শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

উন্নত চরিত্রের মূর্তপ্রতীক রসুল (সা.)

মুফতি আমজাদ হোসাইন

উন্নত চরিত্রের মূর্তপ্রতীক রসুল (সা.)

মহানবী সা. দুনিয়ার বুকে আগমন করার আগে গগনছোঁয়া আঁধারে কালো এক অধ্যায় অতিক্রম করেছিল সারা পৃথিবী।  ইতিহাসের এক নিকৃষ্টতম অধ্যায়ে পরিণত হয়েছিল সেদিনের আরব বিশ্ব। আল্লাহর সৃষ্টি তামাম মাখলুকাত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল জুলুম ও নির্যাতনের ভারে। নির্যাতন, নিপীড়ন ও শোষণ-অত্যাচারে ভারি হয়েছিল আকাশ, বাতাস আর সমস্ত বৃক্ষরাজি। বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজেও ভেসে উঠেছিল জীবন্ত প্রথিত কন্যার করুণ আর্তনাদ। মানবতা-ইনসানিয়াত নীরবে হাহাকার করছিল। উন্নত চরিত্রের অধিকারী একজন পথপ্রদর্শকের অভাবে দিশাহারা হয়ে পড়েছিল তখনকার আরবের মানবকূল। এমনই এক নাজুক সন্ধিক্ষণে মহান রব্বুল আলামিন দুনিয়াবাসীর প্রতি অনুগ্রহ করে আখেরি ও শেষ রসুল হিসেবে প্রেরণ করেন উন্নত চরিত্রের মূর্তপ্রতীক হজরত রসুলে আরাবি সা.কে। নবীকুল শিরমণি রসুলে কারিম সা. ছিলেন যাবতীয় গুণাবলির সর্বোচ্চ শিখরে অধিষ্ঠিত। তখন থেকে নিয়ে কেয়ামত পর্যন্তের জন্য সমগ্র পৃথিবীর মানুষের চরিত্র গঠনের গুরুদায়িত্ব যাকে অর্পণ করা হয়েছিল। তার সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা পবিত্র কালামে পাকে তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে ঘোষণা করেন ‘হে নবী! নিশ্চয় আপনি উন্নত চরিত্র মাধুরীর ওপর প্রতিষ্ঠিত। (সূরা ক্বলম:৪)। আমাদের আকাবিরে হজরতগণ খুলুক তথা চরিত্রকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। এক. খুলুকে হাসানা তার ওপরে হজরত মূসা আ. প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। দুই. খুলুকে কারীমা, তার ওপর হজরত ঈসা আ. প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তিন. খুলুকে আজিমা। তার ওপরে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন উন্নত চরিত্রের অধিকারী হজরত রসুলে কারিম সা.। আপন চরিত্রের বলিষ্ঠতায় প্রত্যয়ী নবীজী নিজেই বলেন ‘উন্নত চরিত্রের পূর্ণতা সাধনের জন্যই আমি দুনিয়ার বুকে প্রেরিত হয়েছি।’ প্রিয় পাঠক! একজন পুরুষের চরিত্রের জন্য সবচাইতে নির্ভরযোগ্য সাক্ষী তার নিজের সহধর্মিণী। হজরত রসুলে আরাবি সা. এর প্রিয়তমা সহধর্মিণী হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. সাহাবায়ে কেরামদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন ‘পবিত্র কোরআনই হলো রসুল সা. এর পূর্ণ চরিত্র’। অর্থাৎ কোরআনের চাহিদা অনুযায়ী তিনি জীবন পরিচালনা করেছেন। প্রশংসার এ উজ্জ্বল বাণীগুলো ছিল রসুল সা. এর বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। শৈশবকালেও তার জীবন কাননে ফুটেছিল সৎ চরিত্রের অসংখ্য কুসুম ফুল। নানাবিধ গুণাবলি নবুয়ত প্রাপ্তির আগেও নবীজীকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল সমগ্র আরবে একমাত্র আল-আমিন তথা বিশ্বাসীরূপে। বস্তুত নবী কারিম সা. একদিকে যেমন ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী, অন্যদিকে তিনি ছিলেন দয়ামায়ার জীবন্ত প্রতীক এবং ছিলেন শান্তির দূত। তাই তো আমরা পবিত্র কোরআন পাঠ করলে দেখতে পাই আল্লাহতায়ালা তাকে ‘রহমতে আলম’ খেতাবে ভূষিত করেছেন। প্রিয় পাঠক! ধৈর্য ও সহনশীলতা উন্নত চরিত্রের একটি বড় নিদর্শন। রসুল সা. এর এ গুণটি ফুটে ওঠে কোরআন-হাদিসের কিছু ঘটনাবলির দ্বারা। যেমন এক. জনৈক ইহুদি পাওনা টাকা পরিশোধ করার সময়ের আগেই সীমাহীন পীড়াপিড়ি করে রসুল সা. এর প্রতি গালমন্দের সুরে বলল, আপনারা অর্থাৎ আবদুল মুত্তালিবের বংশধররা প্রাপ্য টাকা পরিশোধে অযথা বিলম্ব করেন। এমন কঠিন মুহূর্তেও রসুল সা. উত্তরে রাগান্বিত না হয়ে মিষ্টি ভাষায় বললেন, এখন টাকা হাতে নেই, যখনই টাকা হাতে আসবে আদায় করে দেব। সেই ইহুদি কিছুতেই রসুল সা. এর কথা শুনল না। উপরন্তু বলে উঠল টাকা পরিশোধ করা ব্যতীত কিছুতেই আপনাকে মসজিদ থেকে হুজরাখানায় প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। অপরদিকে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামরা রসুল সা. এর প্রতি দুর্ব্যবহারের কারণে রাগে ফেটে পড়ছিলেন। রসুল সা. সাহাবায়ে কেরামদের বললেন তোমরা রাগ কর না। সে পাওনাদার। তার কথা বলার অধিকার আছে। ফজরের নামাজের পর ইহুদি লোকটি পুনরায় হাজির হয়ে অত্যন্ত বিনীতভাবে আরজি করল যে, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন! আমি আপনার ধৈর্য ও সহশীলতার পরীক্ষা করছি। কেননা তাওরাতে সর্বশেষ নবীর বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে বিশেষভাবে ধৈর্য ও সহনশীলতার উল্লেখ রয়েছে। কথাটি বলেই লোকটি কালিমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেল। সুবহানাল্লাহ! অপর হাদিসে বর্ণিত আছে, রসুল সা. একবার একটি বাবলা গাছের নিছে শায়িত ছিলেন। এমন সময় একজন শত্রু এসে হাতের তরবারিটি উত্তোলন করে অত্যন্ত বীরদর্পে বলে উঠল, এখন তোমাকে আমার হাত থেকে কে রক্ষা করবে? প্রিয় নবী সা. অবিচলিত চিত্তে শান্ত কণ্ঠে বলে দিলেন, ‘আল্লাহ’। এ পবিত্র নামটি শোনামাত্রই তার হাত থেকে তরবারিটি মাটিতে পড়ে গেল। প্রিয় নবী সা. তরবারিটি হাতে তুলে নিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললেন, এখন বল, তোমাকে আমার হাত থেকে কে রক্ষা করবে? উত্তরে সে বলল, আপনি মহৎ ব্যক্তি আপনি উত্তম, আপনিই রক্ষা করবেন। এমন সুযোগ পেয়েও রসুল সা. প্রাণের শত্রুকে ক্ষমা করে দিলেন। এখানে যে ব্যক্তি উদ্যত হয়েছিল তার প্রাণ হরণ করতে তার বিরুদ্ধে নবীজীর কোনোই অভিযোগ নেই। নেই প্রতিশোধ গ্রহণের কোনো ইচ্ছা। এমনকি কোনো বদ দোয়াও করলেন না; বরং নবীজীর দিল থেকে বেরিয়ে এসেছিল লোকটির জন্য হেদায়েত প্রাপ্তির দোয়া। প্রিয় পাঠক! উপরোল্লিখিত আলোচনার মাধ্যমে আমরা কি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না যে আজ থেকে আমরা আমাদের জীবনকে সুন্দর করব। বাস্তবভিত্তিক উন্নত চরিত্র গ্রহণের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব। তাহলেই তো পরকালে নবীজীর সাফায়াতের আশা করতে পারব। মহান রব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে উত্তম চরিত্র গ্রহণের জন্য চেষ্টা করার  তৌফিক দান করুন।  আমিন

লেখক : মুহাদ্দেস, মুফাসসির ও খতিব, বারিধারা, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর