সোমবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
স্মরণ

ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ

হাবিবুল ইসলাম সুমন

ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ

ঢাকার রাজনীতির মহানায়ক মোহাম্মদ হানিফ। তিনি ছিলেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র। চারশ বছরের প্রাচীন নগরী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ঐতিহ্য আর নানা সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের কারণে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মেগাসিটি। সেই শহরের গৌরবের অপর নাম মোহাম্মদ হানিফ। ১৯৪৪ সালে ১ এপ্রিল পুরান ঢাকার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। পিতা আবদুল আজিজ আর মাতা মুন্নি বেগমের ছোট ছেলে হানিফ।

মোহাম্মদ হানিফ যৌবন থেকে আমৃত্যু আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। উদার চিন্তা-চেতনা ও সংবেদনশীল মনোভাবের কারণে দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল অসামান্য। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন একজন ধার্মিক মুসলমান। তিনি তার প্রিয় ঢাকা নগরীকে ইসলামী স্থাপত্য কলায় সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। নিজের ধর্মবিশ্বাসে অটুট থেকেও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে ছিলেন পরমপ্রিয়। দুর্গাপূজা কিংবা বড়দিন অথবা অন্য কোনো উৎসবে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন। তার সহায়তায় অসংখ্য মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা সংস্কার করা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর্যে মোহাম্মদ হানিফের রাজনীতির হাতেখড়ি। ১৯৬৫ সালে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব নিযুক্ত হন। ছয় দফা আন্দোলনের প্রস্তুতি, ছয় দফা মুক্তি সনদ প্রণয়ন এবং প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর জাতীয় নির্বাচন এবং একাত্তরে মহান মুক্তি সংগ্রামে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা চিরস্মরণীয়।

১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেওয়া ঢাকা-১২ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং হুইপের দায়িত্ব পান। ১৯৭৬ সালে মোহাম্মদ হানিফ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ৩০ বছর এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন মোহাম্মদ হানিফ।

বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন মোহাম্মদ হানিফ ১৯৯৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে ঢাকার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। ঢাকার উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো ভূমিকা রেখেছেন তিনি। রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংস্কারের পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয় ধানমন্ডি লেক এবং আশপাশের এলাকা। ঢাকাবাসীর সুপেয় পানির চাহিদা পূরণে তিনি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ঢাকার সৌন্দর্য বাড়ানো ও নগরবাসীর চাহিদা পূরণে নগরীতে বিজলি বাতি স্থাপন, নগর সৌন্দর্য বর্ধনে ফোয়ারা নির্মাণ, বনায়ন কর্মসূচি, পুরান ঢাকার আউটফলে ছিন্নমূল শিশু-কিশোরদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ করেন। নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী ছিলেন মেয়র হানিফ। নারী শিক্ষা বিস্তারে লক্ষ্মীবাজারে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ। এ ছাড়াও মহিলাদের মাতৃকালীন সময়ে পরিচর্যার জন্য নগরীতে বেশ কয়েকটি মাতৃসদন নির্মাণ করেন। শিশুবান্ধব ঢাকা গড়তে নিরলস কাজ করেছেন নগরপিতা হানিফ। শিশু-কিশোরদের বিনোদনের জন্য পৌর শিশুপার্ক নির্মাণ ও পুরাতন পার্কগুলোতে প্রাণ ফিরিয়ে আনা, এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করে গেছেন। ১৯৯৬-এর মার্চের শেষ সপ্তাহ স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে মোহাম্মদ হানিফ তার নেতৃত্বে ‘জনতার মঞ্চ’ গঠন করেন, যা তৎকালীন বিএনপি সরকারের পতনসহ আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য টার্নিং পয়েন্ট তৈরি করে এবং যার ফলশ্রুতিতে ’৯৬-এর ১২ জুন দেশের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বস্ততার বড় প্রমাণ দিয়েছেন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদ এবং হাওয়া ভবনের নেতৃত্বে পরিচালিত গ্রেনেড হামলার মূল টার্গেট ছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা এবং সে সময়কার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৪ সালের ভয়াল ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশের ট্রাকমঞ্চে শেখ হাসিনার ওপর নারকীয় গ্রেনেড হামলার সময় নিজের জীবন তুচ্ছ করে মানবঢাল রচনা করে প্রিয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে রক্ষায় সাহসী ভূমিকা রাখেন মোহাম্মদ হানিফ। একের পর এক ছোড়া গ্রেনেডের সামনে নির্ভয়ে পেতে দিয়েছিলেন নিজেকে। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রাণে রক্ষা পেলেও মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। মস্তিষ্কসহ দেহের বিভিন্ন অংশে অসংখ্য ঘাতক স্প্লিন্টার ঢুকে পড়ে। দীর্ঘদিনের চিকিৎসাতেও কোনো ফল হয়নি বরং মাথার গভীরে স্প্লিন্টার বিঁধে থাকায় অস্ত্রোপচার করেও অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করেও রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় থেকেছেন মোহাম্মদ হানিফ। রাজধানীর প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্বও দিয়েছেন। ২০০৬-এর ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তাঙ্গনে এক সমাবেশে সভাপতির বক্তৃতা দেওয়ার সময় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। গ্রেনেড হামলায় মাথায় বিদ্ধ হওয়া স্প্লিন্টারের প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তী সময়ে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে তিনি ২৮ নভেম্বর ২০০৬ রাতে ৬২ বছর বয়সে ঢাকার এ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকার প্রথম মেয়র নন্দিত জননেতা মোহাম্মদ হানিফ আমাদের মাঝে নেই। তবে বেঁচে আছে তার আদর্শ। তার ছেলে মোহাম্মদ সাঈদ খোকন এখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মেয়র। বাবার আদর্শে দক্ষিণ ঢাকাকে সুন্দর নগরী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন তিনি।

লেখক : জনসংযোগ কর্মকর্তা, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন

সর্বশেষ খবর