শুক্রবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সবাই একবার ভেবে দেখুন

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)

সবাই একবার ভেবে দেখুন

রাজধানী ঢাকাকে বলা হয় যানজটের নগরী। অচল নগরী হিসেবেও অভিহিত করা হয় কখনো কখনো। দুনিয়ার যেসব নগরীকে বসবাসের অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয় সে তালিকায় প্রথম দিকে রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানীর নাম। সন্দেহ নেই রাজধানী ঢাকার এই নেতিবাচক পরিচিতি জাতীয় লজ্জার ঘটনা।  যারা ক্ষমতায় আছেন, দেশের কাণ্ডারি যারা তাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এ লজ্জা থেকে জাতিকে রক্ষা করা। কিন্তু সে কর্তব্য তারা কতটা পালন করছেন তা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। রাজধানী ঢাকা প্রায় অচল ও স্থবির হয়ে ওঠে নেতানেত্রীদের বিদেশ সফর থেকে ফেরার সময় সংবর্ধনা দান ও রাজপথে আহূত সমাবেশকে কেন্দ্র করে।

আমাদের দেশের এ যাবৎ কালের সব সরকার প্রধান মানবকল্যাণে কাজ করে দেশে-বিদেশে যেমন খ্যাতি অর্জন করেছেন তেমন বিশ্ব দরবার থেকে অনেক পুরস্কার বয়ে এনে বঙ্গভবনের তোসাখানার সৌন্দর্য বর্ধিত করেছেন। পুরস্কার প্রাপ্তির অনুষ্ঠানে তারা বলেন, আমার এ পুরস্কার জাতির জন্য উৎসর্গ করলাম। দেশের মানুষের মধ্যে তখন সাড়া পড়ে যায় কী করে প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে প্রাণ উজাড় করে সংবর্ধিত করব। ভক্ত সুহূদ সমর্থক ছাত্র-জনতা, কর্মী, নেতা সবাই ব্যাকুল আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন কী করে প্রিয় নেত্রীকে বিশেষ সম্মানে সম্মানিত করা যাবে। দলীয় ফোরামে প্রথমে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয় তারপর তা দলীয় কর্মসূচির অংশ হয়ে যায়। নেত্রীর আগমনের দিন নেত্রীর প্রতি দরদ ভালোবাসা ভক্তি শ্রদ্ধা কুর্ণিশ প্রণাম বন্দনার স্লোগানে রাজপথ শুধু নয়, ঢাকা শহর দলীয় নেতা-কর্মীদের দখলে চলে যায়। রাজপথ দলীয় নেতা-কর্মী সমর্থকদের দখলে চলে যায় নেত্রীর বিদেশ থেকে আগমনের এক প্রহর আগ থেকে। কেউ মাথায় পতাকা বেঁধে, কেউ নেত্রীর ছবি বাহুতে বেঁধে বিচিত্র সজ্জায় আগমন করে। রাস্তার কোনো ডিভাইডার কিংবা বিদ্যুৎ খুঁটি বাকি থাকে না, যেখানে নেত্রী এবং তার প্রয়াত আদর্শিক নেতার সঙ্গে আঁতুড়ে নেতাদের ছবি শোভা পায় না। জাতীয় নেতাদের সঙ্গে নিজেদের ছবি ঢোল পিটিয়ে প্রচার করার সুযোগকে পাড়া-মহল্লার পাতি নেতারাও গ্রহণ করেন উদারভাবে। কত কোটি টাকার ব্যানার ফেস্টুন প্লাকার্ড এ জন্য যে ব্যয় করা হয় তার হিসাব পাওয়া দায়। একদিকে করপোরেশন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কর্মী দিয়ে রাজধানীর দেয়ালগুলো ছাপ-ছাপাই করছে, অন্যদিকে দলীয় উঠতি নেতারা পোস্টার ব্যানার দিয়ে সৌন্দর্যহানি করে পরিচিতির হাট বসিয়েছে। বাস, ট্রাক, পিকআপ, টেম্পো ও মোটরসাইকেলে মানুষ ছুটছে বিমানবন্দরের অভিমুখে। মুহুর মুহুর করতালি গগণভেদী স্লোগানে প্রকম্পিত করছে নগর। ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ ছন্দের তালে নৃত্য করছে হাত নাড়িয়ে, শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে, কেউ আশ্বাস দিচ্ছে ভয় নাই আমরা আছি তোমার সঙ্গে। হাস্যোজ্জ্বল বদনে প্রাণোজ্জ্বল মানুষ নেত্রীকে বরণ করছে। সংস্কৃতি কর্মীরাও পিছিয়ে নেই। তারাও বাদ্যের তালে তালে সংগীতের মূর্ছনায় নেত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কৃতার্থ হচ্ছে। নেত্রীও স্বভাবতই গাড়ি বহর নিয়ে যাওয়ার সময় ভক্ত অনুগত জনতার অভিবাদনের জবাব না দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে পারছেন না।

ট্রাফিক পুলিশের কষ্ট দেখে খুব করুণা হয়, শত চেষ্টা করেও তারা ট্রাফিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। কর্মী বোঝাই গাড়ি থামার সিগনাল দিলে তারা গরম মেজাজে তেড়ে এসে জেরা করা শুরু করে। মানুষ পরিচালিত হয় আবেগ আর বিবেক দিয়ে। বিচক্ষণ মানুষের বিবেক আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে। আবেগ বিবেককে ছাপিয়ে গেলে সেখানে আবেগের রাজত্ব কায়েম হয়, ভালো হওয়ার চেয়ে হানিকর অনিষ্টকর কর্মই বেশি হয়। আমি নেত্রীর সুকর্মের স্বীকৃতিতে গর্বিত ও আনন্দে উদ্বেলিত। আত্মার তৃপ্তির জন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে হূদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধা ভক্তি মর্যাদা দিয়ে সংবর্ধনা দিতে চাই কিন্তু রাজপথ বিমানবন্দরের রাস্তা বন্ধ করে নয়। পথযাত্রীদের দুর্ভোগ দুর্গতি নেত্রীর সামনে লুকিয়ে পয়েন্ট কামাই করা দলীয় নেতা-কর্মীদের কাজ হতে পারে না। সংকট উত্তরণ নেতাদের নৈতিক দায়িত্ব, সংকট সৃষ্টি নয়। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকেন অন্য উজিররা কি কেউ ভাবেন না, লাইফ লাইন বন্ধ থাকলে কী অবস্থা হবে। দুই নেত্রী যখন ফলপ্রসূ সফর শেষে দেশে ফেরেন তখন এয়ারপোর্ট রোড যাত্রীদের জন্য দুর্বিষহ যন্ত্রণা বয়ে আনে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থেকে মানুষের ধৈর্যচ্যুৎ ঘটে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে গাড়ি আটকে থাকার ক্ষতির বিষয়টি কি নেত্রীরা একবার ভাবেন?

কয়েকদিন আগে বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশ থেকে দেশে আগমন উপলক্ষে একই ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। মানুষকে দুর্ভোগে না ফেললে কি রাজনীতি হয় না। বিমানবন্দরে সংবর্ধনা জানানোর জন্য ভিড় না করে একদিন পর খোলা কোনো ময়দানে সংবর্ধনা দিলে কোনো ক্ষতি হতো বলে মনে হয় না। মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি করে কাউকে প্রীত করা অনুচিত। মোসাহেবির সীমা রেখা থাকা উচিত। যে অনুশীলনে জাতির কোনো মঙ্গল নেই তা ত্যাজ্য হওয়াই শ্রেয়। সংসদে মাঠে ময়দানে রাজপথে কথা শুরু করতে গেলেই নেত্রীর বন্দনা পাঁচ মিনিট না বললে কলিজায় শান্তি পায় না কিন্তু এ বন্দনায় জাতির কী উপকার হয় বোধগম্য নয়। নেতা-নেত্রীদের সংবর্ধনা এবং সমাবেশ কাউন্সিল ইত্যাদি রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে রাজধানী যানজটে অচল হয়ে পড়ে। সংবর্ধনা পথযাত্রীদের হয়রানি না করেও বিশাল আড়ম্বর করে করা যায় তাতে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাগম হবে। এমন আইডিয়া সিনিয়র নেতাদের মাথায় আসা উচিত। হুজুগে নবীনরা করতে পারে পরিণতি ভাববার মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা যেসব সিনিয়র নেতার আছে তারা কেন সুপারিশ করে না সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাআয়োজনের। জাতির দুর্ভাগ্য পরিপক্ব অভিজ্ঞ নেতারা আজ সত্যি কথা জানাতে ইতস্তত করছেন। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর বালকসুলভ কর্মসূচিতে আমাদের অপরিপক্বতা প্রকাশ পায়। মাত্রা জ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড দিয়ে কোনো সুফল আসবে না। বিবেক লোভের কাছে বন্ধক রেখে নেতৃত্ব টেকসই হয় না। সচেতন নাগরিক অস্বস্তি প্রকাশ করছে। তথ্য যদি নির্ভুল না হয়, সুপারিশ যদি স্বজনপ্রীতি দুর্নীতির ঊর্ধ্বে না থাকে তা হলে সিদ্ধান্ত ভুল হবেই। আমাদের দেশে গণশৌচাগারের সংখ্যা একেবারে কম। যা আছে তার মান ব্যবহারের যোগ্য নয়। যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষ আটকা পড়লে বৃদ্ধ ও নারী ডায়াবেটিস রোগীদের অবস্থা কী দাঁড়ায় তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন, আমার মৃত্যুর পর শোকদিবস পালনের নামে কাজ  যেন বন্ধ রাখা না হয়। ওইদিন সবাই বেশি কাজ করলে তার মাধ্যমেই আমার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো হবে। সংবর্ধনা করে যে টাকার অপচয় হয় তা দিয়ে সারা দেশের মহাসড়কের পাশে শৌচাগার করা যেত। তাতে আমরা সভ্যতায় আর একধাপ এগিয়ে যেতাম। কেউ হয়তো বলবেন আমরা টাকা খরচ করিনি। কথা হয়তো ঠিক। উনি করেননি তবে ফরমায়েশ করেছেন কাউকে গাড়ি দিতে, কাউকে গেঞ্জি দিতে, কাউকে ক্যাপ দিতে, হয় নেতা নয়, ব্যবসায়ী কেউ না কেউ অর্থ দিয়েছে। নেতাদের সুমতি হলে বিবেক দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলে এয়ারপোর্ট রোডে হুজুগে জনসমুদ্রে আর ডুবতে হবে না। সব নাগরিকের নাগরিক সুবিধা বিবেচনায় যাতে সব দল নেয় এমন দাবি বহু দিন আগের কিন্তু নেতাদের কানে কিছুতেই পানি যাচ্ছে না।

কাজের পরিণতি ভেবে সিদ্ধান্ত নিলে কাজটি পূর্ণতা লাভ করবে। যে নেত্রী কবি সৈয়দ শামসুল হকের পরলোকগমনের প্রতি শোক প্রকাশে জন্মদিন পালন না নেওয়ার আদেশ দিতে পারেন তাকে জনভোগান্তির বিষয়টি জানালে তিনি নিশ্চয়ই বিকল্প কিছু নির্দেশনা নেতাদের দিতেন এমন বিশ্বাস ভুক্তভোগীরা তার ওপর রাখেন। একটা শিশুর দাবি ব্রিজ করে দিতে হবে সঙ্গে সঙ্গে তিনি চিঠির উত্তর দিয়েছেন ব্রিজ নির্মাণের আদেশও দিয়েছেন সেই প্রধানমন্ত্রী যদি জানেন শত শিশু ও তাদের মা বাসে-গাড়িতে বসে কষ্ট পাবে, তিনি কী করে দুর্ভোগের কর্মসূচি পালন করতে দিতেন?  রাজনীতিকরা মানবিক না হলে জনদুর্ভোগ কখনো হ্রাস পাবে না সামনে চলার পথ সুগম হবে না।

 লেখক : সম্পাদক জিনিউজ২৪, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর