শিরোনাম
শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

দয়া করলে দয়া পাবে

মুফতি আমজাদ হোসাইন

দয়া করলে দয়া পাবে

ইরশাদ হচ্ছে, ‘অতঃপর সে ধর্মের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেনি। আপনি জানেন, সে ঘাঁটি কি? তা হচ্ছে দাসমুক্তি। অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে অন্নদান এতিম-আত্মীয়কে অথবা ধূলি-ধূসরিত মিসকিনকে।’ (সূরা বালাদ : ১১-১৬) মিশকাত শরিফের ৩৪০নং হাদিস ‘কওমের নেতা সফরের অবস্থায় তাদের খাদেম থাকবে। যে ব্যক্তি খিদমতের মাধ্যমে তাদের মধ্যে অগ্রগামী হবে কেউ তাকে আমলের মাধ্যমে পেছনে ফেলতে পারবে না।’  তিরমিজি ও আবু দাউদ শরিফে একটি হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে, তা হলো ‘যারা দয়া করে, দয়াময় তাদের প্রতি দয়া করবেন। তোমরা পৃথিবীবাসীর (মানুষ ও জীব জানোয়ারের) প্রতি দয়া কর, তাহলে আকাশের অধিপতি (আল্লাহ) তোমাদের ওপর দয়া করবেন।’ আলোচ্য আয়াত ও হাদিসদ্বয়ের মধ্যে এতিম, মিসকিন ও অসহায়ের প্রতি দয়া, দান-দক্ষিণা করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। মানবসেবা, সৃষ্টির সেবা ও সৃষ্টির প্রতি দয়া করার গুণটির বাস্তব নমুনা ছিলেন হজরত রসুলে করিম (সা.)। সৃষ্টির সেবা নামক এই গুণটি তার মধ্যে যেমনিভাবে নবুয়তপ্রাপ্তির পরও ছিল অনুরূপভাবে নবুয়তপ্রাপ্তির আগেও বিদ্যমান ছিল। প্রথম ওহিপ্রাপ্ত হয়ে তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় দুনিয়ার সব বিপদাপদের সঙ্গিনী হজরত খাদিজাতুল কুবরার (রা.) কাছে পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করলেন। জীবনসঙ্গিনী নিম্নোক্ত বাণী দ্বারা হজরতকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। ‘আল্লাহর শপথ করে বলছি, আল্লাহ কখনো আপনাকে অপমান করবেন না। কেননা আপনি আত্মীয়ের প্রতি সদাচরণ করেন, অসহায় ব্যক্তির বোঝা উঠিয়ে দেন, নিঃস্ব ব্যক্তির অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা করে দেন, মেহমানদের আপ্যায়ন করেন এবং বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতি সহায়তা দান করেন।’ (বুখারি শরিফ) সৃষ্টির প্রতি দয়া এই গুণটিকে সাহাবায়ে কেরামরা নবীজীর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এমনভাবে মুজবুতির সঙ্গে আঁকড়িয়ে ধরেছেন যাকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়ে নিয়েছেন। তারা এতিম ও গরিবদের প্রতি ভালোবাসার বহু দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। হাদিসে এসেছে, এক এতিম বালক রসুল (সা.)-এর কাছে বিচার নিয়ে এলো যে, অমুক ব্যক্তি জোরপূর্বক আমার খেজুর বাগানটি দখল করে নিয়েছেন। এখন আপনার কাছে আমি বিচারপ্রার্থী। ন্যায়পরায়ণতার একজন বাস্তব প্রতীক ছিলেন রসুলে আরাবি (সা.) ন্যায়ের ব্যাপারে তাঁর কাছে আপন-পর ছিল না, মুসলিম-অমুসলিম ছিল না বরং সবাই সমান ছিল। ন্যায়ের ফায়সালা যার পক্ষেই যেত তিনি তার পক্ষেই ফায়সালা দিতেন। এই ব্যাপারে কোনো ছাড় দিতেন না। তিনি এতিম বালকটিকে বললেন বাবা তুমি একটু অপেক্ষা কর বিষয়টি আমি দেখছি। যদি বাগানটি বাস্তবিকই তোমার হয়ে থাকে তাহলে কেউ তা ঠেকাতে পারবে না। তোমার বাগান তুমি পেয়েই যাবে। নবীজীর কথা শুনে বালকটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। মনের অস্থির ভাব দূর হয়েছে। সে শান্ত হয়ে নবীজীর পাশে আগের মতোই চুপ করে বসে রয়েছে। নবীজী মুহূর্ত কালবিলম্ব না করে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ডেকে পাঠালেন। উভয়ের বক্তব্য অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণ করলেন। উভয়পক্ষের বক্তব্য ও সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা গেল খেজুরের বাগানটি অভিযুক্ত ব্যক্তির। এতিম বালকের নয়।

 

 

ইনসাফকার নবীজী তো আর বেইনসাফের ফায়সালা দিতে পারেন না। তাই তিনি অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষেই বাগানের রায় দিলেন। ব্যক্তিটি আর অভিযুক্ত রইলেন না। এদিকে এতিম বালকটির মন যারপরনাই খারাপ হয়ে গেল। সে কাঁদতে লাগল। তাকে এভাবে মন খারাপ ও কান্নাকাটি করতে দেখে নবীজীর চক্ষুযুগল অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল। ছেলেটির কান্নার আওয়াজ নবীজীর হৃদয়ে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করছে। তিনি এতিম বালকটির প্রতি একদৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়েছিলেন। পরে যার পক্ষে রায়ে দিয়েছিলেন তার দিকে তাকিয়ে বললেন ভাই বাগান তো তোমারই। ফায়সালা তোমার পক্ষেই হয়েছে। তবে তুমি যদি এই বাগানটি এই এতিম বাচ্চাটিকে দান করে দিতে তাহলে কতই না উত্তম হতো। মহান আল্লাহ এর বিনিময় তোমাকে জান্নাতে এর থেকে উত্তম, সুসজ্জিত ও মনোরম বাগান দান করবেন। লোকটি নবীজীর কথা শুনল কিন্তু মানবিক চাহিদার কারণে কোনোভাবেই সে বাগানটি দান করতে রাজি হলো না। উক্ত মজলিসে উপস্থিত ছিলেন রসুলের প্রেমিক সাহাবি হজরত আবু দারদা (রা.)। তিনি দেখলেন একটি এতিম বালকের করুণ অবস্থার প্রতি নবীজী একটি আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন, তা পূর্ণ না হওয়ার নয়। নবীজী একটি এতিম বালকের মন খুশি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তা আমরা সাহাবিরা বেঁচে থাকতে অবশ্যই পূর্ণ করতে হবে। তিনি লোকটিকে অনমনীয় দেখে নির্জনে গিয়ে লোকটিকে বললেন আচ্ছা ভাই! তুমি তো তোমার বাগান কোনোভাবেই দান করবে না। তোমার বাগানের পাশে আমার যে বাগান আছে যে বাগানটি তোমার বাগান থেকে আরও উত্তম। আমি যদি তোমাকে ওই বাগানটি দিয়ে দেই তাহলে কি তুমি তোমার বাগানটি আমার সঙ্গে পরিবর্তন করবে? লোকটি সঙ্গে সঙ্গে হজরত আবু দারদার (রা.)-এর কথায় রাজি হয়ে গেল। হজরত আবু দারদা (রা.) তার সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে তত্ক্ষণাৎ নবীজীর দরবারে হাজির হলেন। বললেন, হে আল্লাহর রসুল (সা.) আমি একটি কথা জানতে এসেছি। দয়ার নবী মৃদু মুচকি হাসি দিয়ে বললেন আবু দারদা বল, তুমি কি বলতে চাও। হজরত আবু দারদা (রা.) এতিম বালকটির দিকে আরেকবার স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন। দেখলেন, বালকটি করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার দুই চোখে অশ্রু ডগবগ করছে। ব্যথার ছোঁয়া ফুটে আছে সারা চেহারায়। হজরত আবু দারদা (রা.) করুণভাবে আবেদন করলেন ইয়া রসুলুল্লাহ! আপনি যে বাগানটি এই এতিম বাচ্চাকে দান করতে চেয়েছিলেন, আমি যদি ওই বাগানটি পরিবর্তন করে এই এতিম বালকটিকে দান করি তবে কি আমি জান্নাতে বাগান পাব? হজরত আবু দারদা (রা.)-র কথা শুনে আনন্দে ভরে ওঠে রসুল (সা.)-এর হৃদয়-মন। এক অনাবিল শান্তির প্রলেপ ছোঁয়া দিয়ে যায় তাঁর অন্তরের গহিনে। তাঁর অশ্রুসিক্ত মলিন মুখে স্বর্গীয় এক হাসির আভা ফুটে ওঠে। তিনি উত্তরে বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই  তোমার জন্য জান্নাতে এর থেকে শ্রেষ্ঠ বাগান আল্লাহপাক দান করবেন। প্রিয় পাঠক! রসুল (সা.)-এর কথা শুনে হজরত আবু দারদার মুখেও মধুময় তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। তিনি দুনিয়ার বাগান দান করে জান্নাতের বাগান ক্রয় করে নিলেন। এভাবেই প্রিয় নবী ও সাহাবায়ে কেরামরা দুস্থ, গরিব, এতিম ও অসহায়ের ওপর দয়া করতেন। তাদের প্রয়োজনাদি পুরা করতেন। প্রিয় নবীর উম্মত হয়ে, সাহাবায়ে কেরামদের একান্ত অনুসারী হিসেবে এবং সর্বোপরি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অসহায়, দুর্বল ও অনাথদের প্রতি দয়া করা কি আমাদের কর্তব্য নয়? প্রিয় পাঠক! যদি আমাদের কর্তব্য হয়ে থাকে তাহলে আসুন আমরা সবাই মিলে তাদের ওপর দয়া করি। ইনশা আল্লাহ আমরাও মহান রাব্বুল আলামিনের রহমত ও দয়া পাব।  আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব বারিধারা, ঢাকা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর