রবিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

দুঃসময় বলে ভাসানীকে মনে পড়েছে বিএনপির

কাজী সিরাজ

দুঃসময় বলে ভাসানীকে মনে পড়েছে বিএনপির

আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিলে এবার দলের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানীর নাম উচ্চারিত হয়েছে। সারা দেশে মওলানার এখনো অগণিত ভক্ত আছেন। নতুন প্রজন্মের অনেকেও তাকে জানার ও বোঝার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ তাকে নিয়ে গবেষণায়ও হাত দিয়েছেন। এরা সবাই আওয়ামী লীগের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। প্রখর দূরদৃষ্টি ছিল মওলানা ভাসানীর।  ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত শাসকদের আচরণে মওলানা ভাসানী স্পষ্ট বুঝেছিলেন, যে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে এই ভূখণ্ডের মানুষ অংশ নিয়েছিল, তা পূরণ করবে না অবাঙালি শাসক-শোষকরা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই পাকিস্তানের শাসকচক্র ছিল পশ্চিমাঞ্চলের শোষকচক্রের স্বার্থের পাহারাদার, তাদেরই প্রতিনিধি। তাদের লক্ষ্য ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ জনগণকে শোষণ-বঞ্চনার মাধ্যমে তারা মোটা-তাজা হবে। শিল্পে বাণিজ্যে, অবকাঠামোগত উন্নয়নে পশ্চিমাঞ্চলই প্রাধান্য পাবে। পূর্বাঞ্চলের জনগণ হবে তাদের সেবক, গোলাম। অঞ্চলটি থাকবে তাদের অধীনস্থ করদ রাজ্যের মতো। সূচনাতেই এই গভীর চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তোলা না গেলে বুকের ওপর থেকে নিষ্ঠুরতার জগদ্দল পাথর সরানো কঠিন হবে। তাই একদা যারা মুসলিম লীগের ঝাণ্ডা উড়িয়ে ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ আন্দোলন করেছিলেন, তাদের মধ্যকার প্রগতিশীল গণতন্ত্রীদের নিয়ে তিনি ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গঠন করেন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ। এ অঞ্চলের মুসলিম জনসাধারণের আবেগের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কৌশলগত কারণে দলের নামের সঙ্গে ‘মুসলিম’ শব্দ যুক্ত করেছিলেন। ১৯৫৫ সালেই মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের বিশিষ্টতা অর্জন করে। ১৭ নভেম্বর ছিল তার মৃত্যুবার্ষিকী। যেভাবে তাকে স্মরণ করা উচিত, সেভাবে স্মরণ করা হয়নি। এটা আমাদের বড় একটা জাতীয় দৈন্য।

আওয়ামী লীগ তাদের কাউন্সিলে মওলানা ভাসানীর নাম উচ্চারণ করলেও তার মৃত্যু দিবসে ভুলেও তার নামটি কোথাও উচ্চারণ করেনি। বিএনপি লোক দেখানো কর্মসূচি নিয়েছিল দুদিনের। তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু করেনি তার মৃত্যুদিবসে। তারা এ উপলক্ষে ঢাকায় একটা বড় সমাবেশ করার সুযোগ নিতে পারত। তাতে সরকার নিশ্চয়ই বাধা দিত না। এই উসিলায় বিএনপি তার রাজনীতির কথা বলার সুযোগটাও নিতে পারত। কিন্তু সে সুযোগও তারা নেয়নি। কারণ মওলানা আজীবন সৎ জীবনযাপন করেছেন, ভোগবাদ ও লুটপাটতন্ত্রের বিরুদ্ধে আদর্শের রাজনীতি করেছেন, পরিবারতন্ত্রের পূজা করেননি, অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে রাজপথ কাঁপিয়েছেন। মওলানার এই রাজনীতিকে জিয়া ভয় না পেলেও বর্তমান বিএনপি ভয় পায়। দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি দলটিকে এখন কাবু করে ফেলেছে। তাদের এখন চরম দুঃসময়। এখন মওলানা ভাসানীকে ব্যবহার করা তাদের প্রয়োজন। তাই ভাসানীর অনুসারী আবদুল্লাহ-আল নোমানের নেতৃত্বে সন্তোষে টিম পাঠায় রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য। অথচ ভাসানীর অনুসারীরা দলে অবমূল্যায়িত, অবহেলিত। আবদুল্লাহ-আল নোমানের অবস্থাই বা কি?

বলা হয়ে থাকে, মওলানা ভাসানী এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম সারির প্রায় সব নেতার নেতা। তার শিষ্যরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারে যোগ দিয়ে ক্ষমতার স্বাদ নিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে তার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেননি। ক্ষমতা হারালে আবার প্রয়োজন হয়েছে তাকে ব্যবহার করা। তার শিষ্য এখনো অনেকে আছেন। মন্ত্রী-মিনিস্টার হয়েছেন। গদিতে থাকতে তার নাম মুখেও আনেননি। যেন তাহলে ‘বৌ তালাক’ হয়ে যাবে। এখন অনেকে আবার তার জন্য অঝোরে কাঁদেন। কী বিচিত্র আমাদের রাজনীতি! বাহান্নর মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের তিনি ছিলেন প্রধান প্রেরণাদাতা পুরুষ। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের তিনি ছিলেন সভাপতি। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন তিনি। স্বাধীনতা আন্দোলনে তার গৌরবদীপ্ত ভূমিকার কথা জাতি এখনো স্মরণ করে শ্রদ্ধাভরে। কিন্তু ভারতের মাটিতে কার্যত তিনি ছিলেন বন্দী। সে স্মৃতি জাতির অন্তরকে বেদনায় নীলও করে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মানুষের দুঃখ, শ্বেত সন্ত্রাস, ভয়াল দুর্ভিক্ষ চির বিদ্রোহী মওলানা ভাসানীকে অস্থির, চঞ্চল করে তোলে। আবার মাঠে নামেন তিনি। দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহের মশাল জ্বালেন। চুয়াত্তরের মানব-সৃষ্ট ভয়াল দুর্ভিক্ষের মোকাবিলায় সরকারের অযোগ্যতা, ব্যর্থতা এবং অবহেলার বিরুদ্ধে মওলানার নেতৃত্বে ঢাকায় ভুখা মিছিল এখন ইতিহাসের অংশ। দুর্ভিক্ষ রোধে কার্যকর ব্যবস্থার দাবিতে আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ক্ষমতার মসনদে সেই যে ধাক্কা লেগেছিল, তা আর সামলাতে পারেননি তিনি।

দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের সংগ্রামে মওলানা ভাসানী এখন এদেশের জনগণের প্রেরণার উৎস, সব ধরনের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানীই প্রথম প্রতিবাদী নিশান ওড়ান। বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করে গঙ্গা নদীর পানি লুণ্ঠনের চক্রান্তের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ আধিপত্যবাদবিরোধী সাহসী সংগ্রামের মাইলফলক। মহান দেশপ্রেমিক মওলানা ভাসানী সব সময়ই ছিলেন শোষকদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। কিন্তু ব্রিটিশ, ভারত, পাকিস্তান এবং সব দুঃশাসনের সময় সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মওলানা বারবার হুঙ্কার ছেড়ে বলেছেন— ‘খামোশ’।

দেশের আজাদী রক্ষা, গরিব-দুঃখী তথা জনগণের কল্যাণ সাধন এবং আধিপত্যবাদী আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির যে পতাকা তিনি ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন, মৃত্যুর আগে সে পতাকা তিনি হস্তান্তর করে যান এদেশের ‘রাখাল রাজা’-খ্যাত শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে। জিয়ার দল এখন সে পতাকা দৃঢ়ভাবে ধরে রাখতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।

 

 

মওলানা ভাসানী তখন ইউরোপে।

বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন সভাপতি বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জুলিও কুরির আমন্ত্রণে বার্লিনে অনুষ্ঠিত শান্তি পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে যোগদানের জন্য ইউরোপের মাটিতে পা রেখেছিলেন তিনি।

লন্ডন থেকে স্টকহম আর স্কটল্যান্ড থেকে রোম— যেখানে গেছেন, সেখানেই চারদিক থেকে ঘিরে ধরে মানুষ। দারুণ ঔত্সুক্য সবার— কে এই মওলানা? কী চান তিনি? কেউ বলেন ‘মিস্টার মুলানা’ একজন অগ্নিবর্ষী বক্তা, ‘কেউ বলেন পূর্ব আকাশের উজ্জ্বল ধ্রুবতারা। পুঁজিপতিরা বললেন তিনি কমিউনিস্ট, আর বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরা বললেন তিনি ইসলামী সাম্যবাদের এক নতুন প্রেরণা।

মওলানা ভাসানীর আসল পরিচয় ফুটে উঠল তার স্ব-কণ্ঠ ঘোষণায়। দৃঢ় প্রত্যয়ে তিনি বললেন, ‘এজিদ-নমরুদদের জালেম বংশধরদের বিরুদ্ধে সারা দুনিয়ার মজলুমের বেঁচে থাকার যে সংগ্রাম চলছে, আমরা সেই সংগ্রামের শরিক। আমরা সকল দেশের সকল মানুষের বন্ধুত্ব প্রত্যাশী। যুদ্ধ আর ধ্বংস আমাদের কাম্য নয়- আমরা চাই শান্তি আর সৃষ্টি। এই হচ্ছে আমার ইসলামের মূল শিক্ষা।’ (‘ভাসানী যখন ইউরোপে’ খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, পৃষ্ঠা-১৭)

চিন্তায়-চেতনায় আলোকিত, প্রতিজ্ঞায় অটল, বক্তব্যে স্পষ্ট ও নির্ভীক মওলানা বিস্ময়ে হতবাক করে দিলেন সবাইকে। অনেক বিশ্ব মনীষী ছুটে এলেন তাকে আরও জানার, আরো বোঝার দুর্নিবার আকর্ষণে। এলেন এটুলি, এলেন বিভান। আরও এলেন হারবার্ট মরিসন, মরগান ফিলিপস, নোবেল বিজয়ী দার্শনিক লর্ড রাসেল। এরাই শুধু নন, দল বেঁধে এলেন ইংল্যান্ডের তৎকালীন সেরা বুদ্ধিজীবী ‘নিউ স্টেটসম্যান অ্যান্ড নেশন’ পত্রিকার সম্পাদক কিংসলে মার্টিন, চিলির বিপ্লবী কবি পাবলো নেরুদা, সোভিয়েতের কালজয়ী ঔপন্যাসিক ইলিরা ইরেনবার্গ, আর তুরস্কের দার্শনিক কবি নাজিম হিকমত। এর আগে তারা কোনো দিন মওলানা ভাসানীকে দেখেননি। মওলানা তাদের সামনে জ্বললেন প্রদীপ্ত সূর্যের মতো। চোখের তারায় ভাসিয়ে তুললেন তার স্বপ্ন। সে স্বপ্ন— সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার। তিনি যেন গান শোনালেন সংগ্রামের— জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের, দাসত্বের বিরুদ্ধে আজাদীর।

‘ইউরোপের যুক্তিবাদী পণ্ডিত, দার্শনিক এবং রাজনীতিকরা মওলানা ভাসানীর চিন্তা, বিশ্বাস এবং কার্যক্রমকে এরিস্টটল থেকে হেগেল, কার্ল মার্কস থেকে হ্যারল্ড লাস্কির তত্ত্বের ছকে মেলাতে চেয়েছেন, চেয়েছেন চীনের সান-ইয়াত সেন, ভারতের সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী, মহাত্মা গান্ধী, মিসরের জগলুল, তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের সঙ্গে মেলাতে। তা-ও মেলেনি। মেলেনি লেনিন, মাও আর হোচি মিনের সঙ্গে।

মওলানা আবার মেলে ধরলেন তাকে। বিলাতের এক কমিউনিস্ট নেতার প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘আল্লাহর দুনিয়ায় সকল মানুষের সমান অধিকার। আল্লাহর নিয়ামত-পৃথিবীর ধনভাণ্ডার, জগতের ঐশ্বর্য আল্লাহর সৃষ্টির জন্যই উৎসর্গিত। মানুষে মানুষে কৃত্রিম অসাম্যের জন্য দায়ী যে বিধান আর সমাজব্যবস্থা, তার উৎপাটন আল্লাহরই নির্দেশ। অসাম্যের বিরুদ্ধে সাম্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আল্লাহর হুকুম।

মানুষ আশরাফুল মখলুকাত-আল্লাহর সেরা সৃষ্টি। এর চেয়ে বড় সম্মান আর হতে পারে না। কিন্তু সে সম্মানের অবমাননা মানুষই করেছে যুগে যুগে। হিটলার-মুসোলিনী তার প্রমাণ। তাদের প্রেতাত্মারা আজো দুনিয়ার বুকে বিভীষিকা সৃষ্টির অপচেষ্টায় বিভোর। ঐশ্বর্যের ঝলসানি আর প্রতাপের দম্ভে ফ্যাসিস্ট শক্তি দুর্বলকে আজ তাদের বুটের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে আবার সদর্পে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। মানুষ আর তার সভ্যতার বিরুদ্ধে এ এক চ্যালেঞ্জ।

আগে রাজা নিজের স্বার্থে যুদ্ধ বাধাতেন, নিজের স্বার্থে যুদ্ধ থামাতেন। কিন্তু একালের মানুষ কোরিয়ার জনগণকে নিশ্চিত মরণের হাত থেকে বাঁচিয়েছে তাদের স্বপক্ষে মৈত্রীর আওয়াজ তুলে। সে আওয়াজ স্তব্ধ করেছে আমেরিকান যুদ্ধবাজদের। সে আওয়াজ মৈত্রীর আওয়াজ, আর নিপীড়িত মানুষের জন্য সে মহান আওয়াজ তুলে দিয়ে গেছেন আমার প্রিয় রসুল (সা.)।

স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। সে অধিকার কারও দয়া বা দান নয়- সে অধিকার খোদাপ্রাপ্ত। তাকে হরণ করার স্পর্ধা মানুষ দেখায় সত্য, কিন্তু সে মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার ক্ষমতাও মানুষের আছে। তার সাক্ষ্য জর্জ ওয়াশিংটন, লেনিন, মাও সে তুং প্রমুখ। আর সাক্ষ্য অগণিত জনতা-যারা বুকের রক্ত দিয়ে, প্রাণ দিয়ে তাদের শক্তি জুগিয়েছিলেন। (খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’)।’

মওলানা ভাসানী তার বিশ্বাসে আমৃত্যু অটল ছিলেন। অন্যায়ের কাছে কোনো দিন মাথানত করেননি। তার হুঙ্কারে কেঁপেছে শোষকের ভিত, জালেম শাসকের মসনদ। গরিব দুঃখী মানুষের জন্য আজীবন লড়ে গেছেন তিনি। ব্রিটিশ বেনিয়া শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তিনি আসামে লাইন প্রথার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রজাসাধারণের হয়ে লড়াই করেছেন সন্তোষের জমিদারের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের আমলা মুত্সুদ্দী দালাল শোষক-শাসকের বিরুদ্ধে। নির্ভীক সংগ্রামের প্রাণপুরুষ ছিলেন মওলানা ভাসানী। ১৯৫৭ সালে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানি শাসকদের ‘আসসালামু আলাইকুম’ জানিয়ে দিয়েছিলেন। বার বার কারারুদ্ধ হয়েছেন, জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কিন্তু কখনো পরাভব মানেননি।

মওলানা ভাসানী নিজের জন্য লড়াই করেননি। তিনি নিরাপস লড়াই করেছেন দেশমাতৃকার জন্য, আপামর জনসাধারণের জন্য। আমাদের সবার সব সংগ্রামে মওলানা ভাসানী ছিলেন চেতনার সূর্য। সে সূর্যালোকে দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদী মানুষের কাফেলা আজো এগিয়ে চলুক দুর্বার গতিবেগে। যতদিন অগণন মানুষের এ মিছিল চলবে, ততদিন শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় বারবার উচ্চারিত হবে মওলানা ভাসানীর নাম। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী যথার্থই লিখেছিলেন, ‘আমাদের সকলের মিলিত সংগ্রাম/মওলানা ভাসানীর নাম’। তিনি এখনো প্রাসঙ্গিক।

নতুন প্রজন্মের কাছে এই মওলানা ভাসানীকে নতুন করে পরিচিত করিয়ে দেওয়া সব দেশপ্রেমিকের জরুরি কর্তব্য।

দেশে এখন নানা বিষয়ে বিতর্ক চলছে। আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র, নাকি উন্নয়ন ও গণতন্ত্র একসঙ্গে? পাকিস্তানিরাও বলেছিল উন্নয়ন আগে। শুরু থেকেই বলেছিল গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে চেঁচামেচি করবে না। কণ্ঠরোধ করার জন্য আমাদের ভাষার ওপরই আক্রমণ হেনেছিল। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচিত সরকার উত্খাত করে ৯২/ক ধারা জারি এবং শেষমেশ ’৫৮ সালে আইউবের মার্শাল ল’। আইউবও বললেন, খবরদার! উন্নয়নে বাধা দেওয়া যাবে না। উন্নয়ন দশকও পালন করলেন। কিন্তু আইউবের ১০ বছরের ‘উন্নয়নে’ আমাদের ভূখণ্ডের জনসাধারণের পেট ভরেনি। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি, গণতন্ত্রের শর্ত ভঙ্গ এবং সশস্ত্র হানার বিরুদ্ধে শুরু আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির যুদ্ধ। কিন্তু আমাদের যুদ্ধ যেন শেষই হতে চায় না। এখনো গণতন্ত্র নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণের রায়কে অগ্রাহ্য করেছিল পাকিস্তানের সামরিক জান্তা। এখন জনগণের রায় নিতেই শাসকরা ভয় পাচ্ছেন বলে দিন দিন অভিযোগ জোরালো হচ্ছে। কিন্তু জনগণের রায় প্রকাশের জন্য নির্মল ভোটাধিকার আদায়ে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে সক্ষমতা দেখাতে পারছে না সরকারবিরোধীরা।  সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির ভরসায় ভুল পথে হাঁটছেন তারা। এ ক্ষেত্রে মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান— বিশেষ করে মওলানা ভাসানী হতে পারেন প্রেরণার উৎস।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর