শনিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

অমুসলিমদের নিরাপত্তা সম্পর্কে ইসলাম

মাওলানা মাযহারুল ইসলাম

অমুসলিমদের নিরাপত্তা সম্পর্কে ইসলাম

ইসলাম শব্দের শাব্দিক ও আভিধানিক অর্থ হচ্ছে আনুগত্যের জন্য মাথাকে ঝুঁকিয়ে দেওয়া। আর শরিয়তের পরিভাষায় ইসলাম বলা হয় বিশ্বমানবতার কল্যাণ ও মুক্তির জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কর্তৃক প্রদত্ত জীবন বিধানকে। ইসলাম এমন এক জীবন বিধান যা সব ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। অন্য ধর্মাবলম্বীদের চিন্তা, অনুভূতি ও বিশ্বাসকে ইসলাম সম্মান দেয় এবং তাদের ধর্মীয় ক্ষেত্রে কোনো রকম হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। ইসলাম তার অনুসারীদের অন্য ধর্মের অনুসারীদের সম্পর্কে সহিষ্ণুতার শিক্ষা দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করা হয়েছে ‘লা ইক রহা ফিদ্দিন’ দীনের ক্ষেত্রে কোনো বাড়াবাড়ি নেই।

বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহিষ্ণুতার সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত হলো মানবতার মুক্তির দিশারী মুহাম্মাদে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লিখিত মদিনার প্রথম সনদ। সহাবস্থান ও শান্তির এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল মুসলমান ইহুদি ও মুশরেকদের মধ্যে। মদিনা সনদে লেখা ছিল প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধর্ম নির্বিঘ্নে পালন করতে পারবে। অমুসলিমদের নিরাপত্তার ব্যাপারে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছিলেন, মুসলিম রাষ্ট্রের কোনো ব্যক্তি অমুসলিম নাগরিককে অন্যায়ভাবে হত্যা করলে সে জান্নাতের ঘ্রাণ পর্যন্ত পাবে না। তাদের সম্পদের নিরাপত্তার ব্যাপারে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সাবধান কোনো অমুসলিম নাগরিকের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রহণ করা আদৌ বৈধ নয়। অমুসলিমদের সঙ্গে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তম আচরণ করতেন। মক্কার যেসব অমুসলিম হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতেন এবং তাকে কষ্ট দিতেন, এমনকি তাকে যারা হত্যার পরিকল্পনা করেছেন তাদেরও তিনি ক্ষমা করেছেন। তাদের সঙ্গেও তিনি উত্তম আচরণ করতেন।

ক্ষমা, দয়া ও মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো— মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পথ দিয়ে যেতেন, সেই পথে এক বুড়ি প্রতিদিন কাঁটা পুঁতে রাখতেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কষ্ট পেলে বুড়ি আনন্দ পেতেন। হঠাৎ একদিন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখলেন পথে কাঁটা নেই। তিনি খোঁজ নিয়ে সেই বুড়ির বাড়িতে গেলেন এবং দেখলেন বুড়ি অসুস্থ। তিনি বুড়ির সেবাযত্ন করলেন।

বুড়ি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। চার খলিফার আমলেও অমুসলিমদের প্রতি সহনশীল আচরণ করা হয়েছে। গরিব অমুসলিমদের তারা সাহায্যও করেছেন। একবার ইহুদিকে ভিক্ষা করতে দেখে আমিরুল মুমিনিন, খলিফাতুল মুসলিমিন জিজ্ঞাসা করলেন : ভিক্ষা করছ কেন? বৃদ্ধ ইহুদি জবাব দিলেন সরকারি কর পরিশোধের জন্য। এ ছাড়া আমার জীবিকারও কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই ভিক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছি। উমর (রা.) তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন এবং সরকারি কোষাগার থেকে বড়মাপের সাহায্য দান করেন। আর বলেন, এটা তো ইনসাফের কথা হলো না— যৌবনে আমরা তাকে দিয়ে কাজ করাব, তার শ্রমের দ্বারা উপকৃত হব আর বার্ধক্যে তাকে ছেড়ে দেব আর সে ভিক্ষা করতে বাধ্য হবে।

অমুসলিমদের উপাসনালয়ের প্রতিও ইসলাম অনুকরণীয় সহনশীলতার দৃষ্টান্ত রেখেছে। যুদ্ধের সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য ধর্মের উপাসনালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকদের হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। হজরত উমর ইবনে আজিজ (রা.) তার আমলের গভর্নরদের কাছে এই মর্মে পত্র লিখেছিলেন— যাতে গির্জাঘর ও অগ্নিশালাগুলো অক্ষত থাকে। বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের পর হজরত উমর (রা.) সেখানে গমন করেন। তখন এক পাদ্রীর অনুরোধে একটি গির্জায় তিনি নামাজ আদায় করেন। পরবর্তীতে এই গির্জার স্বীকৃতি স্বরূপ একটি সতর্ককারী পত্র পাঠান। যাতে পরবর্তীকালে এই নামাজকে কেন্দ্র করে গির্জাকে মুসজিদে রূপান্তরিত না করে বসে।

হজরত মুয়াবিয়া (রা.) দামেশকের জামে মসজিদ নির্মাণ করেন। এ মসজিদের পাশেই ছিল খ্রিস্টানদের গির্জা। মুয়াবিয়া (রা.) খ্রিস্টানদের প্রস্তাব দেন ওই চার্চের জায়গাটুকু মসজিদের জন্য দিয়ে দেওয়া হোক। এ জন্য তোমরা যে মূল্য চাইবে তা দিয়ে দেওয়া হবে। এতে মসজিদের আঙিনা প্রশস্ত হবে। খ্রিস্টানরা এ প্রস্তাব রাখতে রাজি হয়নি। মারওয়ান ক্ষমতায় আসার পরও একই ধরনের প্রস্তাব দেন। খ্রিস্টানরা তা নাকচ করে দেয়। এরপর আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান ক্ষমতায় এসে গির্জার জায়গাটি মসজিদের জন্য কিনে নেওয়ার চেষ্টা করেন। অবশেষে তিনি জোশের আতিশয্যে নিজেই কোদাল হাতে নেমে পড়েন। গির্জা ভেঙে মসজিদকে সম্প্রসারণ করেন। হজরত উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রা.) খলিফা হওয়ার পর উমাইয়া শাসকদের অবিচারের প্রতিকার করার উদ্যোগ নেন। ওই এলাকার খ্রিস্টানরা তাদের গির্জার বেদখল হওয়ার বিষয়টি খলিফাকে অভিহিত করেন। তখন হজরত উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রা.) সিরিয়ার গভর্নরকে এই মর্মে পত্র লেখেন যাতে মসজিদ ভেঙে গির্জার জায়গাটি খ্রিস্টানদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। খলিফার উদারতায় মুগ্ধ হয়ে এবং কয়েকজন মুসলমানের সনির্বন্ধ অনুরোধে খ্রিস্টানরা তাদের গির্জা ফেরত পাওয়ার দাবি প্রত্যাহার করে নেয়। পরধর্মের প্রতি সহনশীলতাই যে ইসলাম তা উপরোক্ত দৃষ্টান্ত থেকে স্পষ্ট।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষ দেশ মুক্তির সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। আমাদের দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আমরা একে অপরের ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকব। কেউ অন্য ধর্ম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করব না। অন্য ধর্মের মানুষের অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন কোনো আচরণে জড়িত হব না। হাজার বছর ধরে এ দেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির যে পরিবেশ বিরাজ করছে তা নষ্ট হতে দেব না। দেশের মধ্যে যাতে কোনো ধরনের অরাজকতা মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে সে ব্যাপারে আমরা সতর্ক থাকব।

লেখক : আম্বরশাহ শাহী জামে মসজিদ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর