বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

কিংবদন্তির মহানায়ক মওলানা ভাসানী

শেখ শওকত হোসেন নিলু

কিংবদন্তির মহানায়ক মওলানা ভাসানী

মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ইতিহাসের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন তিনি। ইতিহাসের মহানায়ক মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর পাসপোর্ট অনুসারে তার জন্ম ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর। মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলীর খেলাফত আন্দোলনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই মওলানা ভাসানী রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। আসামে ‘বাঙ্গাল খেদাও’ অভিযানের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ভাসানচর নামক স্থানে এক ঐতিহাসিক প্রতিবাদ সম্মেলন আহ্বান করেন। সেখানেই তাকে ভাসানী উপাধি প্রদান করা হয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আসাম ও বাংলায় জনপ্রিয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পাকিস্তানের রাজনীতিতে মওলানা ভাসানীই প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। ভাসানী ওই দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় সর্বদলীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত হন তিনি। সেই সময় শাসকগোষ্ঠী মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শামসুল হককে বিনা কারণে বার বার গ্রেফতার ও জেলহাজতে নিক্ষেপ করে। মজলুম জননেতা ওই সময় ইউরোপ সফর করেন এবং বিশ্বের যুদ্ধবিরোধী শান্তি আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে নিপীড়িত জনগণ ও দেশগুলোর স্বাধীনতার জন্য মতবিনিময় করেন। তিনি বিশ্বশান্তি আন্দোলনের অন্যতম নেতা এটলির সঙ্গে লন্ডনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।

১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগবিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ’৫৪ সালের নির্বাচনে নূরুল আমিনসহ মুসলিম লীগের বড় বড় নেতারা পরাজিত হন। মাত্র ৯টি আসন পায় মুসলিম লীগ। ১৯৫৭ সালে কাগমারিতে এক ঐতিহাসিক সম্মেলন আহ্বান করেন। মজলুম জননেতা সেই সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ‘আসসালামু আলাইকুম’ দিয়ে বলেন, তোমরা ভালো থাকো, আমাদেরও নিজেদের মতো করে ভালো থাকতে দাও। এ রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর মনে স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগিয়ে তোলেন তিনি। তাই মওলানা ভাসানীকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বলে মনে করে এ দেশের ১৬ কোটি মানুষ। এর মাত্র চার মাস পরে নিজ প্রতিষ্ঠিত দল ত্যাগ করে তিনি গঠন করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংগঠনিকভাবে থেকে গেলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে। কিন্তু তার অন্তরের নিবিড় সম্পর্ক রয়েই গেল মওলানা ভাসানীর সঙ্গে। মরহুম কাজী জাফর আহমদের বক্তব্য অনুসারে, ১৯৭৩ সালে তিনি ন্যাপের মহাসচিব মনোনীত হন। সে বছর পবিত্র ঈদ উপলক্ষে পার্টির চেয়ারম্যান মওলানা ভাসানীর জন্য পাজামা-পাঞ্জাবি কেনেন এবং সেটা তাকে উপহার দেন। মওলানা ভাসানী তখন বলেন, কামালের মা (বেগম মুজিব) প্রতি বছর তাকে ঈদের জামা-কাপড় দেন এবং সেই জামা-কাপড় পরেই তিনি ঈদের নামাজ আদায় করেন। সুদীর্ঘ দিন এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। এ থেকে বুঝতে হবে, ভাসানী-মুজিব সম্পর্কের গভীরতা। ১৯৬৯ সালে আগরতলা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি দেওয়ার ষড়যন্ত্র যখন পাকাপোক্ত, তখন নামাজের মোনাজাতের নামে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেন মওলানা ভাসানী। লাখ লাখ ছাত্র-জনতা যুক্ত হলেন তার মোনাজাতে। আওয়াজ উঠল-‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।’

মওলানা ভাসানী ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সমগ্র বাঙালি জাতিকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দেন। ইতিহাসে একমাত্র পণ্ডিত মতিলাল নেহেরু কৌশলে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন নিজ পুত্র পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর জন্য। আর মওলানা ভাসানী পথ ছেড়ে দিয়েছিলেন পুত্রতুল্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য। ১৯৭৩-৭৪ সালে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী আপনাকে শ্রদ্ধা করেন। প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতিবসুও আপনাকে ভালোবাসেন। এরপরেও আপনি ভারতের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন কেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন, ভারত একটি আধিপত্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হবে সম্প্রসারণবাদী হিসেবে। হায়দ্রাবাদ-জুনাগড়-কাশ্মীরকে ভারতভুক্ত করে তারা ভারতের মানচিত্র সম্প্রসারিত করেছে। শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর ব্যক্তিগত বন্ধু। কিন্তু সেজন্য কাশ্মীর অধিগ্রহণ থেমে থাকেনি। সিকিমকেও অধিগ্রহণ করেছে ভারত। শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন জাতীয়তাবাদী নেতার কারণেই বাংলাদেশকে অধিগ্রহণ করতে পারেনি ভারত। মওলানা ভাসানী আরও বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেসব দেশে মিত্রবাহিনী প্রবেশ করেছিল, তাদের সেনাবাহিনী আজও সেসব দেশে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক শিষ্টাচারের কারণেই মূলত বাংলাদেশ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে ভারত।

১৯৭৬ সালের ১৬ মে  গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ পর্যন্ত এক ঐতিহাসিক মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। যে মিছিলকে ফারাক্কা লংমার্চ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। রাজশাহীর তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান ও জেলা ন্যাপের সভাপতি এমরান আলী সরকারকে রিসিপশন কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফারাক্কা লংমার্চ ছাত্র পরিচালনা কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। অসুস্থ অবস্থা সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী ফারাক্কা লংমার্চে নেতৃত্ব দেন। গঙ্গাসহ অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা আদায়ে জাতীয় ঐক্যের বুনিয়াদ সৃষ্টি হয় এই ঐতিহাসিক লংমার্চের মাধ্যমে। বিশ্বের দেশে দেশে বাংলাদেশের পানির ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি সমর্থন বাড়তে থাকে। এমন অবস্থায় মজলুম জননেতা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

লেখক : চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি

সর্বশেষ খবর