বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

আমাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ

ড. আতিউর রহমান

আমাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ

বিশ্ব-মন্দার এ চ্যালেঞ্জিং সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শুধু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সংকীর্ণ ভূমিকা পালন করলে চলবে না। আরও উন্নয়নমুখী, আরও বড় পরিসরে অনেক অংশগ্রহণকারীর সঙ্গে তাকে কাজ করতে হবে। উদ্দেশ্য ব্যাংকগুলোকে আরও উদ্ভাবনীমূলক কাজে উৎসাহী করে তোলা। ব্যক্তি খাত ও সরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয়ের কাজটিও কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই করতে হবে।  সরকারের ভিতরে নয়া ভাবনার কেন্দ্র হিসেবে তাকে নয়া আদলে পরিচিত হতে হবে।  অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করাও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম একটি কাজ হতে পারে।

বাংলাদেশ মূলত কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র এক অর্থনীতি হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে কম খরচের এক বিরাট শিল্পায়নের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। পাশাপাশি চলছে নগরায়ণের ধারাও। এর জনশক্তি বয়সে তরুণ। তাই এর সম্ভাবনা যেমন বিপুল, চ্যালেঞ্জও তেমনি তীব্র। একমাত্র গণতান্ত্রিক পরিবেশেই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তার পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। আমরা এরই মধ্যে লক্ষ করেছি শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্তিমূলক সচল এক প্রবৃদ্ধির ধারায় দৃপ্ত পদে এগিয়ে চলেছে। এর সুফল হিসেবে দ্রুত দারিদ্র্য মোচন ও জীবনের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ধারা চালু থাকায় আমাদের সামাজিক সংহতি অনেক দেশের চেয়ে ভালো। সম্প্রতি গ্রামের দিকে বিপুল হারে মোবাইল আর্থিক সেবাসহ নানা ধরনের সৃজনশীল আর্থিক সেবা যাচ্ছে। কৃষক, নারী উদ্যোক্তা ও অন্য খুদে উদ্যোক্তারাও এর ফলে বড় সংখ্যায় নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করে চলেছে। তাই গ্রামে খুদে অর্থনৈতিক উদ্যোক্তার সংখ্যা বিপুল হারে বেড়েছে। আর তাই চাঙ্গা হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি।

এ পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নয়া ধারার এক মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়। সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে যুগোপযোগী মুদ্রানীতি প্রণয়নের নবধারার এ নীতিকে অংশগ্রহণমূলক হতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে। মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি দেশের উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মতো মৌল বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে নতুন সৃজনশীল এ মুদ্রানীতি চালু করে এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে আরও গুণমানের করা যায় সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন, বিশেষ করে, সবুজ অর্থায়নে গুরুত্ব প্রদানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং নিচের দিকে অর্থনীতির ভিত্তি ভূমিকে প্রশস্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মুদ্রানীতি কী করতে পারে, আর কী করতে পারে না সে বিষয়টি মাথায় রেখেই আমরা নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা নেওয়ার পথ বেছে নিয়েছি। চলমান বিশ্ব আর্থিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক একদিকে যেমন স্বল্পমেয়াদি ব্যবসায়ী চক্রের সংকট মোকাবিলায় মনোযোগী ছিল, একই সঙ্গে সামাজিক ও পরিবেশগত দায়িত্ব ব্যাংকারদের মনোজগতে যুক্ত করে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল আর্থিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার বিষয়টিকেও সমান গুরুত্ব দিয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রযুক্তিগত ও বাজার সম্পর্কিত অবকাঠামো আধুনিক করেছে এবং পাশাপাশি রেগুলেশন কাঠামোর উন্নয়ন ও পুনঃঅর্থায়নের নয়া কাঠামো স্থাপন করেছে। লক্ষ্য ছিল, অর্থ সঞ্চালনের পথ সুগম করা, অন্তর্ভুক্তি, রেগুলেশন এবং তত্ত্বাবধান উন্নততর করে ম্যাক্রো অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা এবং আরও উৎপাদনশীল ও টেকসই উন্নয়ন পদ্ধতিকে উৎসাহ দেওয়া।

 

 

একটা সময় ছিল যখন আমাদের দেশে সুদের হার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেঁধে দিত। ধীরে ধীরে এ নীতিকে উদার করা হয়েছে। এখন বাজারনির্ভর সুদের হার ও বিনিময় হার চালু রয়েছে। তবুও সবুজ অর্থায়নের মতো কিছু ক্ষেত্রে সুদ ভর্তুকির ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। তবে এখন ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব অংশীদারের সঙ্গে আলাপ করেই মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়। এটা এর নতুন দিক। ব্যাংকগুলোর কাছে বাজারের অনেক খবর থাকে। তাই তাদের সঙ্গে আলাপ করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি প্রণয়ন অনেকটাই বাস্তবসম্মত করা সম্ভব হয়। যারা ব্যাংকের সেবা পান না তাদের কাছে সেবা পৌঁছানো এবং সমাজ ও পরিবেশের পক্ষে কাজ করার জন্য ব্যাংকগুলোকে উৎসাহ দেওয়া আমাদের নয়া মুদ্রানীতির অনন্য এক বৈশিষ্ট্য।

প্রযুক্তির সম্প্রসারণ এবং দীর্ঘমেয়াদি বাজারভিত্তিক উন্নয়নে সহযোগী করে ব্যাংকগুলোকে সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ববোধে পোক্ত করার এ উদ্যোগ নয়া মুদ্রানীতির অন্যতম উজ্জ্বল এক চেহারায় উন্নত করতে সহায়ক হয়েছে। উদ্ভাবনমুখী এ মুদ্রানীতির অনুষঙ্গ হিসেবেই আর্থিক অন্তর্ভুক্তির নানামাত্রিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মুদ্রানীতিকে কার্যকর করার জন্য আর্থিক লেনদেনকে যেমন প্রযুক্তিনির্ভর করা হয়েছে, তেমনি আবার গরিবমুখীনও করা হয়েছে। ডিজিটাল লেনদেন যেমন বেড়েছে তেমনি আবার কৃষক, বিশেষ করে বর্গাচাষিকে অভিনব উপায়ে ঋণ দেওয়ার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। মাত্র ১০ টাকা জমা দিয়ে দেড় কোটিরও বেশি কৃষক তাদের হিসাব খুলতে পেরেছেন। ওই হিসেবে কৃষি ভর্তুকির টাকা যাচ্ছে। বিদেশ থেকে রেমিট্যান্সও আসছে। এ হিসাবধারীদের ২৬ হাজারেরও বেশি মানুষ পুনঃ অর্থায়নের মাধ্যমে নতুন করে ঋণ পেয়েছেন। এমনকি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও নিজেদের ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ পেয়েছে। এর পাশাপাশি, মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ দ্রুত টাকা লেনদেন করতে পাছেন। প্রতিদিন সাতশ কোটি টাকারও বেশি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আজকাল লেনদেন হচ্ছে। ঢাকা শহরের প্রায় আশি শতাংশ রিকশাওয়ালা প্রতিদিন গ্রামে তাদের পরিবারের কাছে টাকা পাঠাচ্ছেন। গ্রাম থেকে বাবা-মা শহরের পাঠরত ছেলেমেয়েদের নিয়মিত টাকা পাঠাচ্ছেন। নিচের দিকের মানুষের আর্থিক লেনদেনে সত্যি সত্যি এক বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন  এসেছে।

কৃষি ঋণ, মোবাইল আর্থিক সেবার পাশাপাশি এদেশের খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তা বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের এক বিরাট অংশ ব্যাংকের ঋণ পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃ অর্থায়নের সুযোগ প্রথমে নারী উদ্যোক্তারাই পাচ্ছেন। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সবুজ অর্থায়ন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইডকল ৪৫ লাখেরও বেশি পরিবারের কাছে সৌর প্যানেল জোগানের জন্য আর্থিক সমর্থন দিতে পেরেছে। ব্যাংকগুলো বায়ু গ্যাস, ইটিপি, সবুজ বস্ত্র কারখানা স্থাপন, সৌর সেচসহ নানামুখী সবুজ অর্থায়ন সেবা দিচ্ছে। সারা পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের এ অন্তর্ভুক্তি ও সবুজায়ন রূপান্তর দেখে অভিভূত।

এ নয়াধারার মুদ্রানীতির সুফল আমরা এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছি। আমাদের প্রকৃত অর্থনীতির আকার বাড়ছে, আর্থিক খাতও স্থিতিশীল হচ্ছে। আমাদের সঞ্চয়ী ও ঋণগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়ছে। আর্থিক খাতে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারও বাড়ছে। আমরা উন্নত দেশের মতো হেলিকপ্টার দিয়ে যেখানে সেখানে টাকা ফেলিনি, বরং গরুর গাড়িতে করে উৎপাদনশীল খাতে টাকা ঢেলেছি। তার সুফল আমরা বাড়তি উৎপাদন ও সার্ভিসে দেখতে পাচ্ছি। এসব সত্ত্বেও আমাদের সামনে রয়ে গেছে অনেক চ্যালেঞ্জ। পুরোপুরি বাজারনির্ভর অর্থবাজারে রূপান্তর প্রক্রিয়ায় নানা টানাপড়েনের কথা মাথায় রেখে আমাদের এগোতে হবে।  ঝুঁকিগুলো কী করে কমানো যায় সে কথাটি আরও গভীরভাবে মনে রাখতে হবে।

রাস্তা প্রতিবন্ধকতামূলক হতে পারে, তবে সবাই মিলে একসঙ্গে হাঁটলে নিশ্চয় টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব।  তখন নয়া ধারার মুদ্রানীতির এটিই বড় সাফল্য হিসেবে দেখা দেবে।

(১৪ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজে উপস্থাপিত বক্তৃতার সারাংশ)

     লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।

সর্বশেষ খবর