সোমবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা ইস্যু নিরাপত্তার জন্য বিষফোঁড়া

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

রোহিঙ্গা ইস্যু নিরাপত্তার জন্য বিষফোঁড়া

সমস্যাটি প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের। কিন্তু সেটি এখন বাংলাদেশের জন্য স্থায়ী মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সীমান্তের বিপরীতে মিয়ানমারের সীমান্ত বাহিনীর তিনটি ক্যাম্পের ওপর সশস্ত্র বিদ্রোহীদের আক্রমণের জের ধরে নতুন করে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আলোচনায় এসেছে। আক্রমণে মিয়ানমারের ৯ জন সীমান্ত বাহিনীর সদস্য নিহত হয়। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ধারণা ওই আক্রমণ চালিয়েছে রোহিঙ্গা সশস্ত্র সংগঠন আরএসও (রোহিঙ্গা সোলিডারিটি অরগানাইজেশন)। ফলে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কম্বিং অপারেশনের জের ধরে গত সপ্তাহে কয়েকশত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু পরিবার বাংলাদেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। বিজিবি বেশ কিছু দলকে পুশব্যাক করতে সক্ষম হলেও উদ্বাস্তুদের স্রোত ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ নতুন ঘটনা নয়। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার (আগের নাম বার্মা) স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে কিছু কিছু রোহিঙ্গা পরিবার কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় এসে বসতি গেড়েছে ও সবার সঙ্গে মিশে গেছে। এটা নিয়ে কেউ কখনো মাথা ঘামায়নি। তবে ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, জাতিগত ও ধর্মীয় কারণে মিয়ানমারের মূলস্রোতের সমাজ, রাজনীতি এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বহু আগ থেকেই একটা বড় দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে আছে। ১৯৪৭-৪৮ সালে রোহিঙ্গাদের কিছু স্থানীয় নেতা রাখাইন বা আরাকান অঞ্চলকে পাকিস্তান অর্থাৎ পূর্ব-পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করেছিল, যদিও সেটি তখন তেমন গুরুত্ব পায়নি। সুতরাং ১৯৪৮ সাল থেকেই মিয়ানমারের সর্ববৃহৎ জাতিগোষ্ঠী বার্মিজ এবং তাদের শাসকদের কাছে রোহিঙ্গারা জাতিগতভাবে সন্দেহের পাত্রে পরিণত হয়। বার্মিজ শাসকদের বৈষম্য, বঞ্চনা, নিপীড়ন, নির্যাতনের প্রতিক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে থেকে গড়ে ওঠে বিদ্রোহী সংস্থা, যা এক সময়ে এসে সশস্ত্র সংগঠনে রূপ নেয়। কিন্তু সশস্ত্র তত্পরতা বেশি দূর এগোতে পারে না। কারণ, নিকট প্রতিবেশী কোনো দেশের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া কার্যকর সশস্ত্র তত্পরতা চালানো সম্ভব হয় না। সংগত কারণেই চীন ও ভারতের কাছ থেকে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা পাওয়ার সুযোগ কখনোই ছিল না। আর পাকিস্তান ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সহযোগিতা প্রদানের বিষয় নিয়ে বেশি জড়িত থাকায় রোহিঙ্গাদের প্রতি কখনো গুরুত্ব দেয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকার অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার দৃঢ় নীতির কারণেই রোহিঙ্গা সশস্ত্র সংগঠনের আর কোনো ভরসা থাকে না। কিন্তু পঁচাত্তরের পরে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় টিকে থাকার অবলম্বন হিসেবে উগ্র ইসলামিস্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীসহ জামায়াতের মতো ওয়াহাবিবাদীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে ধর্মীয় গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠায় রোহিঙ্গা সশস্ত্র সংগঠনগুলো নতুন আশায় আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। ফলে ১৯৭৮ সালে মিয়ানমার সরকার সব রোহিঙ্গাকে বিতাড়ন করার উদ্দেশে অভিযান চালায় এবং প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়। সমস্যা সমাধানের বদলে আরও জটিল করে তোলা হয়। এ সমস্যার সঙ্গে বাংলাদেশকে জড়ানোর ফলে সমস্যা আরও বহুমুখী জটিল রূপ ধারণ করে। সাধারণ রোহিঙ্গা নাগরিকদের জন্য মহামানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হলেও সশস্ত্র সংগঠনগুলোর জন্য নতুন সুযোগ আসে। আর এভাবেই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বাংলাদেশের জন্য মহাযন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, অন্যের বোঝা আমাদের মাথায় পড়ে। রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিতে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি দেশের জন্য কত বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে তা এখন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। গত শতকের আশির দশকের মধ্যভাগে পাকিস্তানের সেনাশাসক জিয়াউল হক প্যান ইসলামিজমের নীতি বিস্তারের পরিকল্পনায় বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মতো আরএসওকেও করাচিতে অফিস খোলার সুযোগসহ সব ধরনের সহযোগিতা দেয়, যার ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড হয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশে তখন দ্বিতীয় সামরিক শাসক এরশাদ সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে।

 

 

জামায়াতসহ উগ্র ইসলামিস্টদের পোয়াবারো হয়। রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গ্রুপগুলো কক্সবাজারে অবাধে চলাফেরা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পায়। এর মধ্যে ১৯৮২ সালে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়। সমস্যা জটিল আকার ধারণ করলে ১৯৯১ সালে দ্বিতীয়বার মিয়ানমার সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে আরও প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেয়। মিয়ানমারের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে পারলে তাদের সমস্যা মিটে যাবে। কিন্তু হিতেবিপরীত হয়েছে। এটা এখন বাংলাদেশ ও মিয়ানমার, উভয়ের জন্য বড় ধরনের জটিল নিরাপত্তা সংকটের সৃষ্টি করেছে। ২০১২ সালে একশ্রেণির উগ্র ইসলামিস্টের প্রোপাগান্ডা ও প্ররোচনায় কক্সবাজারে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ওপর যে আক্রমণ হয় এবং ধ্বংসযজ্ঞ চলে তার পেছনেও অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে রোহিঙ্গা ইস্যু। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সম্পর্কে মিয়ানমার সরকারের ভ্রান্তনীতি থেকেই এ সংকটের উত্পত্তি। একটা জনগোষ্ঠীকে বিনাশ-বিতাড়ন করার প্রচেষ্টা কখনোই কোনো সমাধান দেবে না। তবে ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক একটা প্রেক্ষাপট তো রয়েছেই, তার সঙ্গে বাংলাদেশের দুই সামরিক শাসক এবং জামায়াত-বিএনপি সরকার বিষয়টিকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার কারণে আমাদের জন্য এটা এখন একটা বিষবৃক্ষের রূপ ধারণ করেছে। একদিকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তাজনিত সমস্যার সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নেও বাধা হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশের ভিতরে এবং বহির্বিশ্বে রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে বহু রকম স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় উগ্রবাদিতার স্বার্থে এই সংকটকে জিইয়ে রাখতে চায়, পরিপূর্ণ সমাধান চায় না। ফলে দেখা গেল জাতিসংঘের পক্ষ থেকে কফি আনান কমিশন রোহিঙ্গা ইস্যুতে কাজ করার সঙ্গে সঙ্গেই আরএএসও কর্তৃক মিয়ানমারের নিরাপত্তা ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ এবং তার অজুহাতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নতুন করে কম্বিং অপারেশন, নতুন উদ্বাস্তু ও শরণার্থী সমস্যা। ১৯৭৮ ও ৯১ সালে দুই দফায় প্রায় ছয়-সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পাঠাতে সক্ষম হয়। তাছাড়া নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণের ভয়ে এবং ভালো সুযোগের সন্ধানে চোরাই পথে প্রতিনিয়তই বিক্ষিপ্তভাবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। মাঝখানে একবার প্রায় দেড় লাখের মতো রোহিঙ্গাকে ফেরত দেওয়া হয়। এখনো প্রায় পাঁচ লাখের মতো অবৈধ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন জায়গায় এক রকম স্থায়ী বসতি গেড়ে বসে গেছে। বৈধ শরণার্থী হিসেবে আছে মাত্র ২৮ হাজার। কক্সবাজারের স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে নানা রকম অপকর্ম যেমন মানব পাচার, অবৈধ ড্রাগ ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় রোহিঙ্গারাও তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। শোনা যায় বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। এটা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য অশনি সংকেত। এভাবে চলতে থাকলে এক সময়ে কক্সবাজারের সংসদীয় আসনগুলোর জয়-পরাজয়ের বড় ফ্যাক্টর হবে রোহিঙ্গা ভোটাররা। রোহিঙ্গাদের তখন আর ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না। যার সুযোগ নেবে রোহিঙ্গা সশস্ত্র সংগঠনগুলো এবং তাতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ আরও সংকুচিত হয়ে যাবে। স্থায়ী ও অনিরাময়যোগ্য বিষফোঁড়া গায়ে নিয়ে বাংলাদেশকে চলতে হবে। তবে সবচেয়ে বড় সত্য হলো— মিয়ানমার সরকারের সদিচ্ছা ব্যতিরেকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বিদেশি কোনো সশস্ত্র সংগঠন বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় দেওয়া হবে না, এই নীতির সুযোগ নিয়ে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতায় এলে সেটা উভয় দেশের জন্য মঙ্গলজনক হতো। সহজ সমাধানের একটা পথ বের হতো। বাংলাদেশের বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার এই নীতির বাস্তব প্রতিফলন ভারতের সঙ্গে দেখিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। তাই মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশকে আস্থায় নিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তা একটা ইতিবাচক পথের সন্ধান দিতে পারে। কিন্তু তা না হলে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করলে সব রকম সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর আনাগোনা এবং আশ্রয়-প্রশ্রয় শতভাগ বন্ধ করা কখনো সম্ভব হবে না। এর সুযোগ নেবে দেশি-বিদেশি ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এবং বহুরূপী স্বার্থান্বেষী মহল। এটাই বাস্তব ও কঠিন সত্য কথা। কিন্তু মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এখনো তেমন কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না।

নোবেল জয়ী অং সান সু চির দল নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর একটা আশা মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু তিনি সবাইকে হতাশ করেছেন। তবে বাংলাদেশকে বসে থাকলে চলবে না। বিষফোঁড়া নিয়ে বসে থাকার যন্ত্রণা বড় কঠিন যন্ত্রণা। হোমিওপ্যাথি, এলোপ্যাথি, আয়ুর্বেদীয়, সব ওষুধ ও চিকিৎসার সন্ধান করতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কূটনৈতিক তত্পরতা জোরদার করতে হবে। বন্ধুসম তৃতীয় পক্ষকে কাজে লাগাতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে অথবা সুযোগ নিয়ে আমাদের নিরাপত্তার জন্য কেউ যাতে পয়েন্ট অব নো রিটার্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে না পারে তার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা নীতির আওতায় সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]

নিউ অরলিন, আমেরিকা

সর্বশেষ খবর