শিরোনাম
সোমবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা

জাসদ : সম্ভাবনার সব দরজা খুলে দাও

শরীফ নুরুল আম্বিয়া

জাসদ : সম্ভাবনার সব দরজা খুলে দাও

জাসদ প্রতিষ্ঠার ৪৪তম বার্ষিকীতে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি সব সাথীকে, যারা সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যমে জনগণের মুক্তির স্বপ্নে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি কর্নেল (অব.) আবু তাহের বীরউত্তম, কাজী আরেফ আহমেদ, ডা. মিলন, মারফত আলী, লোকমান হোসেন, অ্যাড. ইয়াকুব আলী, বাদল বিশ্বাস, মোশাররফ হোসেন, ঈমান আলী, জিলানী, শাজাহান সিরাজ, রশিদ, রবিউল, রোকন, জাহাঙ্গিরসহ হাজারো শহীদকে।

অপ্রত্যাশিত ও কষ্টকর হলেও এটা সত্য যে, জাসদ দ্বাদশ সম্মেলনে দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। উপদলীয়, অস্বচ্ছ, অগণতান্ত্রিক ও ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতির নেতৃত্বে চলছে একটি ধারা, যারা মুখে এবং আদলে বিপ্লবী ভাব দেখিয়ে রাজনীতিতে কোনো এক অদৃশ্য শক্তির এজেন্ডা নিয়ে ব্যস্ত। ব্যক্তিগত স্বার্থ, রোমান্টিকতা, অহমিকা, ক্ষমতা-মন্ত্রিত্ব ও বিত্ত-বৈভবের প্রতি সীমাহীন মোহ তাদের পরিচালিত করছে। দলের ওপর বিভক্তি চাপিয়ে দেওয়ার সময় দেশ, দল ও দীর্ঘ সংগ্রামে বিপর্যস্ত কর্মীবাহিনীর কথা একবারও তাদের মনে হয়নি। অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে দলে বিরাজমান ভিন্ন মতগুলো নির্মূল করার পথ অবলম্বন করা হলো, অর্থবহ ভারসাম্যপূর্ণ নেতৃত্ব গড়ে তুলতে অস্বীকার করা হলো। ফলে তাদের বিরুদ্ধে কাউন্সিলররা বিদ্রোহ ঘোষণা করে কাউন্সিল অধিবেশনেই। মন্ত্রিত্ব রক্ষার মোহে লাগাতারভাবে সংসদের ভিতরে-বাইরে দলীয় স্বাতন্ত্র্য-সম্মান ও আত্মমর্যাদা বিসর্জন দেওয়া হতে থাকল। ইনু সাহেবের দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা, রহস্যজনক অপতত্পরতা ও দৃষ্টিকটু আস্ফাালনের কারণে দলের সর্বস্তরে উদ্বেগ ও অসন্তোষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। যার অনিবার্য পরিণতিতে সারা দেশে জাসদের অভ্যন্তরে সর্বাত্মক বিদ্রোহ সঞ্চারিত হলো। বিভক্তির পরও কর্মী এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে ঐক্যের দাবি ছিল প্রচণ্ড। এই দাবির প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে হীতাকাঙ্ক্ষীদের পক্ষ থেকে ঐক্যের পক্ষে নানা প্রচেষ্টা নিলেও হাসানুল হক ইনুর কপট আচরণ ও অরাজনৈতিক তত্পরতার কারণে সেই প্রচেষ্টা সফলতা পেল না। আসলে ইনু চেয়েছিলেন তার রহস্যঘেরা এজেন্ডাধর্মী নিশাচর কর্মকাণ্ডকে শর্তহীনভাবে সমর্থন করবে এমন একটি তস্করের দল। সুতরাং এ কথা বলতে হয় যে, তোষামোদকারী বাহিনী ও তস্করের দলের সঙ্গে জাসদের রাজনীতির দূরত্ব যোজন যোজন।

৪৪ বছরের ইতিহাসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সংগঠনের অভ্যন্তরে সক্রিয় অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তিকে সমন্বিত করে নেতা ও কর্মীরা বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দল গঠনের পর ৭৩-এর নির্বাচন করলেও গণতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার না করা, তদানীন্তন সরকারের অভ্যন্তরে সক্রিয় থাকা দক্ষিণপন্থি ফ্যাসিবাদী চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে গণবাহিনী গঠন, অভ্যুত্থানের জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ গ্রহণ না করা, ’৮৬ সালে ১৫ দল ভেঙে ৫ দলীয় বাম জোট গঠনের মাধ্যমে পুনর্জাগরিত জাসদকে জনবিচ্ছিন্ন করা, সমাজ পরিবর্তনের স্তর হিসেবে বিশ্ববাপী সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় আমলে না নেওয়া, উপর্যুপরি সংসদীয় নির্বাচনে ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা পশ্চাতে রেখে জাসদ কর্মীরা কোনো ব্যক্তিবিশেষকে তুষ্ট করার জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কারও ব্যক্তিগত অভিলাষ ও স্বার্থে কর্মীরা নিজের জীবন বিসর্জন দিতে পারে না। বর্তমানে জাসদের নামে যিনি মন্ত্রিসভায় আছেন, তিনি কোনোভাবেই জাসদ রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করেন না।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিভক্তি প্রাসঙ্গিকতায় বলার মতো অনেক কিছুই রয়েছে। এখন আদর্শগত বিষয়, চলমান রাজনীতি ও আমাদের কাজ নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। উপর্যুপরি ভাঙন কোনো দলের জন্য কল্যাণকর নয়। এতে জনগণ বিভ্রান্ত হয়, কর্মীরা হতাশ হয়। সমাজতন্ত্রের সনাতনী ধারার রুদ্ধ দরজা খুলে দিতে হবে। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা করতে হবে। সাম্প্রদায়িকতা, সামরিক শাসকদের অপছায়া এবং জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে জনগণের সেবক হিসেবে সমৃদ্ধ জীবন ও দেশ নির্মাণে সংগ্রাম করতে হবে।

বৈষম্যহীন সমৃদ্ধ সমাজ নির্মাণই জাসদের আদর্শ। গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতা এই সমাজের ভিত্তি ও চালিকাশক্তি। স্বাধীনতা-উত্তরকালে জাসদ গঠনের প্রথম যুগে, তদানীন্তন বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমরা যেভাবে ওই আদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিলাম তা সফল হয়নি। ওই সময়ের রাজনীতিতে ভুল-ত্রুটি ছিল, অস্থিরতা ও রোমান্টিসিজম ছিল। তবে আমাদের সাহস, দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে সীমাহীন আত্মত্যাগের কমতি ছিল না।

১৪-দলীয় ঐক্যজোট যেভাবে গড়ে উঠেছিল তাতে জাসদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে এবং জাসদ এখনো ১৪-দলীয় ধারাকে শক্তিশালী ও বিস্তৃত করতে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। ১৪ দল ও মহাজোট সরকারের নেতৃত্বে ইতিমধ্যে সংবিধানের (৭২-এর সংবিধান) মূলনীতি ফিরে এসেছে, সাংবিধানিকভাবে সামরিক শাসনকে বন্দী করা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক আদালতের কিছু রায় কার্যকর করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের মধ্য দিয়ে অপরাধের দায় মুক্তির সংস্কৃতি থেকে জাতি মুক্ত হয়েছে। ধর্মীয় জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের দমন করে বিশ্বদরবারে কার্যকর শান্তির শক্তি হিসেবে নিজেদের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে। এহেন পরিস্থিতিতে জাসদ ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে, যেখানে রাজনীতিতে কার্যত চালকের আসনে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর একটি কার্যকর গণঐক্য ও স্থিতিশীল আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলাই জাসদের লক্ষ্য।

লেখক : সভাপতি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ

সর্বশেষ খবর