শনিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

ইসলামে বিয়েশাদি ও তালাকের বিধান

মুফতি মহিবুল্লাহিল বাকী নদভী
পেশ ইমাম, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ।

বিয়েশাদির আরবি শব্দ নিকাহ। এর আভিধানিক অর্থ সংযুক্ত করা, মিলানো ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায় ইচ্ছাকৃতভাবে একজন নারীর আপাদমস্তক দ্বারা আচ্ছাদিত হওয়ার ‘আকদ’কে বিয়েশাদি বলা হয়।

বিয়ে সংঘটিত হয় ইজাব-কবুল দ্বারা। এ দুটি বিবাহের রুকন এবং উভয়টি ক্রিয়াপদ হতে হবে। দুজন পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দুজন নারীর সাক্ষীর উপস্থিতিতে আকদ সংঘটিত হতে হবে। সাক্ষীদের আকদ, বুদ্ধিজ্ঞান, প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমান হতে হবে।

বস্তুত পৃথিবীর সব মানুষকে আল্লাহতায়ালা সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর বেঁধে দিয়েছেন দয়া ও মায়ার বাঁধনে। ইরশাদ হয়েছে— আর মহান আল্লাহর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্যই তোমাদের থেকেই তোমাদের সঙ্গীদের সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমরা তাদের নিকট প্রশান্তি লাভ করতে পার এবং তিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মধ্যে পরস্পরের ভালোবাসা ও দয়া। (সূরা রুম-৩০)

এ আবাদ প্রক্রিয়া যেন অব্যাহত ও চলমান থাকে, এ জন্য আল্লাহতায়ালা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। মানব প্রজন্মের অবিরাম আগমন ধারা সুনিশ্চিত করার জন্যই মানুষের রক্ত-মাংসে দিয়েছেন কাম-ক্ষুধা। সেই কামতৃষ্ণা পরিতৃপ্ত হওয়ায় বৈধ ব্যবস্থা নির্দেশ করেছেন— এই বিয়েশাদির বিধান প্রদান করে।

মানুষের মধ্যে যে যৌন ক্ষমতা রয়েছে, এর সৃষ্টি উদ্দেশ্যহীন নয়। বরং মানব বংশের বৃদ্ধিই এর লক্ষ্য। আর সে জন্যই সৃষ্টি হয়েছে নারীর। ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে নারীকে গর্ভধারণের ও সন্তান প্রসবের আর মানুষ যেহেতু পশু নয়, তাই উচ্ছৃঙ্খলভাবে যত্রতত্র যৌনকর্ম নিবারণের অনুমতি দেওয়া হয়নি তাকে। বরং নিয়মনীতির আলোকে সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে সম্মানজনক অবস্থায় কাম-চাহিদা পূরণ ও তা ফলপ্রদ করার পুণ্যময় রীতি প্রণয়ন করেছে শরিয়ত। আর তারই নাম বিয়েশাদি।

বিয়ের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব : নিতান্তই সত্য যে, বিয়ে একজন সুস্থ মানুষের প্রাকৃতিক প্রয়োজন। মানুষের স্বভাবগত পরিচ্ছন্নতা, মানসিক ভারসাম্যতা ও চারিত্রিক পবিত্রতার অন্যতম উপায় বিবাহ। এক কথায় আহার্য গ্রহণ বা পানাহার যেমন মানবজীবনে অপরিহার্য প্রয়োজন, আহার নিবারণের প্রয়োজনীয়তা যেভাবে যুক্তিতর্কের ঊর্ধ্বে, একজন যৌবনদীপ্ত মানুষের সুস্থ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বিয়ের প্রয়োজনীয়তা তেমনিই; আর এ কারণে কোরআন ও হাদিসে নির্দেশসূচক শব্দে উত্কীর্ণ করা হয়েছে বিবাহের আহ্বানকে। ইরশাদ হয়েছে— ‘তোমাদের মধ্যে যেসব ছেলেদের স্ত্রী নেই এবং যেসব মেয়েদের স্বামী নেই তাদের এবং তোমাদের দাস-দাসীদের যারা সৎ তাদের বিয়ে দিয়ে দাও।’ (সূরা নূর ২৪ : ৩২)

ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়েশাদির ফজিলতও অসামান্য, বিবাহের প্রতি উৎসাহিত করে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন— ‘যে ব্যক্তি পূতপবিত্র অবস্থায় আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চায় সে যেন আকদ নারীকে বিয়ে করে।

অন্য এক বর্ণনায় আছে সাহাবি হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন— রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কতিপয় সাহাবি উম্মাহাতুল মুমিনিনদের সমীপে এসে তার ইবাদত সম্পর্কে জানতে চাইলে, তা শোনে তারা যেন একটু কম কম মনে করল, সঙ্গে সঙ্গেই তারা বলে উঠল— ‘তিনি কোথায় আর আমরা কোথায়? তার পূর্বাপর সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে।’ অতঃপর তাদের একজন বললেন— আমি কোনো নারীকে বিয়ে করব না। অন্যজন বললেন, আমি কখনো গোশত খাব না, অন্যজন বলেন, আমি আর কখনো শয্যা গ্রহণ করে ঘুমাব না। ঘটনাটি শুনে রসুল (সা.) বললেন— লোকদের কী হলো যে, তারা এমনটি বলে। অথচ আমি নামাজ আদায় করি, নিদ্রা যাই, রোজা রাখি আবার ইফতারও করি। নারীদের বিয়েও করি। সুতরাং যে আমার আদর্শ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল সে আমার দলভুক্ত নয়।

নির্যাস কথা হচ্ছে— বিবাহের মাধ্যমে একজন মুমিন বান্দা আল্লাহর সমীপে পবিত্র হয়ে ওঠার পথ পায়, সর্বোপরি বিয়ে করা রসুলের সুন্নত।

তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ : তালাক শব্দের আভিধানিক অর্থ বন্ধন খুলে দেওয়া, পরিত্যাগ করা, বিচ্ছিন্ন করা। শরিয়তের পরিভাষায় তালাক মানে বিয়ের বন্ধন খুলে দেওয়া, স্বামী স্ত্রীকে সরাসরি অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে নির্দিষ্ট বাক্যে অথবা ইঙ্গিতে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন করাকে তালাক বলে।

তালাক বিধানের উদ্দেশ্য : স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক সম্পর্ক যখন এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে, তারা পরস্পর মিলেমিশে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও আন্তরিক হৃদ্যিক জীবনযাপন করার কোনোই সম্ভাবনা দেখতে পায় না, এমনকি এরূপ অবস্থার সংশোধন বা পরিবর্তনের শেষ সম্ভাবনাও নিঃশেষ হয়ে যায় তখন উভয়ের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও তিক্ততা-বিরক্তির বিষাক্ত পরিণতি থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে উভয়ের মধ্যে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেওয়া। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে তালাক নন্দিত বিষয় নয়। ইসলাম এটাকে পছন্দ করেনি।

এ কাজকে কোনো দিক দিয়ে বিন্দুমাত্র উৎসাহিত করা হয়নি। বরং এ হচ্ছে নিরূপায়ের উপায়। তালাক যে ইসলামে কোনো পছন্দনীয় কাজ নয় তা নিচের হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয়।

হজরত রসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন—  আল্লাহতায়ালা তালাক অপেক্ষা ঘৃণ্য কোনো জিনিস হালাল করেননি।

অন্য হাদিসে আছে আল্লাহর কাছে সব হালাল কাজের মধ্যে সর্বাধিক অপছন্দনীয় কাজ হচ্ছে তালাক।

সর্বশেষ খবর