রবিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

খালেদা জিয়া কি জামায়াত ছাড়া জান্নাতও চান না?

কাজী সিরাজ

খালেদা জিয়া কি জামায়াত ছাড়া জান্নাতও চান না?

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপারসন একটি রূপরেখা পেশ করেছেন এবং তা নিয়ে আলোচনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সহজ-সরলভাবে বিবেচনা করলে একে একটি সৎ উদ্যোগ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু রূপরেখার প্রস্তাবনায় তিনি এ নিয়ে আলোচনার টেবিলে জামায়াতে ইসলামীকেও সঙ্গী করার কথা বলেছেন সুকৌশলে।  কমিশন গঠনের ব্যাপারে তিনি নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল অথবা বাংলাদেশের সংসদের সূচনাকাল থেকে যারা এ পর্যন্ত জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন সেসব দলের প্রতিনিধিদের আলোচনায় ডাকার জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে প্রস্তাব করেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, বেগম জিয়ার রূপরেখায় কোনটা প্রধান— একটি স্বাধীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন, না কি জাতীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা জামায়াতে ইসলামীর সম্মানজনক পুনর্বাসন?

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আলোচনা এখন আমাদের জাতীয় রাজনীতির প্রধান বিষয়। গত দেড়-দুই মাস ধরেই বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে সরবে-নীরবে আলাপ-আলোচনা চলছে। এমন আলোচনার সঙ্গত কারণও আছে। আগামী বছরের (২০১৭) ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ পাঁচ নির্বাচন কমিশনারের) মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তখন নতুন কমিশন গঠন বাধ্যতামূলক। কেমন হবে নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশনারদের নিয়ে গঠিতব্য কমিশন তা নিয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা চলছে। কথাবার্তা চলছে এর নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও। গত ১৮ নভেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত রূপরেখা ঘোষণার পর আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিতর্কেরও শেষ নেই। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ ‘জনতার মঞ্চের’ লোক। বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের একেবারে শেষ প্রান্তে যে কজন সরকারি ঊর্ধ্বতন আমলা সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে আওয়ামী লীগ কর্তৃক স্থাপিত জনতার মঞ্চে ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন এবং প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জনগণের নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কাজ না করার কথা জানিয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছিলেন, বর্তমান সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন তাদেরই একজন। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাকরিরত অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিতে পারেন না। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ এর তোয়াক্কা করেননি। তিনি প্রকাশ্যেই তৎকালীন গণনির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করে আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। অনেক পর্যবেক্ষকই বলেন, সিইসি হিসেবে তার নিয়োগ ছিল লীগ সরকারের একটি পুরস্কার। শুধু প্রধান নির্বাচন কমিশনারই নন, বর্তমান কমিশনে ছাত্রলীগের এমন এক সাবেক নেতা আছেন, যিনি শেখ হাসিনার চেয়েও বড় আওয়ামী লীগার হিসেবে বিরোধী দল কর্তৃক সমালোচিত। বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে মেরুদণ্ডহীন বলে সমালোচনা করার অপরাধে আরেক নির্বাচন কমিশনার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খলেদা জিয়াকে যে ধরনের অশালীনভাবে জবাব দিয়েছেন, আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরাও তেমন অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে বেগম জিয়ার কথার জবাব দেন না। রাজনৈতিক পরিচয় বা কমিটমেন্টের জন্যই নয়, পক্ষপাতমূলক কর্মকাণ্ডের জন্যই তারা কঠোরভাবে আলোচিত, নিন্দিত এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনে দেশ-বিদেশের জনগণ তাদের কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করেছে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪২টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিএনপি, জামায়াত, গণফোরাম, বিকল্পধারা, সিপিবি, বাসদসহ ৩২টি রাজনৈতিক দলই সেই নির্বাচন বর্জন করে। কিন্তু সবাইকে নির্বাচনে নিয়ে আসার কার্যকর কোনো উদ্যোগই তারা গ্রহণ করেনি। অপেক্ষা করেছে মনোনয়নপত্র দাখিলের ঘোষিত শেষ তারিখটির জন্য— যাতে বিএনপিসহ অন্যদের নির্বাচনে ফিরে আসার সব পথ রুদ্ধ করে দেওয়া যায়। আলোচনার কোনো ফাঁকও খোঁজেনি তারা। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে অপশনটি ছিল সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য আলোচনা ও সমঝোতার  চেষ্টা করতে পারত নির্বাচন কমিশন।

 

 

এমনকি সংবিধানের অভিভাবক দেশের সর্বোচ্চ আদালতের পরামর্শ নিতে পারত। কিন্তু কিছুই করেনি কাজী রকিবউদ্দীনের নির্বাচন কমিশন। অথচ টাঙ্গাইল উপনির্বাচনের ক্ষেত্রে কমিশন সর্বোচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে এবং আদালতের পরামর্শে সংবিধান নির্দেশিত সময়ের মধ্যে সে উপনির্বাচনটি করা হয়নি। জাতীয় নির্বাচন তো ছিল আরও গুরুত্বপূর্ণ। একটি ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন করে আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় আনার পাকাপোক্ত ব্যবস্থাই করেছে তারা। ৩০০ আসনের সংসদে ১৫৩ আসনে কোনো নির্বাচনই হয়নি। বিনাভোটে সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতিয়ে দিল আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র রওশন এরশাদের লোকদের। আরও যে ন্যক্কারজনক কাজটি এই নির্বাচন কমিশন করেছে ভবিষ্যৎ নির্বাচন কমিশনসমূহকেও সেই বদনামের বোঝা বইতে হবে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সেই নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। সরকার ও নির্বাচন কমিশন একাকার হয়ে দুই জাপা নীতি অনুসরণ করে এবং রওশন এরশাদকে দিয়ে একটি ‘গৃহপালিত’ জাপা দাঁড় করিয়ে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায়। জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের অনুমোদন ছাড়া দলের অন্য কেউ চেয়ারম্যান পদ দখল করে এ ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। রওশন সমর্থকরা (প্রকৃত অর্থে সরকার সমর্থকরা) মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার না করলেও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, তার ভাই জিএম কাদেরসহ অধিকাংশ জাপা প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু তাজ্জবের ব্যাপার হচ্ছে, আবেদন অনুযায়ী এরশাদের রংপুরের একটি আসনে প্রত্যাহারের আবেদন মঞ্জুর করলেও ঢাকার একটি আসন (গুলশান-ক্যান্টনমেন্ট) এবং রংপুরের একটি আসনে তার মনোনয়নপত্র রেখে দেওয়া হয়। রংপুরের আসনে তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় এবং ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ আসনে তাকে এমন একজনের কাছে হারিয়ে বেইজ্জত করা হয়, যিনি নাকি ওই এলাকার রাস্তাঘাটও ভালো করে চেনেন না। এমন অনেক অবিশ্বাস্য বিস্ময়কর ঘটনার স্রষ্টা কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের বর্তমান নির্বাচন কমিশন। এই কমিশন সম্পর্কে ‘পচা’ অভিজ্ঞতা থেকেই নতুন গঠিতব্য কমিশন নিয়ে এত ভাবনাচিন্তা।

আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনটি কেমন হবে তা বহুলাংশে নির্ভর করবে নতুন নির্বাচন কমিশনটি কেমন হচ্ছে তার ওপর। সংসদে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে যে বিরোধী দল নামক একটি ‘বস্তু’ আছে, সবাই বলে ওটা ‘গৃহপালিত’। সেই ‘গৃহপালিতদের’ কেউ কেউ মাঝে মাঝে বলেন, জনগণ তাদের বিরোধী দল মনে করে না। সে দলের সাহসী ব্যক্তি কাজী ফিরোজ রশিদ একাধিকবার এমন কথা বলেছেন। খোদ দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও এ ব্যাপারে তার বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছেন। ক্ষমতাসীন সরকারের মূল ও প্রধান প্রতিপক্ষই হচ্ছে বিএনপি। তারা ক্ষমতার প্রত্যাশী। সাধারণের মধ্যে এমন একটা ধারণা আছে যে, নির্বাচন নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হলে তাতে বিএনপির ভালো করার কথা। তাই নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপির মাথাব্যথাটা একটু বেশিই হওয়ার কথা। এটা আরও বেশি এই কারণে যে, তারা এখন আর নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে অটল নেই। বলা চলে তারা তাদের সে দাবি থেকে সরে এসেছে। তারা এখন চাচ্ছে ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার’। এই ‘সহায়ক সরকারের’ গঠন প্রকৃতি কেমন হবে সে ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট প্রস্তাব রূপরেখায় না থাকলেও তা দুর্বোধ্য নয়। বোঝা যাচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে এবার কোনো বিরোধ থাকবে না। সবারই মনে থাকার কথা যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি প্রধানত নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতেই বিএনপিসহ অন্যরা নির্বাচন বর্জন করেছিল। সরকার এবং সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হলে সে নির্বাচনে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল বিএনপি। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিনকয় আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে হবে বলে যে দৃঢ় অবস্থানে ছিলেন, সেই অবস্থান থেকে সরে আসেন এবং নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দেন। শুধু তাই নয়, বিরোধী দল বিএনপিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ পছন্দের মন্ত্রণালয়ও বেছে নেওয়ার অফার দেন।

পর্যবেক্ষকমহলের ধারণা, দশম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ব্যাপারে বিএনপির ওপর জামায়াতে ইসলামীর একটা প্রচণ্ড চাপ ছিল। তারা নির্বাচন বর্জনকে কেন্দ্র করে দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিতে বিএনপিকেও জড়িয়ে নেওয়ার সূক্ষ্ম পরিকল্পনা এঁটেছিল। উদ্দেশ্য ছিল, মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমকে পণ্ড করে দেওয়া। পরে সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব আসার পর বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুকূল চিন্তাও নাকি শুরু করেছিল। বিভিন্ন মাধ্যমে সপ্তাহখানেকের জন্য সিডিউল পিছানোর চেষ্টাও করা হয়েছিল বলে তখন গুঞ্জন ছিল। কিন্তু নানা সূত্রে, বিশেষ করে একটি বিদেশি গোয়েন্দা সূত্রে ক্ষমতাসীন দলের ‘ভোটের বাজার’ ভালো নয় বলে তথ্য প্রাপ্তির পর সরকার সিডিউল না পিছানোর ব্যাপারে অনড় হয়ে যায়। সরকার এবং অনেক পর্যবেক্ষকও সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করে বিএনপির সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল বলে এখনো সমালোচনা করেন, কিন্তু সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা ও তাতে ব্যর্থতার কথা প্রকাশ করতে পারছে না বিএনপি। নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে আগের সেই জটিলতা বেগম জিয়ার ‘সহায়ক সরকারের’ প্রস্তাবে অনেকটাই কেটে গেছে। বিএনপি সংসদে না থাকলেও নীতিগতভাবে একমত হলে বর্তমান সরকারপ্রধানের নেতৃত্বেই একটি ‘সহায়ক সরকার’ গঠনের পদ্ধতিগত বিষয় নিয়ে তেমন কোনো জটিলতা সৃষ্টির সম্ভাবনা একেবারেই কম। বেগম খালেদা জিয়ার জোর বা গুরুত্বটা তাই নির্বাচন কমিশন গঠনের ওপর।

নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে আমাদের সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দিয়েছে। তাতে বলা আছে, ১১৮(১) ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’ দুটি বিষয় এখানে প্রণিধানযোগ্য। এক. আইনের যে বিধানের কথা বলা হয়েছে সংবিধানে, তেমন কোনো আইনই এখনো প্রণীত হয়নি, দুই. সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সার্চ কমিটি গঠনের কোনো নির্দেশ নেই। অর্থাৎ সার্চ কমিটির কোনো অস্তিত্ব নেই সংবিধানে। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এর প্রবর্তন করেন। রাষ্ট্রপতি ইচ্ছা করলেই এমন বিধান প্রবর্তন করতে পারেন কিনা তা কেউ চ্যালেঞ্জ করছে না। এর কারণ বোধহয় এই যে, তাহলে এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। সম্ভবত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউই এ সংক্রান্ত আইনটি প্রণয়ন করতে চায় না। আইন করলেই এ ব্যাপারে একটা নীতি সেট হয়ে যাবে। সেই নীতি অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে তা যদি ক্ষমতাসীন সরকারের নির্বাচনে জেতার অনুকূলে ভূমিকা না রাখে তাই তারা এ পথটি খোলা রাখতে চান— যখন যারা ক্ষমতায় থাকবেন তাদের সুইট ডিজায়ার অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠন করা যাবে। বিএনপি তাই সার্চ কমিটির অসাংবিধানিক প্রক্রিয়াটি সমর্থন করছে।

বিএনপির রূপরেখায় দুটি বিষয়ে ঘোর আপত্তি উঠেছে। একটি হচ্ছে বিএনপির জামায়াতপ্রীতি এবং দ্বিতীয়টি নির্বাচনে সেনা নিয়োগ ও তাদের বিচারিক ক্ষমতা প্রদান। সার্চ কমিটি গঠনের আলোচনায় তিনি জামায়াতকেও রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন কৌশলে। নিবন্ধিত সব দল অথবা এযাবৎকালের যে কোনো সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল বলতে তো তাই বোঝায়। এটা মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দানের নামান্তরই বলা যায়। একে বিএনপির ‘মালিকপক্ষের’ বিএনপির জামায়াতিকরণ প্রক্রিয়ার অংশ বলেই ভাবা যায়। এটা বিএনপির জন্য শুভ হবে না। বিএনপি জামায়াত ছাড়াই ভোটে লড়তে পারে। ক্ষমতায় যেতে না পারলেও সংসদে তাদের সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত হতে পারে। নির্বাচনকালে সেনাবাহিনী নিয়োগের প্রস্তাবের পেছনে যুক্তি আছে। সিভিল প্রশাসন বর্তমান সরকারের সাজানো। ওসি, ডিসি, টিএনও-ইউএনও সব দলীয় লোক বলে অভিযোগ আছে। নির্বাচনের আগে গোটা স্থানীয় প্রশাসন নিরপেক্ষ-নির্দলীয় করা অসম্ভব। এই কমিশনের অধীনে সব নির্বাচনে (কয়েকটি সিটি নির্বাচন ছাড়া) স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব মানুষ দেখেছে। ভোটাররা ভোট দিতে পারেনি। সেনাবাহিনী থাকলে মানুষ ভরসা পাবে, নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবে, যাকে খুশি তাকে ভোট দেবে। সেনাবাহিনীর ভূমিকা ততটুকুই থাকা উচিত— কমও নয়, বেশিও নয়। বিচারিক ক্ষমতা প্রদানের দাবিটা বাড়াবাড়িই মনে হয়। এমন একটা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আলাপ-আলোচনা-সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি করে সরকারকে আলোচনার টেবিলে আনা এবং অনুকূল গ্রহণযোগ্য একটা সমাধানে পৌঁছানো জরুরি না কি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের মতো একটি জাতীয় অপরিহার্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আবরণে জামায়াতে ইসলামীকে অন্ধকার থেকে আলোয় আনা, আশ্রয় দেওয়া, পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা খালেদা জিয়ার অপরিহার্য করণীয়? তিনি কি বুঝছেন না যে, জামায়াতকে সঙ্গী করতে চাইলে তিনি নিজেও প্রত্যাখ্যাত হবেন এবং কোনো ধরনের আলোচনা-সংলাপ ছাড়াই গঠিত হয়ে যাবে নতুন নির্বাচন কমিশন? গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের চেয়ে জামায়াতকে সুরক্ষা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা যদি তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে এবারও তার ও তার দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে কারও ভবিতব্য-দৈবজ্ঞ হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। পরিস্থিতি যদি তেমনই হয়, তাহলে বলতে হবে তিনি জামায়াতকে সঙ্গে না নিয়ে জান্নাতে যেতেও রাজি নন।

বেগম জিয়ার রূপরেখার কিছু সমালোচনা থাকলেও এর একটা পজিটিভ দিকও আছে। গুরুত্বপূর্ণ একটি জাতীয় ইস্যু নিয়ে তিনি আনুষ্ঠানিক আলোচনার সূত্রপাত করেছেন। তার রূপরেখা সম্পূর্ণ গ্রহণ করতে হবে তেমন নয়। আবার সম্পূর্ণ নাকচ করে দেওয়াও যুক্তিযুক্ত নয়। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কিসের ভিত্তিতে খালেদা জিয়ার প্রস্তাবকে অসাড় ও অসাংবিধানিক বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন বুঝলাম না। সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠনের যে সিদ্ধান্তের ওপর তারা দাঁড়িয়ে আছেন তা কি সাংবিধানিক? আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো একদল কিছু বললেই অন্য দলের তা নাচক করার রোগটা খুব খারাপ রোগ। এ রোগ সারাতে হবে। আওয়ামী লীগের উচিত নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বেগম জিয়ার রূপরেখা নিয়ে অথবা নিজেরা আরেকটা রূপরেখা দিয়ে তা নিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা শুরু করা।  আন্তরিকভাবে শুরু করলে অবশ্যই এর সফল পরিসমাপ্তি ঘটবে।  সময় কিন্তু বেশি নেই হাতে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর