শনিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
ইন্দিরা গান্ধীর জন্মশতবর্ষ

তিনি ছিলেন একটি মহাসমুদ্র

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

তিনি ছিলেন একটি মহাসমুদ্র

ইন্দিরা গান্ধী শতবর্ষে পড়লেন। ১০০ বছর আগে ১৯ নভেম্বর এলাহাবাদে একটি রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার ঠাকুরদা মতিলাল নেহেরু, বাবা জওহরলাল নেহেরু, মা কমলা নেহেরু ও পিসি বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত। এলাহাবাদের এ বাড়িটিই ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম একটি কেন্দ্র। এখানেই নিয়মিত আসতেন ভারতের জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। জওহরলাল নেহেরু স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পর বেশির ভাগ সময় জেলে কাটিয়েছেন। বাবার স্নেহ গোড়ার দিকে খুব একটা পাননি ইন্দিরা। অসুস্থ মায়ের সঙ্গেও তার খুব কম সময়ই দেখা হতো। শ্বশুর মতিলাল নেহেরু পুত্রবধূ কমলাকে চিকিৎসার জন্য সুইজারল্যান্ড পাঠান। পুত্র জওহর তখন জেলে। একসময় জেল থেকে বেরিয়ে মেয়ের লেখাপড়ার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন জওহরলাল নেহেরু। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসেন শান্তিনিকেতনে। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের হাতে তুলে দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি তো সময় দিতে পারছি না। ইন্দুকে আপনি একটু দেখবেন।’ গুরুদেবের স্নেহে তার পায়ের কাছে বসে ভারতবর্ষের চরিত্র নিয়ে নানা প্রশ্ন করতেন। পরে একটা জায়গায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ভারতবর্ষ সম্পর্কে জানার আগ্রহ ইন্দিরার মধ্যে যা দেখেছি, তা অনেকেরই ছিল না।’

ছেলেবেলায় মহাত্মা গান্ধী ইন্দিরা গান্ধীকে তিন বছর চরকা কাটা শিখিয়েছিলেন। সে সময় কয়েকজনকে নিয়ে চরকায় সুতা তৈরির একটি দলও তৈরি করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। আগেই উল্লেখ করেছি এলাহাবাদের রাজনৈতিক পরিবারে তার জন্ম। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আলোচনার পীঠস্থান ছিল সেই বাড়ি। সেই পরিবেশেই একটি বালিকার রাজনৈতিক উত্তরণের শুরু। শিশুবেশেই যে রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে তার পরিচয়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার পরিচিতিও বাড়তে থাকে। দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে বসার অনেক আগেই একাধিক রাজনৈতিক গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয়েছে ইন্দিরা গান্ধীকে। দীর্ঘ সময় ধরে দেশ ও দেশবাসীর সেবা করার পর আততায়ীদের গুলিতে মৃত্যু হয় তার। ছেলেবেলা থেকেই সংগ্রামের পর সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে। মৃত্যুর আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন আমাকে সব সময় নাড়া দেয়। আমাদের স্বপ্নের যে স্বাধীন ভারত সেখানে মানুষের জন্য সুন্দর জীবনের বন্দোবস্ত থাকবে। এ কেবল অর্থনীতির প্রশ্ন নয় বা মানুষের জীবনযাত্রার মানের প্রশ্ন নয়, এটা আরও অন্য কিছুর স্বপ্ন দেখায়। ভারতের মানুষের মধ্যে সেই ক্ষমতা আছে যা কিনা অফুরন্ত শক্তির উৎস। এ জোরটাই তাদের সব বাধা অগ্রাহ্য করার এবং কোনো বাধার সামনে নতিস্বীকার না করার শক্তি জোগায়। দেশকে শক্তিশালী করার কোনো সহজ পন্থা নেই। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আমাদের অনবরত লড়াই করে যেতে হবে। আমাদের স্বপ্ন আজও পূরণ হয়নি। এখনো অনেক পথ আমাদের পেরোতে হবে। অতীতে অনেক ভুল হয়েছে, অনেক বাধাও এসেছে। কিন্তু দেশের আপামর মানুষের এই যে আশা তাকে পূরণ করতেই হবে। বর্তমানে ভারতে কট্টরপন্থি হিন্দুত্বের গওয়া চলছে। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ধর্ম সম্পর্কে তার মত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছিলেন, আইন করে ধর্মকে মোছা যায় না। বহু দেশ চেষ্টা করেছে, পারেনি। ভারতের মানুষ তো আর সব দেশের থেকে বেশি ধর্মপ্রাণ। আপনি তাদের ধর্ম থেকে সরাতে পারবেন না। আমাদের চেষ্টা হওয়া উচিত ধর্মের মূল শিক্ষা থেকে যেন আমরা সরে না যাই সেদিকে লক্ষ্য রাখা। সব ধর্মই তো সৌভ্রাতৃত্বের কথা বলে। জীবনের কথা, জীবন উৎসর্গের কথা। মানুষের সেবার কথা বলে। এই বোধকে নিশ্চয়ই ছড়িয়ে দিতে হবে। কারণ, এটাই আমাদের ঐতিহ্য। কিন্তু ধর্মের তো আরও দিক রয়েছে। যাকে দূরে রাখতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো আপনি সেটা সবাইকে মানতে বাধ্য করতে পারবেন না। ধর্মই আমাদের দেশে প্রধান ঐক্য নির্মাণকারী শক্তি। ধর্মই এখানে মানুষের সব সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়। ভারত হলো সেই দেশ, যার সহ্য করার শক্তি বিপুল। আমি ধর্ম থেকে সরে আসতে বলি না, কিন্তু সময় যত এগোবে, আমাদের তার সঙ্গে তাল রেখে এগোতে হবে। একজন যাত্রী যদি কুসংস্কারে ভোগেন তাহলে তো মুশকিল। তাদের ভেবে দেখতে হবে এই সংস্কার থেকে তার কোনো লাভ হচ্ছে কিনা। আমি ধর্মনির্বিশেষে সব মন্দিরে যাই। এ ঐতিহ্যটাই এতদিন শক্তি জুগিয়েছে ভারতের মানুষকে।

 

 

আমার মনে আছে, নিজের বাড়িতে ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে তার দেহরক্ষীর গুলিতেই তিনি প্রাণ হারান। তিনি যে কোনো সময় খুন হতে পারেন, এ আশঙ্কায় ভুগছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকেই। শুধু ভারতের গোয়েন্দারাই নন, রুশ গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি, ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৬-সহ আরও কয়েকটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থা তাকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিল। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহের গোড়ায় উড়িষ্যার একটি জনসভায় তিনি নিজেই উল্লেখ করেছিলেন যে, তিনি খুন হতে পারেন। পরদিন কলকাতার রাজভবনে তার ওই মন্তব্য নিয়ে কলকাতার সাংবাদিকরা কোনো প্রশ্ন করেননি। তারা প্রশ্ন করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর শাসন নিয়ে। ইন্দিরা গান্ধী সেসব প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি মন্তব্য করেন, তাকে হত্যা করা হতে পারে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি কাল উড়িষ্যায় আর আজ এখানে বললেন, আপনাকে হত্যা করা হবে। কে বা কারা এই ষড়যন্ত্র করছে। আমি বলি, এটা আমার প্রশ্ন শুধু নয়, দেশের মানুষ জানতে চায় কারা প্রধানমন্ত্রীকে মারার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। প্রশ্নটি শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। দৃশ্যতই তাকে উত্তেজিত মনে হচ্ছিল। মঞ্চে তাকে সামলানোর চেষ্টা করছিলেন সিনিয়র দুই কংগ্রেস নেতা। আমিও নাছোড়বান্দা। প্রশ্নের উত্তর আমাকে জানতে হবেই। উনি চিৎকার করে বলেন, তোমরা জান না কোন দেশ আর কারা আমাকে মারতে চায়? তোমরা তাদের নাম লিখছ না কেন? ওই প্রবীণ কংগ্রেসি নেতারা আমাকে ইঙ্গিত করে চুপ করতে বললেন। আমি চুপ করতেই ইন্দিরা গান্ধী উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন। এরপর তার প্রচার সচিব আমাকে এসে বললেন, ম্যাডাম আপনাকে ডাকছেন। ঘরে ঢুকে দেখি ইন্দিরা গান্ধী নিজেই চা বানাচ্ছেন। আমাকে দেখে আবার চিৎকার করে উঠলেন, তুমি তো জান সবই। তাহলে তোমাদের কাগজে লিখছ না কেন? কে মারবে, কেন মারবে সবই তোমরা জান। তাহলে সেটা কাগজে লিখছ না কেন? সেসব পশ্চিমা ষড়যন্ত্রকারীর বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গ কেন ভারতের কোনো প্রান্তেই সংবাদমাধ্যমে লেখা হচ্ছিল না। যারা বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছে, তারাই যে এ ষড়যন্ত্রের পেছনে ছিল তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ের সেই শক্তির এই ষড়যন্ত্রের কারণ হলো এক মহিলার হাতে বিশ্বরাজনীতির পরাজয় তারা মানতে পারছিল না।

৪৫ বছর আগে বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানি হানাদাররা ঝাঁপিয়ে পড়ে ৩০ লাখ মানুষকে খুন করে, ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছে ১ কোটিরও বেশি মানুষ। আমেরিকা ও চীনের সমর্থনে পাকিস্তান ওই হত্যাকারীদের সমর্থন করে। আমার এখনো মনে আছে, মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয় ভারত। ৬ ডিসেম্বর যুদ্ধের অগ্রগতি দেখে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে একটি চিঠি লিখে ওই সরকারকে স্বীকৃতির কথা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ওই চিঠিতে ইন্দিরা লিখেছিলেন : MY COLLEAGUES IN THE GOVERNMENT OF INDIA AND I WERE DEEPLY TOUCHED BY THE MESSAGE WHICH HIS EXELLENCY THE ACTING PRESIDENT SYED NAZRUL ISLAM AND YOU SENT TO ME ON DECEMBER 4. ON ITS RECEIPT, GOVT OF INDIA ONCE AGAIN CONSIDERED YOUR REQUEST TO ACCORD RECOGNITION TO THE PEOPLE’S REPUBLIC OF BANGLADESH WHICH YOU LEAD WITH SUCH DEDICATION. I AM GLAD TO INFORM YOU THAT IN THE LIGHT OF THE CIRCUMSTANCES WHICH PREVAIL AT PRESENT, GOVERNMENT OF INDIA HAVE DECIDED TO GRANT THE RECOGNITION... etc etc.

চিঠিটি তিনি শেষ করেছিলেন এই বলে : I SHOULD ALSO LIKE TO TAKE THIS OPPORTUNITY TO CONVEY THROUGH YOU TO HIS EXCELLENCY SYED NAZRUL ISLAM, ACTING PRESIDENT OF THE PEOPLE’S REPUBLIC OF BANGLADESH THE ASSURANCE’S OF MY HIGHEST ESTEEM. এ চিঠি দিয়ে আমেরিকাসহ সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ নামে একটি দেশকে এবং ওই দেশের সংগ্রামী মানুষকে স্বীকৃতি দিল ভারত। এ স্বীকৃতির পরও ১০ দিন যুদ্ধ চলেছিল। স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতা যারা করছিল তাদের আরও একবার বার্তা দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ভারত স্বীকৃতি দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বীকৃতি দেয় ভুটান। তখন পুরোদমে যুদ্ধ চলছে। ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার অপপ্রচার করতে করতে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়েছে। সম্প্রতি তাদের একটি গোপন বৈঠকে তারা বলেছে, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়নি। সেটা একটা তারিখ মাত্র। গেরুয়া বাহিনী এখন যে কাজগুলো করছে তা সম্পন্ন হলে সম্পূর্ণ হবে ভারতের স্বাধীনতা।

বিশিষ্টজনেরা প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে ভারতীয়রা কি পরাধীন দেশে আছে? ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্লোগান উঠেছিল এশিয়ার মুক্তিসূর্য ইন্দিরা গান্ধী যুগ যুগ জিও। ১৯৭৫ সালের জুনে তিনি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। কেন করেছিলেন তার ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। সে সময় সবচেয়ে বাড়াবাড়ি হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। পরে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে সেন্সরশিপ তুলে নিয়েছিলেন। সেন্সরশিপ থাকার জন্য ওই সময় সব খবর প্রকাশিত হতো না। আমার মনে আছে, আর ভেঙ্কটরামন ভারতের তখন রাষ্ট্রপতি। তিনি গ্যাংটকে ইন্দিরা গান্ধীর একটি মূর্তি উন্মোচন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ইন্দিরা ছিলেন একটি মহাসমুদ্র; যার শুরু বা শেষ নেই।

     লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর