বৃহস্পতিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
দিবস

শহীদ নূর হোসেনের আত্মত্যাগ

শফী আহমেদ

শহীদ নূর হোসেনের আত্মত্যাগ

নূর হোসেন, এক অমিত সাহসী আত্মোৎসর্গকারী প্রেরণাদায়ক যুবকের নাম। যার উদোম গায়ে লেখা ছিল— ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী নূর হোসেন মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও বুকে-পিঠে ধারণ করেছিল গণতন্ত্র ও মুক্তির স্লোগান। স্বৈরাচারের বুলেট আলিঙ্গন করেছিল সে দ্বিধাহীনচিত্তে। সময়কাল ১৯৮৭ সাল, ১০ নভেম্বর। বাঙালি জাতি নিষ্পেষিত হচ্ছে সামরিক শাসনের জাঁতাকলে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসনের যাত্রা শুরু হয়। অনেক নারকীয় ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিসমূহ সামরিক শাসন অবসানের লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু জগদ্দল পাথরকে এত সহজে সরানো যায় না। সামরিক স্বৈরশাসক জিয়া খুন হয়ে যাওয়ার পর রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে চেপে বসা জগদ্দল পাথরের নব্য সংস্করণ ও ধারাবাহিকতা এরশাদের সামরিক শাসন। ’৮২-এর ২৪ মার্চ থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্রসংগঠনগুলো ও জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১০ দলীয় ঐক্যজোট পৃথকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ’৮৩-এর মধ্য ফেরুয়ারিতে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে এক কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শহীদ হন জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল কাঞ্চন, দীপালি সাহাসহ হাজারো সাথী, যাদের লাশ গুম করে ফেলে স্বৈরশাসক। আন্দোলনের নবতর যাত্রায় নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে ছাত্রসমাজ ও জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। রাজনৈতিক দলসমূহ জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। পাশাপাশি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতাচ্যুত বিএনপি ৭ দলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। কিন্তু আন্দোলনের যাত্রাপথে ’৮৬-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের মধ্যে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। ৮ দল, ৫ দল ও ৭ দল এই তিনটি জোটের আবির্ভাব ঘটে। সবার লক্ষ্যই এক ও অভিন্ন। সামরিক শাসনের অবসান ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া।

সেদিন ছিল ৮ দল, ৫ দল ও ৭ দলের নৌপথ, রেলপথ ও রাজপথ অবরোধের কর্মসূচি। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে সচিবালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি। কার্তিকের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে দলে দলে জনতা সমবেত হতে থাকে নিজ নিজ জোটের ব্যানারে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৮ দলীয় জোটের অবস্থান ছিল এখন যেখানে নূর হোসেন স্কোয়ার সেখানে। ৫ দলীয় জোটের অবস্থান ছিল হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের সামনে ও ৭ দলের অবস্থান ছিল দৈনিক বাংলা মোড়ে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ৮ দলীয় জোটের অবস্থানে মিলিত হলো এক দল সাহসী যুবকের খণ্ড মিছিল। ওই মিছিলটি গুলিস্তান থেকে তোপখানা মোড় পর্যন্ত বারবার প্রদক্ষিণ করছিল এবং আন্দোলনকামী জনতাকে অনুপ্রাণিত করছিল। মিছিলের অগ্রভাগে ছিল নূর হোসেন। খণ্ড মিছিলে অংশগ্রহণকারী যুবকদের উদোম গায়ে লেখা ছিল উপরোক্ত স্বৈরাচারবিরোধী স্লোগান। আমরা যারা সেদিন ৫ দলের ছাত্রকর্মী ছিলাম, তারাও হাউস বিল্ডিং থেকে জিরো পয়েন্ট আবার কখনো দৈনিক বাংলা পর্যন্ত সমবেত আন্দোলনকারীদের স্লোগানে প্রকম্পিত করে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করছিলাম। ততক্ষণে জননেত্রী শেখ হাসিনাও আন্দোলনস্থলে উপস্থিত হয়েছেন। স্বৈরাচারী এরশাদের পুলিশ বাহিনী প্রথমে গুলি চালায় নূর হোসেনকে লক্ষ্য করে। পরবর্তীতে শুরু হয় জননেত্রী শেখ হাসিনা যে অস্থায়ী মঞ্চে ছিলেন সেই মঞ্চকে টার্গেট করে গুলিবর্ষণ। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। ৫ দল ও ৭ দলের অবস্থানের উপরেও পুলিশ জলকামান ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে সমবেত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু জনতার রুদ্ররোষ ঠেকানোর ক্ষমতা স্বৈরাচারের ছিল না। সেদিন নূর হোসেনের জীবন দান ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক মাইলফলক, বিষুভিয়াসের আগ্নেয়গিরির এক জ্বলন্ত লেলিহান শিখা, সেদিন নূর হোসেন হয়ে উঠেছিল সমগ্র বাঙালির বাংলাদেশ। ক্ষুদিরাম, মাস্টার দা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ শহীদ যে পথ দেখিয়ে গেছেন সেই পথেই নূর হোসেন যুক্ত হলেন আরেক স্বাধীনচেতা আত্মোৎসর্গকারী যুবক হিসেবে। নূর হোসেনের রক্তে রঞ্জিত, অর্জিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে চলছে জঙ্গি মৌলবাদী গোষ্ঠীর উন্মত্ততা, অতিসম্প্রতি চিরায়ত বাংলা ও বাঙালির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন নষ্ট করার জন্য চলছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ, মন্দিরে আগুন, দুয়েক বছর আগে যা হয়েছিল রামুতে বৌদ্ধ বিহারে। আজ আমরা এই দিনটিকে স্মরণ করব বাংলা এবং বাঙালির চিরায়ত বন্ধনকে কোনো অসুর শক্তি যেন ক্ষতবিক্ষত করতে না পারে এই প্রত্যাশায়। গণতন্ত্র ও উন্নয়নের যে পতাকা দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাতে উড্ডীন, তা যেন নিরাপদ থাকে। আদর্শ বিচ্যুত, আশ্রিত কিছু পরগাছা এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি একের পর এক মিলেমিশে চেষ্টা করছে এই সম্প্রীতির বন্ধনকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশকে অকার্যকর করার। কিন্তু বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে বহুদূর, সব অসাম্প্রদায়িক শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মধ্য দিয়ে তা এগিয়ে যাবে নিরন্তর। আমরা আছি, ছিলাম এবং থাকব। গণতন্ত্র এগিয়ে যাবে শোষণ মুক্তির অভীষ্ট লক্ষ্যে। নূর হোসেন তুমি ঘুমাও শান্তির পতাকাতলে, যে অমিত তেজ নিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছ সেই বাংলাদেশ যেন প্রতিমুহূর্তে দৃশ্যমান হয়। অমরত্ব লাভ করুক তোমার আত্মত্যাগ।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য নেতা

সর্বশেষ খবর