মুফতি শফী রহ. তার গ্রন্থ ‘আলাতে জাদিদাকে শরয়ি আহকাম, পৃ. ১৫’ এ উল্লেখ করেছেন।)
মনে রাখতে হবে, প্রতিটি জিনিসেরই ভালো-খারাপ দিক রয়েছে। মানুষ চাইলে তাকে যে কোনো পথে ব্যবহার করতে পারে। প্রযুক্তিও তার ব্যতিক্রম নয়। এটিকে যেমন ইসলামের খেদমতে/দাওয়াতি কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। আবার খারাপ পথেও এটি ব্যবহার করা যায়। জানার বিষয় হলো, আমরা প্রযুক্তিকে কোন কাজে ব্যবহার করছি? আমরা যদি প্রযুক্তিকে ইসলাম প্রচারের কাজে লাগাই তাহলে সব ধরনের প্রযুক্তিই কল্যাণের মাধ্যম হবে। গা-ঢাকা দিয়ে পিছিয়ে থাকাই সব সমস্যার সমাধান নয়। সব নবী-রসুলই তাদের যুগে তৎকালীন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েছিলেন এবং মহান সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহতায়ালার বিধান প্রচার-প্রসার করেছেন। উম্মতকে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শিখিয়েছেন।
এ কারণেই হযরত ফকীহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমান (রহ.) তার জীবনের পড়ন্ত বিকালে এসে ইসলামী অর্থনীতি ও তথ্য-প্রযুক্তিতে ছাত্রদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। হয়তো তিনি অনুভব করেছিলেন যে, এ যুগে অর্থনীতি ও প্রযুক্তির সঙ্গে প্রতিটি মানুষই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত। কাজেই এর ইসলামী দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো লোকেরও ভীষণ প্রয়োজন।
আমাদের আলেম সমাজেরই দায়িত্ব, প্রযুক্তির এই দিকহারা জাহাজের পাল টেনে ধরার। মানুষকে তার সঠিক ব্যবহার শিক্ষা দেওয়া। ইসলামের খেদমতে প্রযুক্তিকে কীভাবে আরও শক্তিশালী করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করার। এখন মানুষ প্রযুক্তিনির্ভর। অফিস-আদালত, বইপুস্তক, দোকানপাট সবই এখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু প্রযুক্তির এই উৎকর্ষতা যেন আমাদের ধ্বংসের কারণ না হয়। আল্লাহর এই মহা নেয়ামতগুলো যাতে তার নাফরমানিতে ব্যবহার না হয়, সে ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং এই প্রযুক্তিকে আল্লাহর নির্দেশ মতে ব্যবহারের উপযোগী করা আমাদেরই দায়িত্ব।
পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, আমি পৃথিবীর সবকিছুকে পৃথিবীর জন্য শোভা করেছি, যাতে লোকদের পরীক্ষা করি যে, তাদের মধ্যে কে ভালো কাজ করে। (সুরা কাহাফ : ৭)
আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক।