শনিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

যে ভুল করেননি শেখ হাসিনা

আবু হেনা

যে ভুল করেননি শেখ হাসিনা

এদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনে দূরদর্শী, স্থিরবুদ্ধি, সাহসী এবং দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের পাশাপাশি ’৭৫-পরবর্তী দীর্ঘ ২০ বছর ধরে অনেক প্রতিকূলতার শিকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে রাজসম্মানে ভূষিত করে এর খ্যাতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে দিয়ে যে প্রজ্ঞা এবং বিচক্ষণতার পরিচয় আপনি দিয়েছেন তার জন্য আপনাকে অভিনন্দন। রাজনৈতিক পর্যায়ে বিশ্বাস, ভালোবাসা, সৎ সাহসের ঘাটতি আজ প্রকট এবং স্পষ্ট।  আজ রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক উভয় ক্ষেত্রেই পদ-পদবি নিয়ম-বিধিবিরুদ্ধ পদোন্নতির জন্য চলছে শকুনিসুলভ অসুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সর্বক্ষেত্রে আজ এক নিরঙ্কুশ নৈরাজ্য আর সর্বব্যাপী পৌরুষহীন সিদ্ধান্তহীনতা। এই দুঃসময়ে যখন সৎ, নিষ্ঠাবান, কর্ম-অন্তপ্রাণ মানুষগুলো দশচক্রে ভগবান হয়ে প্রতাপশালীদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে তখন ত্বরিত এবং আন্তরিকভাবে সঠিক ও সৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে দলে দায়িত্বশীল নেতৃত্ব নির্বাচন করে আপনি যে বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন তার জন্য ধন্যবাদ। এ কারণে শুধু বিদেশিরা কেন আমরাও আপনার প্রশংসা করি। আপনি দলীয় সংগঠনে একই পদে দুজন সাধারণ সম্পাদক নিয়োগ দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করতে পারতেন। সজীব ওয়াজেদ জয়কে কো-চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত করতে পারতেন। কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য সংখ্যা ৭৩ থেকে ২৫০ এ নিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু আপনি বঙ্গবন্ধু কন্যা, তাই অন্যেরা যা পারে, তা আপনি করতে পারেন না। এটাই আপনার বিশেষত্ব। অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনেই দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কমিটিগুলো গঠিত হয়ে গেছে। তারপর ক্রমান্বয়ে সংযোজন হচ্ছে।  শুক্রবার সভাপতিমণ্ডলীর সভাও আহ্বান করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এবং দলের গঠনতন্ত্র মোতাবেক তৃণমূল থেকে কমিটি গঠন করে নির্বাচনের মাধ্যমে কাউন্সিলর নির্বাচন করে কাউন্সিলর অধিবেশন অনুষ্ঠিত করেছেন। আগের কমিটিগুলো ভেঙে দিয়ে কাউন্সিলের মাধ্যমে সবার মতামত নিয়েই নতুন কমিটিগুলো গঠন করেছেন। কারণ কাউন্সিলের পর পুরনো কোনো কমিটিই গঠনতন্ত্র মতে বহাল থাকে না। দায়িত্ব পালনরত সাধারণ সম্পাদক পরবর্তী সাধারণ সম্পাদকের নাম প্রস্তাব করেছেন। আপনার নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়ে আপনি নতুন নেতা নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন। উত্তরাধিকার সূত্রে শীর্ষ নেতৃত্ব নির্ধারিত করার প্রথা নির্দ্বিধায় অগ্রাহ্য করে পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে অথবা কন্যা সায়মা ওয়াজেদকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত না করে আপনি এদেশের রাজনীতিতে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তা সবার জন্য অনুকরণীয়। প্রশংসা করি দেশের প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী প্রয়াত ড. ওয়াজেদের পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের। তিনি বলেছেন, তিনি প্রায়ই বিদেশে থাকেন তাই তার পক্ষে কোনো দায়িত্বশীল পদ নেওয়া ঠিক নয়।

আপনি তো প্রবল প্রতাপে রাজ্যপাট শাসন করছেন। আশপাশের সবাই আপনার অনুসারী অনেকেই অনুগ্রহপ্রার্থী, আজ্ঞাবহ। আপনি দয়া প্রদর্শন করে একই পদে বেশ কয়েকজন সাধারণ সম্পাদক করতে পারতেন, সিনিয়র সাধারণ সম্পাদকের পদ সৃষ্টি করতে পারতেন। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের মধ্যে একজনকে সিনিয়র সদস্য করতে পারতেন। কিন্তু আপনি জানেন একটি পদ মানে একটি দায়িত্ব, এর জবাবদিহিতা আছে। তাই শত চাপ, তোষামোদ উপেক্ষা করে আপনি থেকেছেন নির্মোহ-সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে। তাই আবারও অভিনন্দন।

কথায় আছে— সাধু পুরুষও যদি ক্ষুদ্র ব্যক্তি ও পারিবারিক স্বার্থে অন্ধ হয়ে মাস্তানকে বেছে নেন নিজের সহকর্মী হিসেবে, তাহলে তার সাধুতা, সততা, নিষ্ঠা সত্ত্বেও প্রতি সৃষ্টিতে তিনি বাঁদরই গড়বেন, নেতৃত্ব নয়।

 

 

দুর্দান্ত প্রতাপে রাষ্ট্র শাসন করে আপনি কোটি কোটি ক্ষুধার্ত, অপুষ্ট, আশ্রয়হীন, ভূমিহীন মানুষগুলোর কথা ভুলেননি। তারা নিরন্তর উন্নয়নের পাঁচালি শোনে কিন্তু তাদের ভাগ্য কোনো দিনই ফেরে না। আপনি সেবার মাধ্যমে মানুষের মন জয় করতে বলেছেন, ভূমিহীন, গৃহহীন, নিঃস্বদের তালিকা করতে বলেছেন। কিন্তু শুধু তালিকা নয়, এর জন্য প্রয়োজন একটি বিশাল, সাহসী আন্দোলন। আরও প্রয়োজন তৃণমূল পর্যায়ে যারা নেতৃত্ব দেবে তাদের কলুষমুক্ত, সেবাধর্মী অন্তর। এর জন্য দায়িত্ব দিতে হবে তাদের যারা জনগণের বিশ্বাসের যোগ্য। মনে রাখতে হবে, দেশ ও জাতির প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা ও বিশ্বাস উন্নয়নের পূর্বশর্ত। অযোগ্য, অনুপযুক্ত, ক্ষুদ্রহৃদয় এবং স্বার্থবাদী রাজনৈতিক নেতাকে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে বসিয়ে কেউই আমাদের মতো একটি পশ্চাত্পদ দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে পারে না। তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র, অনুন্নত রাষ্ট্র বাংলাদেশেও উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে অর্থনীতির তাত্ত্বিক নিগঢ়ের বাইরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। যদি তাতে এক বিশাল গণআন্দোলনের মাত্রা যোগ দেওয়া যায়। এ প্রচেষ্টার বিপুল আয়োজন আমরা করতে পারিনি। যারা রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে জনগণকে ভালোবাসতে জানে না, সেবা করতে জানে না, তাদের দিয়ে ব্যাপক ও স্থায়ী আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমরা উন্নয়নের কথা বলি যখন সাধারণ মানুষের অবস্থার আরও অবনতি হয়— তাই তারা না আমাদেরকে না উন্নয়নকে বিশ্বাস করে। সুবিচারের ললিত বাণী যখন তাদের নিরন্ন সন্তানের মুখে অন্ন জোগায় না, অন্যায়-অবিচারকে প্রতিরোধ করে না, তখন তারা আর কাউকে বিশ্বাস করে না।

ভালোবাসা আর বিশ্বাসের এ দুর্ভিক্ষের দিনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার আদেশ-সেবা দিয়ে জনগণের মন জয় করা, আর নতুন সাধারণ সম্পাদকের আহ্বান-নিজ আচরণকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা। এসবই দলকে সুসংগঠিত করার ঐকান্তিক ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। মস্তান, দুর্নীতিবাজদের রশি টেনে না ধরতে পারলে শুধু মিথ্যা হরিসংকীর্তনে দেশ ও জাতির কোনো উন্নতি হবে না। যেখানে মমত্ববোধ নেই, মতামতের মূল্য নেই, বিশ্বাস নেই, মরমি হৃদয় নেই, সেখানে সার্বিক অর্থবহ উন্নয়ন হবে না।

যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, মহাচীন যে আজকের দুনিয়ার প্রথম কাতারের শক্তি তার মূলে শুধু অর্থ সম্পদ নয় বরং তাদের মানবসম্পদ, জ্ঞান, শিক্ষা, সংগঠন এবং ব্যবস্থাপনা। মানবসম্পদ, জ্ঞান ও শিক্ষাকে অর্থসম্পদ থেকে পৃথক করে দেখে তাকে যথাযোগ্য মূল্যায়ন করতে হবে। নতুন কমিটিতে নতুন অর্থবিষয়ক সম্পাদক এবং শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদকের পরিচয় জানি না। দেশের অর্থ প্রশাসন, রাষ্ট্রের অর্ধেক প্রশাসনের সমান। শুধু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকেই এ বছর দুই লাখ তিন হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করতে হবে। অন্যথায় কেউ বেতন-ভাতা পাবে না। এ ছাড়া এই রাজস্ব বোর্ড দেশের সব আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের হিসাবরক্ষণ, অডিট, জাতীয় বাজেট প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন এই অর্থ মন্ত্রণালয়েরই দায়িত্ব। দলীয় সংগঠনের দায়িত্বে নামসর্বস্ব কাউকে না দিয়ে অর্থমন্ত্রীর বিদ্যাবুদ্ধি সমকক্ষ একজন ব্যক্তির মতো কাউকে দিলে তা হবে অর্থবহ। শিক্ষা, কৃষি ক্ষেত্রেও একই যোগ্যতা প্রযোজ্য। মাত্র কিছুকাল আগে চীনের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের জন্য যে বিশাল অর্থ সহায়তার অঙ্গীকার করেছেন তা কাজে লাগাতে হলে সবচেয়ে প্রয়োজন হবে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানসমৃদ্ধ প্রকৌশলী, কৃষিবিদ এবং চিকিৎসক। বিশ্বব্যাংক পুষ্টির জন্য যে অনুদান দিয়েছে তার সুফল পেতে হলে প্রয়োজন চিকিৎসক, কিন্তু সভাপতিমণ্ডলীর অথবা সম্পাদক মণ্ডলীতে এ ধরনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চিকিৎসক নেই।

১৯৭০-এ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি অধিবেশনের প্রাসঙ্গিক প্রস্তাবে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছিল : যেহেতু উন্নয়নের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে সব মানুষের জন্য অধিক মাত্রায় উন্নয়ন জীবনযাপনের সুযোগ পৌঁছে দেওয়া। সেহেতু শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, গৃহসংস্থান, সমাজকল্যাণ ও পরিবেশ সুরক্ষার ব্যবস্থাদির সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন অবশ্য প্রয়োজন। ১৯৭৪-এ সাধারণত উপেক্ষিত সমাজকল্যাণ বিভাগের আওতায় এক যুগোপযোগী কার্যক্রমের পত্তন ঘটেছিল। এর নাম ‘রুরাল সোস্যাল সার্ভিস’ বা গ্রামীণ সমাজসেবা প্রকল্প। এর প্রধান ও মূল উদ্দেশ্য ছিল উপেক্ষিত ও বঞ্চিত ভূমিহীন পুরুষ ও নারী এবং শিক্ষায়তন বহির্ভূত কিশোর ও তরুণদের সংগঠিত করে, তাদের বৃত্তিমূলক ও প্রাথমিক কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে রাষ্ট্র সমর্থিত স্বল্পসুদ বা সুদবিহীন ঋণদান করে উপার্জনক্ষম ও আত্মনির্ভরশীল করে তোলা। ১৯৭৪ সালের এ সমাজসেবা কার্যক্রমের মূল নির্যাসকে আত্মস্থ করে উপেক্ষিত, ভূমিহীন, বিত্তহীন পুরুষ ও দরিদ্র নারী সমাজের উন্নয়নে পরবর্তীকালে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব বর্তমানে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নোবেল খ্যাত গ্রামীণ ব্যাংক।

জাতীয় উন্নয়ন প্রচেষ্টার সার্থকতা ও সফলতার চাবিকাঠি সমাজকল্যাণ সাধন। বস্তুত ব্যাপক সামাজিক কল্যাণ আনাই হচ্ছে সব উন্নয়ন প্রয়াসের মূল উদ্দেশ্য। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক উন্নয়নমুখী, কল্যাণমূলক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ গড়ে তোলা, যা সম্ভব শুধু বিশেষজ্ঞ মানসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীদের সুসংগঠিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে। এর জন্য উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যদের নামের তালিকাটি দেখতে চাই। ওটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দেশে কর্মক্ষম নারী-পুরুষের সংখ্যা এখন ১০ কোটি ৫৬ লাখ। এদের কীভাবে কাজে লাগাবেন তা ভাবতে হবে। এটা করতে হবে বিজ্ঞ উপদেষ্টাদের। এ পথে অগ্রপথিক হিসেবে কাজ করবে এদেশের শিক্ষিত যুবসমাজ। তরুণদের মধ্যে যে বলিষ্ঠতা, যে শক্তি চিরদেদীপ্যমান তা সৃজনশীল ও স্বয়ংক্রিয় করে তুলতে হলে প্রজ্ঞা, নীতিবান, মর্যাদাশীল ব্যক্তিদের যথাযোগ্য দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন।  মূলত মানব সমাজ উন্নয়নই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত ও পরিচালিত নতুন সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য হতে হবে। শিক্ষাকে জীবনভিত্তিক ও জীবনমুখী রূপ দিতে হবে, যাতে শিক্ষাপ্রাপ্ত নাগরিকরা বাস্তব সামাজিক অর্থনৈতিক চাহিদা মিটিয়ে নিজের কর্মসংস্থানসহ জাতীয় উন্নয়নে অংশ নিতে পারে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর