শিরোনাম
রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

মনোযোগের অভাবসহ হঠাৎ রেগে যাওয়া

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

মনোযোগের অভাবসহ হঠাৎ রেগে যাওয়া

২০১১ সালের ২৫ জুলাই পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে পাগল হিসেবে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে, কিন্তু বেড়ে গেছে ASD অর্থাৎ অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারের রোগীর সংখ্যা। অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার অনেকগুলো সমন্বিত রোগের লক্ষণ এবং রোগীর লক্ষণ ভিন্নতর। এদের মধ্যে একটি হলো ADHD. বলছিলাম পাগলের সংখ্যা কমে গেছে।  আসলে আগে অটিস্টিক বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারের সব রোগীকেও পাগল বলে চিহ্নিত করা হতো। জনসচেতনতা, রোগ সম্বন্ধে সচেতনতা, রোগ নির্ণয়ে দক্ষতা, সর্বোপরি মানুষের শিক্ষার অগ্রগতি সব মিলিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের রোগীরা যে পাগল নয় তা সম্পূর্ণভাবে আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে। মানুষের ব্যবহার, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ, বিভিন্ন রোগের প্রভাবে বিভিন্ন জিনিসের প্রতি আকর্ষণ, যেমন বস্ত্র ত্যাগ করা, পানিতে ডুবে থাকে, খাবার ছিটিয়ে ফেলে দেওয়া, ক্ষুধার্ত না হওয়া অথবা মেটাবলিক ডিজঅর্ডারের জন্য বিভিন্ন রকম অসংলগ্ন আচরণ করলেই বলা হতো তাকে জিনে ধরেছে বা সে পাগল হয়ে গেছে। বর্তমানে অবশ্য জিন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হুজুরদের জিন চালান, বাটি চালানে উপার্জন কমে গেছে। সোজা কথা ওই ব্যবসাও বিলুপ্তির পথে। কিন্তু প্রতারকদের দ্বারা চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনো প্রতারিত হচ্ছে।

বলছিলাম ADHD-এর কথা। আমরা জানি অটিস্টিক শিশুরা একে অন্যের মতো হয় না। একেকজন একটি স্বতন্ত্র গুণের অধিকারী হয় এবং একেকজনের মধ্যে একেক ধরনের লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। ইদানীং ADHD অর্থাৎ মনোযোগের অভাবসহ হঠাৎ রেগে যাওয়া রোগীর সংখ্যা রোগ নিরূপণের জ্ঞানের জন্য অনেক বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সিঙ্গাপুরের তিনটি প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ REACH (Response, Early Intervention, Assessment in Community Health) IMH (Institute of Mental Health) এবং NUH (National University Hospital) প্রত্যেকেই নতুন নতুন ADHD-এর রোগী শনাক্ত করে চলেছে।

সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের সাইকোলজিক্যাল মেডিসিনের John Wong-এর পরিসংখ্যানে বাচ্চাদের মধ্যে ৫-৮% এবং বড়দের মধ্যে ২-৩% এই রোগে ভুগে থাকেন। ADHD একটা স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যা যা যেসব ব্যক্তির Anxiety বা দুশ্চিন্তা এবং learning difficulties অর্থাৎ লেখাপড়া মুখস্থ করা বা মনে রাখতে অপারগতা থাকে তাদেরই বেশি হয়ে থাকে। স্কুলগামী ছাত্রদের মধ্যে এটা হলো একটা সর্বোচ্চ মানসিক সমস্যা যা ৬ থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত ছাত্রদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। যেই তিনটি দিকের বিশেষ উত্তেজনা তাদের মধ্যে দেখা যায় তা হলো আবেগ প্রবণতা (বসড়ঃরড়হধষ), বন্ধুত্ব বা সামাজিকতায় দুর্বল (Socialization)  এবং হঠাৎ করে উত্তেজিত হওয়া (behavioral issues) বা কেঁদে ফেলা।

 

 

এসব বাচ্চার কেউ কেউ বলে ফেলেন ‘আমি দুষ্ট নই, আমার নিজের ওপর আমার কিছু নিয়ন্ত্রণ নেই, আমার ব্রেইন আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।’ আবার কেউ কেউ বলেন, ‘আমি আবেগপ্রবণ’। কেউ কেউ বলেন, ‘মা-বাবা, শিক্ষক-আত্মীয় কেউ আমার মনের কথা বুঝতে পারে না বা চাহিদা মিটিয়ে দিতে চায় না। আমি কিন্তু অন্যদের মতো মূল্যবান কিছুই চাই না।’ যখন অসুখটি সঠিকভাবে নিরূপিত হয় তখন শিক্ষক এবং পিতা-মাতার উচিত হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করা এবং মেনে নেওয়া যে শিশুটির আচার বা ব্যবহারের যে অসামঞ্জস্য, দুর্বলতা বা অসংলগ্নতা তার ইচ্ছাকৃত নয় এবং স্বতঃস্ফূর্ত নয়। কোনো কোনো শিশু মনঃস্তত্ত্ববিদের মতে, এসব বাচ্চা disorganized (অগোছালো) ঘন ঘন ভুলে যায় (forgetful) এবং শিক্ষকদের অনেক আদেশ এবং নির্দেশ মানতে পারে না এবং মানসিকভাবে মানতে বাধ্য থাকে না। তাদের ব্যবহার (Impulsive) এবং আচরণ সংযতহীন। এই ADHD রোগীরা সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে Inattentive (অমনোযোগী), Hyperactive – (অতিমাত্রায় অস্বাভাবিক আচরণ), Impulsive-আবেগপ্রবণ অথবা এই দুয়ের সংমিশ্রণ।)

এ পর্যন্ত গবেষণায় যা পাওয়া গেছে এতে দেখা গেছে মস্তিষ্কের যেই অংশটুকু মনোযোগ নিয়ন্ত্রণ করে (attention control) এবং আচরণ বিধিকে সংযত রাখে সেই অংশটুকুর পরিপক্বতা লাভে বিলম্বিত হয়। এদের মধ্যে যারা অমনোযোগী কিন্তু উদ্ধত আচরণ করে না। তাদের মধ্যে অনেক প্রতিভা লুকায়িত থাকে। এ ধরনের বাচ্চার খুব ভালোভাবেই চিকিৎসা করা যায়। সেক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের ওষুধের প্রয়োজন হয় না। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এবং আচার ব্যবহারের সুস্পষ্ট ও সঠিক থেরাপি বা চিকিৎসাই যথেষ্ট। (Behavioral therapy & Environmental adjustment)

পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর অর্থ হলো, তাদের সঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছাতে সাহায্য করা, শিক্ষকের পাশে প্রথম সারিতে বসতে দেওয়া, জানালা এবং দরজার কাছ থেকে দূরে রাখা অথবা তার পাশের জানালা ও দরজা বন্ধ করে দেওয়া। অধিকতর যত্ন এবং মনোযোগ আকর্ষণ করানো অথবা যে কাজের প্রতি তার ভীষণ ঝোঁক আছে, সেদিকে তাকে একাগ্রচিত্তে কাজ করা বা মনোনিবেশ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। চিকিৎসক ও পরিবারের সার্বিক সহযোগিতা তাদের ভুল পথে বা ডিপ্রেশন, অতিমাত্রায় সংবেদনশীল এবং আসক্তি থেকে দূরে রাখতে পারে।

আমি ছাত্ররাজনীতির সুবাদে আমার এক রাজনৈতিক নেতাকে চিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের একটি সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরায় উনার সঙ্গে আরও ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম, উনাকে দেখেছি হঠাৎ করে রেগে যেতেন, হাতে যা কিছুই থাকত ছুড়ে ফেলে দিতেন, এমনকি কাগজের টাকা হাতে থাকলে ছিঁড়ে ফেলতেন। পরে ছাত্ররাজনীতিতে উনি ছাত্রলীগের সর্বোচ্চ পদে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতীয় রাজনীতিতে অনেক ভূমিকা রেখেছেন। উনার আচরণ এখন যদি বিবেচনা করি তাহলে মনে হয় উনিও ADHD-এর লক্ষণ সমন্বিত একজন রাজনৈতিক নেতা। কিছু দিন আগে তিনি অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমরা রাজনীতিবিদরা দেশটা ধ্বংস করেছি, তোমরা ডাক্তাররা চিকিৎসা ব্যবস্থা ধ্বংস করেছ।’ বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে ADHD-এর লক্ষণগুলো অনেক কমে যায় এবং জীবনের শেষ দিকে উনারা একজন সাফল্যমণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হন। এই রোগ নির্ণয়ের পরে অভিভাবক এবং শিক্ষকরা সহানুভূতিশীল এবং বাস্তববাদী হতে হবে এবং বুঝতে হবে রোগীর আচরণ ইচ্ছাকৃত এবং স্বতঃস্ফূর্ত নয়।

সবচেয়ে সুখবর হলো ADHD রোগীদের অনেকেই সার্বিক যত্ন পেলে লেখাপড়াসহ, যে কোনো কিছুর প্রতি আকৃষ্ট হলে, তারা মহৎ কিছু অর্জন করে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারে। আমেরিকান সাঁতারু মাইকেল ফেলপস অলিম্পিকের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পদক জয়ের যে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন তিনিও একজন ADHD আক্রান্ত দেব শিশু (Gifted child) (সূত্র : The straight times, July 12, 2016) ২০১৬-এর রিও অলিম্পিকে আমেরিকান জিমন্যাস্ট সাইমন বিলসকে রাশিয়ান হ্যাকার কর্তৃক এনাবলিক ড্রাগ নেওয়ার যে তথ্য দিয়েছে ওয়ার্ল্ড এন্টি ডেপিং এজেন্সি (WADA) একে শুধু অনৈতিক বলে আখ্যায়িত করেনি বরং একজন অ্যাথলেটের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত গোপনীয়তা ভঙ্গের জন্য অভিযুক্ত করেছে। আসলে BILES একজন ADHD-এর রোগী যার জন্য সে শুধু Ritalin গ্রহণ করত দীর্ঘদিন ধরে। সেও ৪টি পদক জয় করে প্রমাণ করেছে ADHD আক্রান্ত শিশু, যুবক এবং যুবতীরা পর্যাপ্ত সুযোগ পেলে অনেক উচ্চতায় আরোহণ করতে পারে।

আমার কথা ‘অটিজম নিয়ে আমাদের শুরু সবার শেষে। ২৫ জুলাই, ২০১১ থেকে অদ্যাবধি আমাদের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। এই শিশুরা আমাদের স্বপ্ন ও সন্তান। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। হয়তো, তাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে একজন আইনস্টাইন। তারা কোথায় যেন একটু খাটো, অপারগ। দেহ-মন এবং মস্তিষ্কে তেমন শক্তপোক্ত নয়। বহুজনের ভালোবাসার কল্যাণ স্পর্শ একান্ত প্রয়োজন।  কিন্তু তাদের যদি না চিনি, না জানি, তাহলে কী করে ভালোবাসব, পরিচর্যার হাত বাড়িয়ে দেব। এখানেই আরও বেশি জরুরি ব্যক্তিগতভাবে, পারিবারিকভাবে এবং সামাজিকভাবে তাকে এবং তার পরিবারকে আরও কাছে টেনে আনার।  তাহলেই সবাই বিনা সুতোর মালায় গেঁথে থাকব।’

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর