সোমবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

হামলাকারীরাই প্রকৃত সংখ্যালঘু

প্রভাষ আমিন

হামলাকারীরাই প্রকৃত সংখ্যালঘু

কিছুদিন পরপরই কোনো একটা উসিলায় দেশের কোনো না কোনো এলাকায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়, বাড়ি ভাঙচুর হয়, মন্দির ভাঙচুর হয়, দেবীমূর্তি ধুলায় লুটায়। আমরা কিছুদিন চিৎকার চেঁচামেচি করি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। সাম্প্রদায়িকতার যে বিষ আমাদের কিছু মানুষের ভেতর আছে, তা মুছে ফেলা না গেলে ওপরে ওপরে ভালো কথা বলে, সম্প্রীতির কথা বলে, মানববন্ধন করে, সহানুভূতি জানিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। কখনো যশোরে, কখনো খুলনায়, কখনো রামুতে, কখনো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতিচিহ্ন গুঁড়িয়ে দেওয়ার ক্ষত মুছে যাওয়ার আগেই, নাসিরনগরে যা হলো, তা মুছে যাওয়ার সুযোগ পাব তো?

সংখ্যালঘু শব্দটির ব্যাপারে আমার প্রবল আপত্তি রয়েছে। মানুষকে আমি কখনো ধর্ম দিয়ে, বর্ণ দিয়ে, জাতি দিয়ে, ভাষা দিয়ে, সংখ্যা দিয়ে গুনি না। মানুষকে আমি বিবেচনা করি, ব্যক্তি হিসেবে তিনি কতটা ভালো, কতটা মানবিক- তা দিয়ে। এই যে কদিন আগে দিনাজপুরে সাইফুল ইসলাম নামে একজন পাঁচ বছর বয়সী এক হিন্দু শিশুকে ধর্ষণ করেছে। আমি কিন্তু বলিনি একজন মুসলমান সাইফুল একটি হিন্দু শিশুকে ধর্ষণ করেছে। আমি লিখেছি, একটি পশু একটি শিশুকে ধর্ষণ করেছে। আর সংখ্যালঘু ধারণাটিই আপেক্ষিক। এই দেশে যারা সংখ্যাগুরু, সম্মিলিতভাবে যাদের গায়ে জোর বেশি, সীমান্ত পেরুলেই তারা সংখ্যালঘু হয়ে যাবেন, তাদের গলা নিচু হয়ে যাবে। মিয়ানমারে বছরের পর বছর নির্যাতিত হচ্ছে রোহিঙ্গারা। তারাই সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে অবৈধ হলেও সংখ্যাগুরুর প্রোটেকশন পেয়ে যান। ধর্ম নয়, সব ক্ষেত্রেই বিবেচনাটা হওয়া উচিত মানুষের ওপর অসুরের হামলা।

শুরুতেই উসিলার কথা বলেছি, কারণ আমি বিশ্বাস করি নিজেদের ভিতরে থাকা সাম্প্রদায়িকতার বিষ যখন কুটকুট করে, তখনই আমরা একটা অজুহাত বের করে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলে পড়ি। রামুতে যেমন ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে নির্মূলের চেষ্টা হয়েছে বৌদ্ধদের, তেমনি একই স্টাইলে নাসিরনগরে হিন্দুদের ওপর হামলা হয়েছে। রামুতে বৌদ্ধ যুবক উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুকে একটি অবমাননাকর ছবি ট্যাগ করে হামলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছিল। নাসিরনগরে এবার এই ষড়যন্ত্রের শিকার হিন্দু যুবক রসরাজ। স্বল্পশিক্ষিত রসরাজের ফেসবুকে যে গ্রাফিক্সটি দেওয়া হয়েছে, সেটি আমি দেখেছি। এটি দেখলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের রাগ হতেই পারে। কিন্তু কেউই পেছনের দিকটি খতিয়ে দেখেনি। রসরাজের মতো একজন যুবকের পক্ষে এই গ্রাফিক্সটি তৈরি করা সম্ভব নয়। পুলিশ গ্রেপ্তার করার পর রসরাজ দাবি করেছে, এই স্ট্যাটাসটি তার দেওয়া নয়। অন্য কেউ তার ফেসবুক হ্যাক করে এটি দিয়েছে। আমি তার দাবি বিশ্বাস করি। কারণ দিনের পর দিন মারতে মারতে আমরা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মনোবল এমন তলানিতে নিয়ে গেছি, যে ন্যায্য কথাটাও তারা জোর গলায় বলতে পারে না। আর ইসলাম ধর্মকে কটাক্ষ করে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে ঘরে বসে থাকার মতো সাহস কোনো হিন্দুর নেই। রসরাজ তার আরেকটি স্ট্যাটাসে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। তাতেও ঘটনার শেষ হয়নি। রীতিমতো মাইকিং করে উত্তেজনা ছড়িয়ে ভাড়া করা লোক এনে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়েছে। একদম রামুর প্লট। তার মানে কেউ একজন এ হামলার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য রসরাজের ফেসবুক আইডি হ্যাক করা থেকে শুরু করে মাইকিং, লোক ভাড়া করা- সব করেছে। আমি যদি রসরাজের দাবি মিথ্যাও মনে করি— তাহলেও দোষটা তো তার একার। রসরাজের বিচার চাওয়া যেতে পারে। বাকিদের বাড়িঘরে হামলা চালানো কেন, কেন ধুলায় লুটায় দেবিমূর্তি? এতকিছু হলো, প্রশাসন চুপ করে বসে থাকল কেন? কাবা শরিফের ভার্চুয়াল অবমাননায় যদি মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে, অ্যাকচুয়ালি মন্দির-মূর্তি ভাঙচুর করলে বুঝি হিন্দুদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে না? নাকি বাংলাদেশে সংখ্যাগুরুদেরই শুধু অনুভূতি থাকে, আর সংখ্যালঘুদের জন্য বরাদ্দ শুধুই সহানুভূতি?

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধর্মীয় অনুভূতির নামে যা হয়েছে, তাতে একজন মুসলমান হিসেবে আমি লজ্জিত, একজন মানুষ হিসেবে আমি অপমানিত। আমরা মুখে নিজেদের উদার-অসাম্প্রদায়িক দাবি করে বটে, কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পরও নাসিরনগরে যা হয়েছে, তাতে প্রমাণিত হয়েছে, আমরা আসলে দাঙ্গাবাজ। আমি জানি, কিচ্ছু যাবে আসবে না, তবু যারা হামলার শিকার, তাদের কাছে আমি করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। কিন্তু আমি জানি, এই ক্ষমায় সমস্যার সমাধান হবে না। বিশ্বের কোনো ধর্মেই সহিংসতার কথা, অশান্তির কথা বলা নেই; ইসলাম ধর্মে তো নয়ই। ইসলাম শব্দের অর্থই শান্তি। ইসলামে সবাইকে যার যার ধর্ম পালনের অধিকার দেওয়া আছে। অন্য ধর্মের কারও ওপর হামলা করা ইসলাম ধর্ম সমর্থন করে না। রামুতে যারা বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা করেছে, নাসিরনগরে যারা হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছে; তারা নামে মুসলমান হলেও আসলে তারাই ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু। এদের কারণেই ইসলামের বদনাম হচ্ছে। এদের কারণেই বিশ্বজুড়ে আজ ইসলামকে সন্ত্রাসের সঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দি করে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু গায়ের জোরে কখনো কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।

বাংলাদেশে দুটি রাজনৈতিক শক্তি- আওয়ামী লীগ ও এন্টি আওয়ামী লীগ। ৭৫-এর আগে এন্টি আওয়ামী লীগ শক্তির নেতৃত্ব ছিল জাসদের হাতে, এখন সেটা বিএনপির হাতে। মোটা দাগে বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক শক্তির নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ। আর সাম্প্রদায়িক শক্তির নেতৃত্ব বিএনপির হাতে। ঐতিহ্যগতভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। এই অপরাধে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশজুড়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে তাণ্ডব চলেছে, তা অনেকদিন মানুষ হিসেবে আমাদের খাটো করে রাখবে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ হয়তো একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। কিন্তু তাদের সে স্বস্তি স্থায়ী হয়নি। সুযোগ বুঝে সংখ্যালঘুদের ওপর দলগত হামলা, ব্যক্তিগত নির্যাতন, বৈষম্য চলছেই। হয়তো মাত্রা একটু কমেছে। নীতিগতভাবে সরকার অসাম্প্রদায়িক হলেও স্থানীয়ভাবে সরকারি দলের নেতারাও অনেক সময় সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িয়ে পড়ে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের হিসাব অনুযায়ী ২০১৫ সালে দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর ২৬২টি হামলা হয়েছে, এতে মারা গেছে ২৪ জন, আহত হয়েছে ২৩৯ জন। এছাড়া ২৪ জন সংখ্যালঘু নারী অপহরণ ও ২৫ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আওয়ামী লীগের মতো অসাম্প্রদায়িক দাবিদার শক্তি ক্ষমতায় থাকতে এই পরিসংখ্যানকে ভয়াবহ বললেও কম বলা হবে। আমরা জানি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলে ঠিক থাকলেও, ভোটের হিসাবে অনেক সময়ই সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সঙ্গে আপস করে আওয়ামী লীগও। ২০০৬ সালে সম্ভাব্য নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। এখনো সরকার হেফাজতে ইসলামীকে দমন করে নয়, আপস করেই তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। সরকারের এই আপসকামিতা তৃণমূলে ভুল বার্তা দেয়। সরকারের কিছুটা ছাড় দেওয়ার প্রবণতা কিছু লোকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেয়। ভালো ভালো কথায় কাজ হবে না। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে এই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নির্মূল করতে হবে।

সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার স্বার্থটা সবসময় রাজনৈতিক নয়। ৪৭ সালে দেশভাগের সময় বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় ছিল ৩১ শতাংশ। ১৯৫১ সালে ২২ শতাংশ, ১৯৬১ সালে ১৮ দশমিক ৫, ১৯৭৪ সালে ১৩ দশমিক ৫, ১৯৮১ সালে ১২ দশমিক ১, ১৯৯১ সালে ১০ দশমিক ৫, ২০০১ সালে ৯ দশমিক ২ আর ২০১১ সালে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫ শতাংশে। কী ভয়ঙ্কর চিত্র! পরিসংখ্যানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে; শত অত্যাচার, নির্যাতন, বৈষম্য, অপমানে জর্জরিত হয়ে এখনো অনেকে মাটি কামড়ে পড়ে আছেন। যারা মাটি কামড়ে পড়ে আছেন, তাদেরও আমরা বার বার আঘাত করি, মার খেতে খেতে যদি একসময় গোপনে রাতের আঁধারে কম দামে ভিটেবাড়ি বিক্রি করে ওপারে চলে যায়, এই ভরসায়। জমিটা তো তখন আমিই কিনব। একটি হামলার পর কত অসহায় সংখ্যালঘু এভাবে গোপনে দেশ ছেড়েছে তার কিন্তু কোনো পরিসংখ্যান নেই। এমনিতে তো টুকটাক হামলা, চড়-থাপ্পড়, হেনস্তা করা চলেই; রামু বা নাসিরনগরের মতো হামলা চালানো হয়, বড় আকারে ভয় দেখাতে। যাতে এক হামলায় সারা দেশের অনেক সংখ্যালঘুকে দেশ ছাড়া করা যায়। যারা দেশ ছেড়ে যায়, তারা যায় গোপনে, রাতের আঁধারে; তাই আমরা টের পাই না। কিন্তু পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখলেই এই অব্যাহত দেশত্যাগের প্রবণতা সত্যি বলে মানতেই হবে আমাদের। আবার আমরাই কিন্তু হিন্দুদের গাইল দেই, ‘এই মালাউনরা এই দেশে আয় করে, ঐ দেশে ফ্ল্যাট কেনে।’ গালি দেওয়ার সময় আমরা চিন্তা করি না, একজন মানুষ কতটা কষ্টে জন্মভিটা ছেড়ে যায়। সাধারণ ধন-সম্পদ, হুমকি, অপমান পর্যন্ত তাদের গায়ে লাগে না। কিন্তু যখন হুমকিটা জীবনের ওপর, যখন প্রশ্নটা অস্তিত্বের; তখন আর নাড়ির টানও টেনে রাখতে পারে না। শিকড় ছেড়ে যাওয়ার চেয়ে কষ্টের আর কিছু নেই। এখনো বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অনেকে ওপার বাংলার নিজ দেশের কথা মনে করে চোখের জল ফেলেন। পূর্ব পুরুষের জন্মভিটায় এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন নচিকেতার মতো শিল্পী।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদকে অনেকে সাম্প্রদায়িক সংগঠন বলেন। হতে পারে। কিন্তু এ সংগঠনটি আছে বলেই এখনো নির্যাতিত সংখ্যালঘুরা কান্নাকাটির একটা জায়গা পায়। নইলে তো সাম্প্রদায়িক হামলার হিসাব রাখারও কেউ থাকত না। তবে বাংলাদেশে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মতো একটি সংগঠনের অস্তিত্বই মানুষ হিসেবে আমাকে খাটো করে দেয়, রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের অপরাধী করে দেয়। রামুতে হামলা হলে বৌদ্ধরা মাঠে নেমে প্রতিবাদ করে, বড়জোর তাদের পাশে দাঁড়ায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। নাসিরনগরের ক্ষেত্রেও তাই। অল্প কিছু মানবাধিকার কর্মী ছাড়া রাজপথে সোচ্চার প্রতিবাদ দেখি না। না দেখে দেখে লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছা করে। যাদের ওপর হামলা, তারাই যদি প্রতিবাদ করে, তাহলে মানুষ হিসেবে আমরা সংখ্যাগুরুরা খাটো হয়ে যাই। হামলাকারীরা তো সংখ্যায় অল্প, শুভবুদ্ধির মানুষই সত্যিকারের সংখ্যাগুরু। তাহলে আমরা সত্যিকারের সংখ্যাগুরুরা তীব্র প্রতিবাদ করছি না কেন? কেন তাকিয়ে থাকি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের দিকে। কয়েকদিন আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে বেছে বেছে সংখ্যালঘুদের হত্যার ঘটনার পর ক্ষমতাসীন ১৪ দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা। সে বৈঠকে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘পাবনা ছাড়া আর কোথাও সরকারি দল বা ১৪ দলীয় জোটের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত কোনো নেতাকে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখিনি। মানুষ খুন হচ্ছে। দুই দিনের মাথায় যাচ্ছে কে? যাচ্ছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, পূজা উদযাপন পরিষদ, খ্রিস্টিয়ান অ্যাসোসিয়েশন। আর মন্ত্রীদের মধ্যে যাচ্ছেন বীরেন শিকদার ও নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। তাহলে কী অবস্থা আজকের বাংলাদেশে?’ আবেগে হয়তো কিছুটা অতিশয়োক্তি আছে তার বক্তব্যে, তবে পরিস্থিতি খুব বেশি অন্যরকম নয়। তাহলে কী অবস্থা আজকের বাংলাদেশের? এই প্রশ্নের উত্তর আসলে জানা নেই আমাদের। একাত্তরে আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছি একটি উদার-অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ব বলে। যেখানে সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে থাকবে। কিন্তু আমরা কি এখন সব সংখ্যালঘুকে তাড়িয়ে দিয়ে একটি একধার্মিক রাষ্ট্র গড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি? পরিসংখ্যান যা বলছে, তাতে বাংলাদেশ সংখ্যালঘুমুক্ত হতে কত বছর লাগবে। একটু ভাবুন তো সেই রাষ্ট্র কি বাসযোগ্য থাকবে? বৈচিত্র্যহীন সমাজ তো আসলে মৃত সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি জনপ্রিয় পোস্টার ছিল ‘বাঙলার হিন্দু, বাঙলার বৌদ্ধ, বাঙলার খ্রিস্টান, বাঙলার মুসলমান; আমরা সবাই বাঙালি।’ সেই সম্প্রীতির চেতনা থেকে কি আমরা সত্যি সরে এসেছি? মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে যাই বটে; কিন্তু যখন দেখি বৌদ্ধ মন্দির থেকে ইফতার সামগ্রী বিতরণ করা হয়, যখন দেখি ঈদের জামাতের স্বেচ্ছাসেবক হয় হিন্দু যুবকরা, যখন দেখি পূজা আয়োজনের সংগঠক মুসলমানরা, যখন দেখি একই ভবনে মসজিদ এবং মন্দির থাকে বহাল তবিয়তে, যখন দেখি নাসিরনগরেও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রুখে দাঁড়ায় মুসলমান তরুণরা; তখন বিশ্বাস করি এটাই এই ভূখণ্ডের হাজার বছরের সম্প্রীতির আসল চিত্র। হিন্দু সম্প্রদায় নয়, হামলাকারী সাম্প্রদায়িক শক্তিই আসল সংখ্যালঘু। এ সংখ্যালঘুদের শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে সমাজের গভীর থেকে। মনে রাখতে হবে, এ দেশ যতটা আমার, ততটাই রসরাজের; যতটা ফাতেমার, ততটাই পূর্ণিমার। সবার জন্য নিরাপদ সমাজ গড়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রামুর মতো নাসিরনগরেও হয়তো মন্দির গড়ে দেওয়া হবে। ভবনের বা কাঠামোর ক্ষতি হয়তো পোষানো যাবে। কিন্তু এ অব্যাহত হামলা সংখ্যালঘুদের মনে নিরাপত্তাহীনতার যে চিরস্থায়ী বোধ তৈরি করে, তার উপশম কোথায়?

     লেখক : সাংবাদিক।

     [email protected]

সর্বশেষ খবর