মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

চিরঞ্জীব বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো

হাসান তারিক চৌধুরী

চিরঞ্জীব বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো

বিশ্বের অসংখ্য ভক্ত-অনুসারীকে চোখের জলে ভাসিয়ে মহাকালের দিকে যাত্রা করলেন বিশ শতকের মহান বিপ্লবী বিশ্বনেতা ফিদেল কাস্ত্রো। বিপ্লবী হিসেবে তার আবির্ভাব যেমন পুরো দুনিয়াকে আলোড়িত করেছিল, তার মৃত্যুও তেমন আলোড়িত করেছে। পরিণত বয়সেই চিরবিদায় নিয়েছেন তিনি। তা সত্ত্বেও যেন আজকের দুনিয়া তাকে বিদায় দিতে নারাজ। এক বিশাল উচ্চতায় উন্নীত হয়েছিলেন তিনি। কীভাবে তিনি বিশ্ব মানবতার কাছে এ রকম অপরিমেয় শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার স্থানে পৌঁছলেন? নিঃসন্দেহে এটি রাজনীতিবিজ্ঞানের ছাত্রদের কাছে অনন্ত আগ্রহের বিষয় হয়ে রইবে। আমার মতে, সম্ভবত ফিদেলের সৎ জীবনযাপন, দুঃসাহসী বিপ্লবী অভিযান এবং সাম্যের আদর্শের প্রশ্নে আপসহীন অবস্থানই তাকে এ রকম উচ্চতায় উন্নীত করেছে। হাভানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে আইনজীবী হিসেবে যখন পেশা শুরু করেন তখনো তার মাথায় কাজ করেছিল গরিব মানুষের অধিকার রক্ষার প্রশ্নটি। শোষিত মানুষের মুক্তির চিন্তা থেকে একমুহূর্তও বিরত থাকতে পারেননি। দুই বামপন্থি আইনজীবী বন্ধু জর্জ আজপিয়াজো ও রাফায়েল রেসেন্দেকে নিয়ে তিনি যে ল ফার্মটি খুলেছিলেন তার মূল উদ্দ্যেশ্য ছিল গরিব কিউবানদের অধিকার প্রতিষ্ঠা। তা করতে গিয়ে তার চেম্বার পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। আসবাবপত্র বিক্রি করে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেন। এমনই দরদি মন ছিল ফিদেলের। মাত্র ১৬৫ জন সহযোদ্ধা নিয়ে ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই যখন মনকাডা আর্মি ব্যারাকে সশস্ত্র অভিযান চালান তখন নশ্বর এই জীবনের পরোয়া কাস্ত্রো করেননি। কারণ তার চোখে-মুখে ছিল বিপ্লবের অদম্য স্বপ্ন। মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আর শোষণমুক্তির দুর্নিবার স্বপ্নই তাকে বিশ্বনেতায় পরিণত করে। যে কারণে কমিউনিস্ট বা বামপন্থি ছাড়াও ভিন্নমতের মানুষের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মানবমুক্তির দিশারি ও শ্রদ্ধার পাত্র। ফলে মৃত্যুর পরও অনেক শক্তি নিয়ে বেঁচে থাকবেন ফিদেল কাস্ত্রো। কানাডার প্রধানমন্ত্রী সুদর্শন নেতা জাস্টিন ট্রুডো ফিদেলের প্রয়াণে শোক প্রকাশ করে বলেছেন, ‘ফিদেল ছিলেন এক কিংবদন্তি বিপ্লবী এবং অসাধারণ বাগ্মী।’ মাদাগাস্কারে এক সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। ২৬ নভেম্বরের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা লিখেছে, এ বক্তব্যের জন্য ট্রুডোর সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের দুই উগ্র ডানপন্থি, বিগত নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপ্রত্যাশী সিনেটর টেড ক্রুজ ও মার্কো রুবিও। মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা বলেছেন, ‘একক ব্যক্তি হিসেবে কিউবার জনগণ ও পুরো বিশ্বের ওপর ফিদেলের অসামান্য প্রভাবের কথা ইতিহাস মূল্যায়ন করবে।’ এভাবেই নিজের গণ্ডি ছাড়িয়ে ভিন্নমতের লোকজনের দ্বারাও ইতিবাচকভাবে মূল্যায়িত কাস্ত্রো। লাতিন আমেরিকার আরেক কিংবদন্তি বিপ্লবী হুগো শ্যাভেজ তাই যথার্থই বলেছিলেন, ‘ফিদেলের বিশালত্ব এত ব্যাপক যে, তিনি আমাদের প্রতিটি বিপ্লবী কাজের অংশে পরিণত হয়েছেন। এসব কাজের মাঝেই তিনি চিরদিন বেঁচে থাকবেন।’

 

 

সত্যিই কাস্ত্রো ছিলেন এক ব্যতিক্রমী সাম্যবাদী যোদ্ধা, বিপ্লবী। তার সারাটি জীবনের পরতে পরতে সে নজির খুঁজে পাওয়া যায়। অনেক বিপ্লবী প্রথমে কমিউনিজমের দীক্ষা নিয়েছে। তারপর বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কেউ সফল হয়েছেন, কেউ হননি। কাস্ত্রো ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি আগে বিপ্লব করেছেন, পরে কমিউনিজমকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কারণ, তিনি তার বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন, মার্কসবাদ-লেনিনবাদই পারে কিউবার বিপ্লবকে রক্ষা করতে। মৃত্যু অবধি তিনি সে বিশ্বাসে অবিচল ছিলেন। তবে মতান্ধ ছিলেন না। ছিলেন বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার ও এর সৃজনশীল প্রয়োগের প্রতি গভীর আস্থাশীল। ২০০৬ সালে কিউবার রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিদায় নেওয়ার পর অসুস্থ শরীর নিয়ে অক্লান্তভাবে সমসাময়িক বিশ্ব ও রাজনীতি বিষয়ে বিরামহীন লিখে গেছেন। তার সেসব লেখা পৃথিবীর দেশে দেশে বিভিন্ন ভাষায় ছাপা হয়েছে। পরিবেশ-প্রতিবেশ, প্রকৃতি, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তি,  রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে তার সেসব লেখা একুশ শতকের রাজনীতির জন্য এক অনন্যসাধারণ সম্পদ। খেলাধুলার মতো বিষয়ও ছিল তার বিরাট আগ্রহের জায়গা। ২০১৪ সালের ২৫ জুন কাস্ত্রো ফুটবলের কিংবদন্তি দিয়েগো ম্যারাডোনাকে বেশ বড় একটা চিঠি লেখেন। কাগজে সে চিঠিটি ছাপাও হয়। এ যেন ক্রীড়ার দর্শনের ওপর লেখা এক নিবন্ধ! খেলাধুলার জন্য বরাদ্দকে সমাজতন্ত্রে কখনই আর্থিক মুনাফার ক্ষেত্র বলে বিবেচনা করা হয় না। ম্যারাডোনাকে লেখা তার চিঠিতে সে কথাই প্রতিফলিত হয়েছে। সে চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রিয় ম্যারাডোনা! তোমাকে ধন্যবাদ আমেরিকার ফুটবলকে সম্মানিত করার জন্য। আমি একজন রাজনীতিক। কিন্তু যখন আমি আমার যৌবন ও বাল্যকালের দিকে ফিরে যাই, তখন ফুটবলকে দেখি। আমার বাল্যকালকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তোমাকে আবারও ধন্যবাদ। আমি আশা করি আজকের দুনিয়া খেলাধুলার বিরুদ্ধে যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, তা তুমি মোকাবিলা করতে পারবে। তোমার পাশে আরও রয়েছে আরেক লাতিন বিপ্লবী শ্যাভেজ। সেও খেলাধুলার জোরদার পৃষ্ঠপোষক। তুমি এগিয়ে যাও, দিয়েগো।’ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মানবমুক্তির পথ হিসেবে সমাজতন্ত্রের প্রতি তার ছিল অবিচল আস্থা। মৃত্যুর এক বছর আগেও অসুস্থ শরীরে ‘মার্কসবাদী-লেনিনবাদী হওয়া আমাদের অধিকার’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ের ৭০তম বার্ষিকী উপলক্ষ করে ২০১৫ সালের ৮ মে সে প্রবন্ধটি বিভিন্ন প্রকাশনায় ছাপা হয়। সেখানেও তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধে ২ কোটি ৭০ লাখ সোভিয়েত জনগণের আত্মদান তাদের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ও সমাজতন্ত্রী হওয়ার অধিকার দিয়েছে; যা কেউ কেড়ে নিতে পারে না। লেনিন ছিলেন সেই সাহসী, মেধাবী বিপ্লবী কৌশলবিদ যিনি আংশিক শিল্পায়িত একটি দেশকে পুঁজিবাদী ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন এবং সর্বহারার একটি পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।’ এ রকম বিভিন্ন লেখা ছাড়াও কাস্ত্রো প্যালেস্টাইনের জনগণের মুক্তিসংগ্রামের ন্যায্যতা, ন্যাটোর লিবিয়া হামলার প্রতিবাদ, আরব বসন্ত ও এর পরবর্তী ফলাফল, বিশ্ব অর্থনৈতিক মহামন্দা প্রভৃতি বিষয়ে নিয়মিত লিখে গেছেন। যেসব লেখায় উল্লিখিত বিশ্লেষণ পরবর্তীকালে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। এতেই বোঝা যায়, রাজনীতিতে কতটা দূরদর্শী ছিলেন ফিদেল। সবাই জানেন, ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘বন্ধু! ঘাতকরা সক্রিয় রয়েছে। ওরা তোমাকে হত্যা করতে পারে। তুমি সাবধান থেকো।’ বাস্তবতা হৃদয়বিদারক হলেও বলতে হয়, কাস্ত্রোর সে আশঙ্কা পরিণামে সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছিল। কারণ, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই তিনি কিউবার বিপ্লবকে রক্ষা করেছেন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বলেছে, সাম্রাজ্যবাদ তাকে কম করে হলেও ৬৩৮ বার হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি নিজের বাস্তবতা থেকে শিখেছেন, প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রীদের জীবনের ওপর আঘাত অনিবার্য। সে অভিজ্ঞতা থেকেই বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, চিলির আলেন্দে, মিসরের জামাল আবদুন নাসের কেউই রেহাই পাননি।

বিপ্লবী কাস্ত্রো ঘাতকের বুলেটকে জয় করেছিলেন। হাভানা চুরুট ঠোঁটে, রাইফেল কাঁধে, গেরিলা পোশাকের এই আইকন এখনো পৃথিবীর তরুণদের হৃদয় হরণ করে। পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় সমাজতন্ত্রের লাল ক্যাকটাস ফুটিয়ে রেখে তিনি প্রমাণ করেছেন, উন্নয়ন মানে ৯৫ শতাংশ মানুষের রুটি-রুজির অধিকার। ৫ শতাংশের বিলাসবহুল গাড়ি আর আকাশচুম্বী ইমারতের নাম উন্নয়ন নয়। কিউবার ওপর প্রতিবেদন প্রকাশের সময় বিভিন্ন মিডিয়া জীর্ণ হাভানা শহর আর পুরনো মডেলের গাড়ির ছবি দেখায়। কিন্তু তারা এটা বলে না, কিউবায় কোনো গৃহহীন নেই, কেউ টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মরে না, কিউবায় আকাশ-পাতাল বৈষম্য নেই। এখানেই কাস্ত্রোর সফলতা। বিগত মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলের রাষ্ট্রপতি মনোনয়নপ্রত্যাশী বামপন্থি সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স কাস্ত্রোর এ কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন, ‘আমরা ৯৯ শতাংশ, অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট অথবা মজুরি-বৈষম্যের বিরুদ্ধে মার্কিন তরুণ সমাজের আজকের আন্দোলন যেন বিপ্লবী কাস্ত্রোরই পদধ্বনি।’

লেখক :  সম্পাদক, বিশ্ব গণতান্ত্রিক আইনজীবী পরিষদ।

ই-মেইল :  htarique¦gmail.com

সর্বশেষ খবর