মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

শান্তির দূতেরা, শুনতে কি পাও?

আরিফা রহমান রুমা

শান্তির দূতেরা, শুনতে কি পাও?

শান্তির মশাল হাতে নিরন্তর ছুটে চলা ব্যক্তি বা সংগঠনের সংখ্যা কম নয়। লবণাক্ত পানির নয়নাভিরাম নাফ নদের দুই পারের দুজন নাগরিক নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। অথচ নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির দেশ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলমানরা জাতিসংঘের তথ্যমতে আজ বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী। রাখাইন মিয়ানমারের দারিদ্র্যপীড়িত প্রদেশ ও রোহিঙ্গাদের আদিনিবাস। মিয়ানমার সরকার যদিও বলছে ব্রিটিশরা রোহিঙ্গাদের আরাকানে এনেছে এবং এদের আদিনিবাস বাংলাদেশ ও ভারত; কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে এটা প্রমাণিত যে, ব্রিটিশরা বার্মায় আসার কয়েক শতাব্দী আগেই রোহিঙ্গারা আরাকানে বসবাস ও রাজ্য শাসন করেছেন। ইতিহাসবিদদের মতে, অষ্টম-নবম শতাব্দীতে প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানিদের সংমিশ্রণে রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব। ১৪৩০-১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল এলাকা রোহিঙ্গাদের স্বাধীন রাজ্য ছিল, পরে বার্মার রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখলের পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ওপর শুরু হয় অত্যাচার-অনাচারের অশুভ সূচনা। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী পার্লামেন্টেও রোহিঙ্গা প্রতিনিধিত্ব ছিল। ১৯৬২ সালে জেনারেল উইন বার্মার ক্ষমতা দখলে নেওয়ার পর নিপীড়ন-নির্যাতন যেন রোহিঙ্গাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৮৪ সালের নতুন নাগরিকত্ব আইনের ফলে তাদের নাগরিকত্বও বাতিল হয়ে যায়। মিয়ানমারের শাসনতন্ত্রে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কোনো স্বীকৃতি নেই। নাগরিকত্ববঞ্চিত করা হয় জাতিগোষ্ঠী, চেহারা আর ভাষার দোহাই দিয়ে; অথচ মিয়ানমারের আশপাশেই এর কম অসংখ্য রাষ্ট্র রয়েছে যেখানে ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বাস। এরই ধারাবাহিকতায় খুন, ধর্ষণের মতো নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা দলে দলে দেশত্যাগে বাধ্য হয়। কিন্তু নিজ দেশে নাগরিকত্বহারা এবং দীর্ঘ বছর ধরে বঞ্চিত হতে হতে অশিক্ষিত, ধর্মান্ধ, ক্ষুব্ধ ও বিক্ষিপ্ত মানসিকতার এসব সর্বহারা মানুষকে আশ্রয় প্রদান আমাদের জন্যও যে খুব সুখকর অভিজ্ঞতা নয়; ইতিমধ্যেই তার প্রমাণ পেয়েছি। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে কিন্তু পাশাপাশি নানা সমস্যায় এখনো জর্জরিত। এর মধ্যে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও মিয়ানমার কর্তৃক তাদের বাংলাদেশি বলে প্রমাণের চেষ্টা— সবকিছু মিলেই নতুন দুশ্চিন্তায় দেশ ও দেশের সচেতন সমাজ। আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের একটা বড় অংশ নানা ধরনের  অপরাধমূলক কাজ যেমন মাদক পাচার, লুটতরাজ, অস্ত্র ব্যবসা এবং জঙ্গি তত্পরতার সঙ্গে জড়িত। রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে হামলায় চুরি যাওয়া বেশ কিছু বুদ্ধমূর্তি পাওয়া যায় রোহিঙ্গাদের শরণার্থী শিবিরে। এ বছরের ১২ মে রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন আরএসও নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরের আনসার ক্যাম্পে হামলা করে অস্ত্র লুটের পাশাপাশি আনসার কমান্ডার আলী হোসেনকেও হত্যা করে। অনেক রোহিঙ্গা সংগঠন মাদক পাচার করে। এ ছাড়া খুন, লুটপাট ও বাংলাদেশি পাসপোর্টে বিদেশে গিয়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এর আগে তারা বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে।  রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার প্রশ্নে অনেক আবেগপ্রবণ বাংলাদেশি এসব আগপাছ বিবেচনা না করে ১৯৭১ সালে আমাদের ভারতে আশ্রয় নেওয়ার উদাহরণ টানছেন। ভারতে আমাদের অবস্থান ছিল সাময়িক এবং নিয়মের  ভিতর; কিন্তু ইতিমধ্যেই ঢুকে পড়া রোহিঙ্গারা যেমন মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাইছে না, মিয়ানমার সরকারও তাদের সে দেশের নাগরিক মনে করে না। আমার দেশের নিরাপত্তা, সারভৌমত্ব সবার আগে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আমাদের সাংস্কৃতিক ও জাতিগত বিরোধও ভাবার বিষয়। রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশে জামায়াতের রাজনৈতিক সখ্যও  হেলাফেলা করার বিষয় নয়। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেওয়ার মানে এ বিষয়গুলো মেনে নেওয়া। সীমান্তে একটু নজরদারি বাড়িয়ে দেওয়ায় তারা এখন চীন ও ফিলিপাইনে ঢুকছে। বাংলাদেশ বাধা না দিয়ে সীমান্ত খুলে মানবাধিকার দেখাতে গেলে এই ভুলের খেসারত দিতে আমাদের নিজেদেরই একদিন মানবেতর জীবনযাপন করতে হবে। আর মিয়ানমারে কেবল মুসলিম হওয়ার কারণেই রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হচ্ছে— তাও সর্বাঙ্গে সত্য নয়, কেননা মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে অসংখ্য মুসলিম শান্তিতে ও নির্বিঘ্নে জীবনযাপন করছে। বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলোয় ৩৮ হাজার শরণার্থী আছে বাকিরা তাহলে কোথায়? তারা আসলে কক্সবাজার ও আশপাশের জেলাগুলোয় ছড়িয়ে পড়েছে এবং এখানেও কিন্তু তারা উদ্বাস্তু হয়ে আছে। এর আগেও বাংলাদেশ শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছিল, তাতে রোহিঙ্গাদের সমস্যার সমাধান যেমন হয়নি, তেমন বাংলাদেশকেও পড়তে হয়েছে নতুন সমস্যার মুখে। বেঁচে থাকার মানে কেবল নিঃশ্বাস নেওয়া নয়, বেঁচে থাকার মানে আরেকটু বেশি কিছু, পায়ের তলায় একটি নিশ্চিত নিরাপদ ভূমি, নিরপদ্রব জীবন; যার কোনোটাই রোহিঙ্গাদের দেওয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করতেই হবে, এটা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, সমাধান তারা করবে। এভাবে রোহিঙ্গা ঢোকার ফলে ভবিষ্যতে কী কী সমস্যা দেখা দিতে পারে, তা ভাবতে হবে, প্রচার করতে হবে।

বিশ্ব আজ এক নতুন সু চিকে দেখছে। অং সান সু চির রাজনীতির উদ্দেশ্যই ছিল মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা অথচ রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি কখনো নির্লিপ্ত রয়েছেন কখনো বা তার কথায় সামরিক প্রেতাত্মাদের সুর বেজে উঠছে। মনে পড়ে, সু চির মুক্তির দিনে আমার চোখেও ঝরেছিল আনন্দ অশ্রু। আজ তিনিও ক্ষমতার হিসাবের খাতা খুলে বসে আছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিজে মিয়ানমারে এসে সু চিকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে অনুরোধ করেছিলেন। সেই রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের খড়্গ নেমে এলেও যুক্তরাষ্ট্র আজ অস্বাভাবিক রকমের চুপ। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনের কথা বলেছে অথচ জাতিসংঘ বাংলাদেশকে সীমান্ত খুলে দিতে বললেও এ অনাচার বন্ধে মিয়ানমারকে কোনোরকম চাপ প্রয়োগ করছে না। বাংলাদেশের মতো এত অধিক জনসংখ্যার দেশ একসঙ্গে এত মানুষের চাপ কীভাবে সামলাবে, তা চিন্তা করার মতো যৌক্তিক বোধও মনে হয় তাদের লোপ পেয়েছে। আমাদের দেশের নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিকভাবে একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি, দেশের মানুষ তাকে নিয়ে গর্ব করে কিন্তু দেশের অন্যান্য ক্রান্তিকালের মতো আজকের দিনেও তার মুখে ঁরা নেই। হিলারিকে নির্বাচনে জেতানোর জন্য তিনি কোটি কোটি টাকা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন কিন্তু দেশের শান্তি ভূলুণ্ঠিত হওয়ার কালে শ্বেত পতাকা হাতে তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কারণ হয়তো এই বিনিয়োগ অর্থের বিচারে মূল্যহীন। এখন যা করার বাংলাদেশকে নিজ উদ্যোগেই করতে হবে।  মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের কথা ভেবে আর চুপ করে বসে থাকার সুযোগ নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবারকার জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক বৈঠকে এ বিষয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়, তার ব্যক্তি ইমেজ কাজে লাগিয়ে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোকে পাশে নিয়ে এ সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিবেক জাগ্রত করতে হবে দ্রুততার সঙ্গে। ছিটমহল সমস্যা, সমুদ্র বিজয়ের মতো এ সমস্যার সমাধানও সম্ভব। বাংলাদেশ, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া আর চীনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রোহিঙ্গাদের বর্মীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব না হলে তাদের জন্য তাদের জন্মভূমিতে স্বতন্ত্র আবাসের ব্যবস্থা করা হোক। বাংলাদেশ তার সীমিত সম্পদ আর তার তুলনায় অধিক জনসংখ্যা নিয়েও বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে নিজেরাই নানা সমস্যার সম্মুখীন। দরকার শান্তির ধ্বজাধারী বিশ্ববিবেকদের কানে রোহিঙ্গাদের করুণ আর্তির পাশাপাশি আমাদের সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরা।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর