রবিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বদলে গেছে সমাজের মনমানসিকতা

তপন কুমার ঘোষ

বদলে গেছে সমাজের মনমানসিকতা

কয়েকজন দুর্বৃত্ত মিলে একজন ছাত্রীকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিচ্ছে। আমরা তা দেখে দূরে সরে যাচ্ছি। একটা বখাটে ছেলে একজন পোশাক শ্রমিককে পথের মধ্যে উত্ত্যক্ত করছে। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছি। কলেজছাত্রী খাদিজাকে হত্যার উদ্দেশে একজন বদরুল নৃশংসভাবে চাপাতি দিয়ে কোপাচ্ছে। আমরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে নির্বিকারভাবে তাকিয়ে দেখছি। তাকে বাঁচাতে এগিয়ে যাচ্ছি না। প্রকাশ্য দিবালোকে একজন যুবককে খুন করে বীরদর্পে হেঁটে যাচ্ছে খুনিরা কোনোরকম প্রতিরোধ ছাড়াই। আমরা ভয়ে জড়সড় হয়ে লুকানোর পথ খুঁজছি। পথেঘাটে কেউ দুর্ঘটনায় পড়লে আমরা এড়িয়ে চলছি। তাকে উদ্ধারের জন্য ছুটে যাচ্ছি না। ঝামেলায় জড়াতে চাই না। তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। ঝগড়া হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গেছে। কিন্তু আমরা নির্লিপ্ত দর্শক মাত্র। ঝগড়া থামানোর জন্য উদ্যোগ নিচ্ছি না। এভাবে আমরা সবাই গা বাঁচিয়ে চলছি। এটা কোনো সুলক্ষণ নয়। প্রশ্ন উঠেছে, কোথায় যাচ্ছে আমাদের সমাজ? ইদানীং সংবাদ মাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে  হৈচৈয়ের জেরে এ ধরনের ঘটনাগুলো আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ক্ষোভে ফেটে পড়ছে মানুষ। কিন্তু বখাটেপনা-নির্যাতন-ধর্ষণ এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলা হচ্ছে না। এ দুর্বলতার সুযোগে অপরাধীরা এ সমাজকে মগের মুল্লুক মনে করছে।

কিন্তু আমাদের সমাজ তো এমন ছিল না। আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি, কোনো দুর্ঘটনা হলে দৌড়ে আসতেন প্রতিবেশীরা। বিপদের সময় পাড়ার ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়ত। কোনো বাড়িতে ডাকাত পড়লে হৈচৈ করে ঘিরে ধরত ডাকাত দলকে। জীবনের ঝুঁকি ছিল। কিন্তু পরোয়া করেনি। ডাকাতদের রামদার কোপে কেউ কেউ জীবন পর্যন্ত দিয়েছেন। গ্রামের কোনো বাড়িতে আগুন লাগলে পাড়া-প্রতিবেশীরা সাহায্যের জন্য ছুটে গেছেন। আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছেন। খালের ওপর বাঁধ দেওয়া হবে। আশপাশের গ্রামের শত শত মানুষ জড়ো হয়েছেন স্বেচ্ছাশ্রম দিতে। বিয়েবাড়িতে নিমন্ত্রিত-অনিমন্ত্রিত সবার ছিল দিনভর আনাগোনা। কেউ গেট সাজানোর কাজে ব্যস্ত, আবার কেউবা রান্নার কাজে হাত লাগিয়েছেন। মাঠের ধান পেকে গেছে। ধান কাটতে দেরি হলে ঝরে পড়বে ক্ষেতে। গ্রামের সাধারণ মানুষ একজোট হয়ে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছেন। ‘বেগার’ দিয়ে ফসল তুলে দিয়েছেন গৃহস্থের ঘরে। ছোটখাটো বিবাদ-বিসংবাদ সালিশি বৈঠকে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। সেই সমাজে একের বিপদে অন্যে এগিয়ে এসেছেন; সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন।

সময়ের স্রোতে আমাদের মনমানসিকতা, চিন্তাচেতনা, জীবনধারা, নীতিবোধ বদলে গেছে। এটাই স্বাভাবিক। সমাজের বিবর্তন হয়। সমাজ কোথাও থেমে থাকে না, বহতা নদীর মতোই বয়ে চলে। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের মানসিকতার যে ফারাক এটাকেই বলা হয় ‘জেনারেশন গ্যাপ’। এ বদলে যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের বিবর্তন যদি না-ই ঘটে তাহলে আমরা অগ্রসর হব কীভাবে? আমরা একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকব।

এ বদলে যাওয়াটা স্বাভাবিক। একটা উদাহরণ দেই— পাত্রপাত্রী নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। আজকালকার অধিকাংশ অভিভাবক চান, বিয়ের আগে ছেলেমেয়েরা একে অপরকে চিনুক, জানুক। কিন্তু কয়েক দশক আগের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিভাবকের পছন্দেই ছেলেমেয়ের বিয়ে হতো। তখন বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর মেলামেশাকে ভালো চোখে দেখা হতো না। এমনকি বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর দেখা সাক্ষাৎই হতো না।

সমাজ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিবর্তিত হয়। তবে এটাও সত্য যে, বিবর্তন সব ক্ষেত্রেই যে আগের চেয়ে ভালো কিছু নিয়ে আসে তা কিন্তু নয়। আজকাল একশ্রেণির ছেলেমেয়ে ‘লিভ টুগেদার’ করে বলে শোনা যায়। বৈবাহিক সম্পর্ক ছাড়াই স্বামী-স্ত্রীর মতো একসঙ্গে থাকে। ভাবা যায়! পশ্চিমা সংস্কৃতি আমাদের দেশে আমদানি হয়েছে। আমরা ছিঃ ছিঃ করছি। আমাদের সমাজ এখনো এটাকে গ্রহণ করেনি।

আজকের সমাজ অনেক উন্মুক্ত। জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার ক্ষেত্রে। সন্তানের শিক্ষা এখন অগ্রাধিকার। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রগতি প্রশংসনীয়। যদিও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। গড় আয়ু বেড়েছে। বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটারি ল্যাট্রিন— এসবের ব্যাপারে গ্রামের মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। কুসংস্কার থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে না পারলেও শিক্ষার প্রসারের ফলে এর প্রভাব কমেছে। জিন তাড়ানো, বাটি চালান, পানি পড়া, তাবিজ-কবজের প্রতি মানুষের আস্থায় চিড় ধরেছে। ঝাড়-ফুঁক, মন্ত্র-তন্ত্রের প্রতি ভরসা না করে গ্রামের মানুষ এখন শহরে আসেন আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা লাভের আশায়। মানুষের আর্থিক সঙ্গতিও বেড়েছে।

মানুষ স্বভাবগতভাবে স্বার্থপর। প্রতিযোগিতামূলক এ বিশ্বে আমরা সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। পরের জন্য ভাবার সময় কই? ‘ফ্রি লাঞ্চ’ বলে কিছু নেই। মানুষ টাকা ছাড়া কাজ করতে চায় না। কিন্তু মানুষের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছেন, এমন মানুষের সংখ্যা কম নয় এ উপমহাদেশে। বিপদে-আপদে মানুষ মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে এটাই তো মানব ধর্ম, এটাই মানবতা।

সমাজ এগিয়ে গেলেও হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মানবিক মূল্যবোধ, যা সুস্থ সমাজ জীবনের জন্য অপরিহার্য। তাই বলে আমরা প্রগতি বিরোধী নই। আমরা বিবর্তন চাই।  আবার একই সঙ্গে ফিরে পেতে চাই হারিয়ে যাওয়া মানবিক মূল্যবোধগুলো। সেই মূল্যবোধগুলো আর কি কখনো প্রতিষ্ঠিত হবে না আমাদের সমাজ জীবনে?

লেখক : সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর