মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে অভিনন্দন

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে অভিনন্দন

আলোর পর অন্ধকার, তারপর আবার আলো। পরম দয়াময় তাঁর পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘রাত দিনকে দিন রাতকে অতিক্রম করতে পারে না।’ সারা দিনই মনটা ছিল খারাপ। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না। দুপুরে আউলিয়াবাদ বাজার থেকে তয়কায় বাড়ি ফিরে গাছ কাটতে গিয়ে চাপা পড়ে আমাদের প্রিয় বাদশা পরপারে চলে গেছে। কত স্মৃতি বাদশাকে নিয়ে। স্বাধীনতার আগে ময়েজ সরকারের ছেলে হানিফ আমার ছায়া ছিল। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী কালিহাতীতে রাজনীতি করতেন, এমপি হতেন। হানিফ বড় ভাইয়ের সঙ্গে থাকত। বীর বাসুন্দা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানও হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু বাদশা হানিফের চেয়ে একটু ছোট। ওদের পাশাপাশি বাড়ি। কোনো দিন ছেড়ে যায়নি। এক বছরও হয়নি ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। কী যত্ন করে যে খাইয়েছিল। পারখী, পূর্বাসিন্দা, নাগবাড়ী ইউনিয়নের অনেক নেতা-কর্মী সেদিন ছিল। যখন ডেকেছি তখনই পাগলের মতো ছুটে আসত। কস্তূরীপাড়া বিলের মাছ, বাড়ির পালানের শাক, গাছের লাউ-কুমড়া, শুঁটকি মাছ, চিকন চাল কী নিয়ে সে পাগলামি করেনি। রক্তের বন্ধন না থাকলেও মামা বলে ডাকত। আপন ভাগ্নেরা কেউ লন্ডনে, কেউ কানাডা আবার কেউ আমেরিকায়। পর যে আপন হয়, আর হলে আপনরা পিছে পড়ে লক্ষ যোজন দূরে তার প্রমাণ বাদশা। হঠাৎ ওর মৃত্যুর সংবাদ কিছুটা এলোমেলো করে দিয়েছে।

চাচাশ্বশুর আবদুল আজিজ কোরাইয়েশী এক সপ্তাহ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো-সায়েন্সেসে ভর্তি। জ্ঞান আছে চেতনা নেই। স্ত্রী নাসরীন তার কাছে সব সময় ছোটাছুটি করছে। তাই বাড়িতে খুব একটা শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো-সায়েন্সেসের প্রাণপুরুষ ডা. দীন মোহাম্মদ কদিন আগে বিদেশ গেছেন। সৌভাগ্যবশত যাওয়ার আগে তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। তিনিই ভর্তি করে গেছেন। ভর্তির পর কোনো উন্নতি-অবনতি হয়নি। ২ তারিখ তিনি এলে তার দেখার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ভারত তথা এশিয়ার বিখ্যাত চিকিৎসক বিধান রায়কে দেখিনি। কিন্তু ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ডা. দীন মোহাম্মদকে বিধান রায়ের মতোই মনে হয়। কেউ যথার্থ বড় হলে সে নিজেকে নিয়ে ভাবে না। সে সবাইকে নিয়ে ভাবে। তার ব্যবহার হয় মহৎ মানুষের মতো। সে শুধু সেবাই করে, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে না। দীন মোহাম্মদ, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, প্রাণ গোপাল এরা সেই পর্যায়ের মানুষ। এমন মানুষ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যখন লিখছি কুশিমণি টিচারের কাছে পড়ছে, বেগম হাসপাতালে। কেন যেন কিছুই ভালো লাগছে না। কবে একদিন এমনি হঠাৎ করে চলে যাব। এই আসা-যাওয়ার দুনিয়ায় সময় এলে যেতে হবে। অমর কোথা কে কবে— কিন্তু কেউ মনে রাখি না। কদিন আর হবে ছয়-সাত দিন আগেও বাদশাকে দেখেছি। গ্রামের বাড়ি ছাতিহাটি যতবার গিয়েছি বাড়ির পাশের কেউ কেউ না এলেও তিন কিলোমিটার দূর থেকে ছেলে নিয়ে বাদশা ঠিকই এসেছে। আর সে আসবে না, তাকে আর দেখব না— এটাই বড় কষ্টের।

কষ্ট বুকে নিয়ে বসে ছিলাম। সেই সকাল থেকে ভাবছি লিখব লিখব কিন্তু ইচ্ছা করছিল না। সাধারণত আমি খুব একটা খেলাধুলা দেখি না। ইংল্যান্ড-বাংলাদেশ ক্রিকেট হচ্ছিল। মাঝে মাঝে বাংলাদেশের খেলা দেখে উৎসাহিত যেমন হই বিক্ষুব্ধও হই তার চেয়ে বেশি। মাঝেসাঝে বাংলাদেশ কী অসাধ্যই না সাধন করে। আবার ৪ বলে ৩ রানও করতে পারে না। ইংল্যান্ডের সঙ্গে টেস্টেও দেখছি ভালো ব্যাটসম্যান কেউ চলে গেলেই যেন ঝড় আসে। খড়কুটোর মতো সবাইকে উড়িয়ে নেয়। এবার টেস্টে প্রথম এবং দ্বিতীয় ইনিংসে প্রায় তেমনটাই হয়েছে। শনিবার শেষ বলে ৩ নম্বর উইকেট যাওয়ার কোনো মানে হয়? নিশ্চয়ই ক্রিকেট এক অনিশ্চয়তার খেলা। তাই বলে অত অনিশ্চয়তা, কেউ মেনে নেবে না। রবিবারেও প্রথম দিকটা কী অসাধারণই না খেলছিল। হঠাৎ কী তুফান এলো সব খড়কুটোর মতো উড়িয়ে নিল। তার পরও সবার আশা ছিল ভালো একটা কিছু হতে পারে। কিন্তু যখন দেখলাম ১০০ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের কোনো উইকেট পড়েনি, পুরো দুই দিন বাকি; তখন সত্যিই খুব চিন্তায় ছিলাম। বলতে গেলে আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। হঠাৎই ঝড় উঠল, মেহেদী-সাকিবের ঝড়। ১০ উইকেট দুজনে নিয়ে নিল। মুহূর্তে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল ইংল্যান্ড দল।

ব্রিটিশ ভারতে ফুটবলে মোহনবাগানের কাছে ইংরেজরা প্রথম হেরেছিল। তখন আমার নানা বানিয়ারার কালু খাঁ মোহনবাগানে খেলতেন। যদিও কলকাতায় মোহনবাগান-ইস্ট বেঙ্গলের খেলা হলে এখনো তিন দিন আগে থেকে কলকাতা ভাগ হয়ে যায়। দুই পক্ষের সমর্থকরা খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয়। কেউ গঙ্গায় স্নান করে তুলসীতলায় পুজো দেয়, কেউ যায় কালীঘাটে। সর্বশেষ ক্রিকেটে বাংলাদেশের কাছে ইংল্যান্ডের পরাজয় খুবই গৌরবের। সঙ্গে সঙ্গে এটুকুও বলব, সামান্য ধৈর্য ধরলেই যেখানে সম্মান আর জয় পদচুম্বন করে, সেখানে মাঝেসাঝে খামখেয়ালি কেন? একটু ধীরস্থির হতে দোষ কোথায়? দেশবাসীর পক্ষ থেকে ক্রিকেট দলকে হৃদয় নিংড়ানো আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। পরম করুণাময় আল্লাহ আমাদের দলকে আরও আরও বিজয়ী করুন। এক সপ্তাহ হলো বাংলাদেশের প্রাচীন দল আওয়ামী লীগের ২০তম সম্মেলন হলো। চোখ-ধাঁধানো জাঁকজমকপূর্ণ সম্মেলন। কাজী সিরাজের লেখায় দেখলাম সম্মেলনের কিছু পদ-পদবি কাউন্সিলররা নির্বাচন করেছেন এজন্য তিনি সাধুবাদ জানিয়েছেন। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো— সে অর্থে তার কথা ঠিক। কোনো দিনই যখন কোনো আলোচনা হয় না, কোনো মতামত নেওয়া হয় না সেখানে এবার আওয়ামী লীগের সম্মেলনে যা হয়েছে যথার্থ প্রশংসার হয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই তার দলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বর্তমান এশিয়ায় নিজের দলে অমন নিরঙ্কুশ জনপ্রিয় অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা বা নেত্রী আর কেউ নেই। এ ক্ষেত্রে তার পুনর্নির্বাচন ছিল সবার জানা। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও যেহেতু বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক নিজেই জনাব ওবায়দুল কাদেরের নাম প্রস্তাব করেছেন, সেহেতু এ ক্ষেত্রে কারও অন্য কিছু ভাবার সুযোগ ছিল না। কিন্তু তারপর? প্রেসিডিয়ামের সদস্য অন্য কাউকে দিয়ে একের পর এক প্রস্তাব করালে সেটাই হতো অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। বর্তমান অবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কারও নাম উচ্চারণ করলে আওয়ামী লীগে সমর্থন না করার মতো কেউ আছে? সে যাক। অন্তত বিএনপির চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। বিএনপি যা এক বছরে পারেনি আওয়ামী লীগ তা এক সপ্তাহে করেছে। এজন্য অবশ্যই তাদের সাধুবাদ জানাতে হয়। তবে শুধু সভানেত্রী যেভাবে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের নাম নিয়েছেন সম্মেলনের কোনো কাগজপত্রে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না— সেটাই একটা ভাবনার ব্যাপার। জননেত্রী যেভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে হুজুর মওলানা ভাসানী এবং জননেতা শামসুল হকের নাম করেছেন দলীয় দলিল-দস্তাবেজে ওইভাবে শ্রদ্ধার সঙ্গে তাদের নাম লেখা হলে সেটাই সঠিক হতো।

এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দেশ এবং জাতি বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কতটা কী পেল বলতে পারব না। কিন্তু সবার আশা ছিল আরও অনেক বেশি। নেতানেত্রীরা যে যাই ভাবুন, এখনো আওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগী নেতা-কর্মী সকাল-বিকাল আসে। আর কিছু না হোক আত্মতৃপ্তির জন্য আসে, দেখা এবং মেলামেশা করে। সম্মেলন-ফেরত বেশকিছু কাউন্সিলর, ডেলিগেট এবং সমর্থকের অভিযোগ-অনুযোগ ছিল— দারোগা, পুলিশ, ওসি, ডিসিদের অহংকারে চলা যায় না। তারাই নাকি আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে, টিকিয়ে রেখেছে। দলীয় কর্মীদের কোনো ভূমিকা নেই। জানি না কথাটা কতটা সত্য। তবে গত বছর কালিহাতীতে সরকারদলীয় কিছু গুণ্ডার সন্তানের দ্বারা মায়ের সম্ভ্রম নষ্টের চেষ্টায় মানুষ ফুঁসে উঠলে পুলিশ সেখানে নির্বিচারে গুলি চালায়। চারজন নিহত ও ৭০-৮০ জন আহত হন। যারা ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুম ছাড়া গুলি চালিয়েছিল তারা দম্ভ করেছিল তাদের আবার কী হবে, তারাই তো সরকার টিকিয়ে রেখেছে। সরকার এবং সরকারি দলের নেতানেত্রীরা নিশ্চয়ই সাফল্যের কথা চিন্তা করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতেই পারেন। কিন্তু তারা কেন যেন আমজনতার আস্থা অর্জন করতে পারছেন না। রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড প্রকৃত রাজনৈতিক হওয়া চাই। কিন্তু কী কারণে যেন রাজনৈতিক দলে রাজনীতি নেই, আমলাতন্ত্রের প্রভাব পড়েছে। শুনছি সরকার থেকে দল আলাদা করা হবে— এটাই যথার্থ কাজ। সরকার আর দল এক হয়ে গেলে কোনো রাজনীতি থাকে না, মানুষের সম্মান থাকে না। ডিসি, এসপি যদি জেলায় সরকারদলীয় সভাপতি-সেক্রেটারি হন তাহলে দলীয় নেতা-কর্মীদের আর কীই বা করার থাকে? আমরা চাই মানুষের সম্মান, মানমর্যাদা, নিরাপত্তা। কেউ যেন লাগামহীন হতে না পারে। তা যদি হয় তাহলে এর চেয়ে আশার কথা আর কী হতে পারে। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছিলাম। অভিনন্দনের জবাব পাওয়া যাবে তেমনটা আশা করি না। কারণ আমাদের দেশে কাউকে টেলিফোন করলে তার কাছ থেকে ফিরতি টেলিফোন, চিঠি লিখলে উত্তর— এসব আমাদের কৃষ্টি-সভ্যতার বাইরে চলে গেছে। তিন-চার বছর আগে কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধীকে কী কারণে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। ১৫-২০ অথবা এক মাস পর তার উত্তর এসেছিল। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে যতবার চিঠি দিয়েছি উত্তর পেয়েছি। ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জিকে চিঠিপত্র দিলে উত্তর পাওয়া যায়। আমাদের দেশে তেমন রেওয়াজ বা নজির নেই।

আওয়ামী লীগের সম্মেলনের দুই দিন পর সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে অভিনন্দন জানাতে ফোন করেছিলাম। জনাব ওবায়দুল কাদেরকে সব সময় ফোন ধরতে দেখতাম। হঠাৎ না পেলে তিনি ফিরতি ফোন করতেন। কোনো দিনই এসবের ব্যত্যয় হয়নি। মনে হয় খুবই ব্যস্ততার জন্য তাকে পাইনি। যদিও সেদিন যিনি ফোন ধরেছিলেন তিনি বলেছিলেন, ‘স্যার নামাজে আছেন। নামাজ শেষে ফোন দেবেন।’ অপেক্ষায় আছি অভিনন্দন জানাতে। আমরা যে তার দলের না, বাইরের। আমাদের অভিনন্দন আর দলের অভিনন্দন এক নয়। তবুও আশা করি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য স্থাপনে আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব সফলকাম হবেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সব ভুলত্রুটি ক্ষমা করে আমাদের প্রিয় বাদশাকে বেহেশতবাসী করুন— আমিন।

লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর