মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

শপথ বনাম প্রতিজ্ঞা

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

শপথ বনাম প্রতিজ্ঞা

চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্ররা চিকিৎসাবিদ্যার শুরুতে একটি শপথ নেন, যা তাদের শিক্ষক পাঠ করেন এবং তারা তা সমস্বরে পাঠ করে উদ্বেলিত হন, পবিত্র এ শপথ তাদের সত্যিকার চিকিৎসক এবং মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষে গড়ে তুলবে এই থাকে শিক্ষক এবং ছাত্রদের যৌথ প্রত্যাশা। প্রথম দিনের পরিচিতি সভায় অনেক শিক্ষক ও নবাগতের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে, সর্বশেষ হিপোক্রেট সাহেবের শপথবাক্য পাঠের মধ্য দিয়ে, কখনো কখনো সংগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে এ মনোমুগ্ধকর ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয়। ঐতিহাসিক বললাম এ কারণে শপথটা একটা চিকিৎসকের জীবনের ঐতিহাসিক ঘটনা।

কোনো শপথ বা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার মতো মহাপাপ আর কিছুই হতে পারে না। শপথ এক ধরনের দায়বদ্ধতা। বর্তমানের কোনো যুক্তি দিয়ে যার হেরফের করা যায় না। অতীতের প্রতি এমন দায়বদ্ধতা সম্পর্কে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে। অনেকেই আবার অতীতের প্রতিজ্ঞা যেমন করেই হোক রক্ষা করা এক পুণ্যকর্ম, তা বিশ্বাস করেন না এমনকি তার বিরোধী। একবার গান্ধীজি রবীন্দ্রনাথের এক বন্ধু কন্যার অটোগ্রাফের খাতায় লিখেছিলেন, ‘না ভেবেচিন্তে কোনো প্রতিজ্ঞা করো না, একবার যদি প্রতিজ্ঞা করো, প্রাণ দিয়েও তা রক্ষা করবে।’ কিছুকাল পরে এই লেখা দেখে রবীন্দ্রনাথ বিচলিত হয়ে উঠলেন এবং ওই খাতাতেই একটি ছোট কবিতায় লিখলেন :

‘তোমারে করিবে বন্দী নিত্যকাল মৃত্তিকা শৃঙ্খলে সাধ্য আছে কার’

তারপর সম্ভবত গান্ধী যাতে পড়তে পারেন সেই জন্য ইংরেজিতে তিনি লিখলেন, ‘যদি দেখ প্রতিজ্ঞাটা ভুল, ছুড়ে ফেলে দাও’ কালের বিবর্তনে চিকিৎসাবিদ্যায় হিপোক্র্যাটসের শপথবাক্যটি সংক্ষিপ্ত হলেও পরিবর্তিত হয়নি, তবে ১৯৪৮ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা জেনেভা ডিক্লারেশন নামে, যে সিদ্ধান্তটি দিয়েছেন তাও চিকিৎসকদের প্রতি এক সুদৃঢ় দিকনির্দেশনা অর্থাৎ হিপোক্র্যাটসের শপথনামার পরিবর্ধিত রূপ। চিকিৎসা এবং শিক্ষা অনন্তকাল থেকে মহান পেশা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সুতরাং এর সঙ্গে অন্য  কোনো পেশার তুলনা করা উচিত নয়। এবং চিকিৎসক ও শিক্ষকরা যে অতুলনীয়, সেটা ও ঊর্ধ্বে তুলে ধরার দায়িত্ব তাদেরই। আমি নিজেকে মানবতার সেবক হিসেবে দাবি করব। আচার-ব্যবহারে তার প্রতিফলন ঘটবে না, সে ক্ষেত্রে আমার অবস্থান শ্রেষ্ঠতম স্থান থেকে জনগণ অধঃস্তনে নিয়ে আসবেন। অথবা স্বাভাবিক নিয়মেই নেমে যাবে। শিক্ষক এবং চিকিৎসকের মধ্যেও বিরাট পার্থক্য আছে। চিকিৎসক শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রদের শিক্ষা দেন না, রোগীর রোগ নিরাময়ের ক্ষমতাও তার আছে। তারা শুধু চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্রদের চিকিৎসা দিয়েই ক্ষান্ত হন না। জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে সাধারণ জনগণকে রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কেও শিক্ষা দিয়ে থাকেন। শিক্ষার যেমন শেষ নেই, চিকিৎসাবিদ্যায় নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাবের ঘাটতি নেই, তেমনি আবিষ্কারেরও শেষ নেই, এ যেন প্রকৃতির সঙ্গে চিকিৎসকের নিয়মিত এক স্নায়ুযুদ্ধ।

আমরা আগামীর দিকে তাকিয়ে জীবনযাপন করি। আমরা খাদ্য সংস্থানের জন্য পরিশ্রম করি। মনে রাখতে হবে যে খাদ্য আমি গ্রহণ করছি, তা অন্যের শ্রমের ফসল, যে শ্রমিক ফসল উত্পন্ন করছেন, সে পদে পদে আমাদের দ্বারা বঞ্চিত ও শোষিত হচ্ছে। তার ন্যায্য পাওনা আমরা কেউ তাকে দিচ্ছি না। আমি জীবন ধারণ করছি, আমার দেশবাসীকে লুণ্ঠন করে অথবা তাদের উপার্জনের আংশিক আদায় করে নিয়ে, যেটা আমরা না নিলেও পারতাম। আপনার থলিতে যে টাকা ঢুকছে, খোঁজ করে দেখুন তার একেকটি কড়ি কোথা থেকে আসছে? তাহলেই বুঝবেন এ লেখার মর্মার্থ এবং সুপ্ত হৃদয় হবে জাগ্রত, ভেঙে যাবে দিবা নিদ্রা, জাগ্রত হবে বিবেক।

বাঙালির মন অত্যন্ত সহজ, সরল, ন্যায়পরায়ণ। শিক্ষকতা একটি একমাত্রিক দর্শন, চিকিৎসা পেশা দ্বিমাত্রিক দর্শন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ত্রিমাত্রিক দর্শনের অধিকারী আর লেখক, কবি, রাজনীতিবিদ এরা হলেন বহুমাত্রিক দার্শনিক। কবিগুরু, বিদ্রোহী কবি, গান্ধীজি এবং বঙ্গবন্ধু হলেন বহুমাত্রিক দার্শনিকের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

শৈশবের চিন্তা এবং নিষ্পেষণ, যৌবনের বিপ্লবী চেতনা, পরবর্তী চিন্তা চেতনা, ধ্যান-ধারণা মানুষকে এবং সর্বোপরি জনগণকে ভালোবাসতে পারা এবং সমাজ পরিবর্তনের চিন্তায় যখন কেউ উৎসর্গীকৃত হন তখনই তিনি একজন বহুমাত্রিক দার্শনিক। উপমহাদেশের চিকিৎসকদের এবং চিকিৎসা পেশায় ব্রিটিশ শাসকদের ভূমিকা ছিল শোষণের মতোই। অনাকাঙ্ক্ষিত এবং শোষকের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই তারা এদশে চিকিৎসাবিদ্যা চালু করেছিলেন। যে ব্রিটিশদের দেশে চিকিৎসা ছিল ফ্রি, সেই ব্রিটিশ কর্তৃক উপমহাদেশের চিকিৎসা শিক্ষায় এক শোষণের প্রক্রিয়া তারা চালু করে গেলেন। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে মানুষের মৌলিক পাঁচটি অধিকার ছিল রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং রাষ্ট্র সে দায়িত্ব নিয়েছিল বলেই জনগণকে চিকিৎসার জন্য একটি কড়িও ব্যয় করতে হয়নি।

হিপোক্র্যাট শপথ এবং জেনেভা ডিক্লারেশেনের মাধ্যমে আমরা যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, সেই প্রতিজ্ঞা পদদলিত করে আমরা আজ ধনী হওয়ার নেশায় প্রলুব্ধ, আর তারই ফলশ্রুতিতে প্রতিবছর আনুমানিক পঞ্চাশ লাখ লোক নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে দারিদ্র্যসীমায় নেমে যাচ্ছে, Out of pocket expenditure-এর সূত্র ধরে। ‘যা আমরা চিকিৎসকরা একটু মানবিক গুণসম্পন্ন হলেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। পরিশেষে আবারও বলব’ শিক্ষা ও চিকিৎসা যদি পণ্য হয়ে যায় তবে তার গুণগত মান থাকে না।’ তাই হে ঈশ্বর তুমি সাধারণ মানুষকে এর হাত থেকে রক্ষা কর। শিক্ষা এবং চিকিৎসা যেন সরকারের হাতেই নিরাপদে জনগণের স্বার্থে থাকে।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর