রবিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিশ্ব বিবেকে রোহিঙ্গারা উপেক্ষিত

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)

বিশ্ব বিবেকে রোহিঙ্গারা উপেক্ষিত

মিয়ানমার রোহিঙ্গা নিধনে উন্মত্ততায় নেমেছে। বাইরের বিশ্ব থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রেখে দেশটিতে দম্ভের সঙ্গে সেনা শাসন চালিয়েছে সামরিক জান্তা। এখন নাকি সে দেশে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইছে। পশ্চিমা বিনিয়োগকারীরা মিয়ানমারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। ধনী দেশগুলো সে দেশে বিনিয়োগ করে ব্যবসা-বাণিজ্য, খনিজ সম্পদসহ যত সুবিধা নেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। পশ্চিমারা শুধু নয়, চীন-ভারত সবাই সে দেশের সম্ভাবনা তাদের কাজে লাগাতে মরিয়া। এমন পরিস্থিতিতে কেউ তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে টুঁশব্দ করে বোকার জগতের বাসিন্দা হতে চায় না। রোহিঙ্গারা জীবন বাঁচাতে পূর্বপুরুষের ভিটাবাড়ি, নিজ বাসগৃহ, সাজানো সংসার রেখে জীবনভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। বিশ্ব মোড়লদের দৃষ্টিতে বিত্তহীন-সম্পদহীন রোহিঙ্গাদের মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। সে দেশে ৯ অক্টোবর দুর্বৃত্তরা সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর ৯ সদস্যকে হত্যা করে। এই অসিলায় সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর তাণ্ডব চালিয়ে হত্যা-ধর্ষণ, লুট-অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী সব জঘন্য কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। গ্রাম জ্বালিয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করছে। নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করছে।

মানুষের জীবন নিয়ে তামাশা করছে বিশ্ববিবেককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। আসলে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ওপর হামলা ছিল রোহিঙ্গা নির্মূলের এক খোঁড়া অজুহাত। উঠতি তরুণ-তরুণীদের দেখা মাত্র গুলি করে হত্যা করছে তারা। জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডলীর মধ্যে নিষ্পাপ নিরপরাধ শিশুদের নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মারছে। বাড়িঘর, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে উল্লাস করছে। তাদের কুকর্ম আধুনিক সভ্যতাকে কালিমা লেপন করছে। রোহিঙ্গারা এখন রাষ্ট্রহীন নির্যাতিত-নিপীড়িত-সহায়হীন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। মিয়ানমারের একমাত্র প্রজেক্ট রোহিঙ্গাদের সমূলে উৎপাটন করা। আজ তারা সীমাহীন অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট মাথায় নিয়ে শিশুসন্তান কোলে-কাঁকে নিয়ে মাইলের পর মাইল প্রাণভয়ে অজানা গন্তব্যে ছুটছে। পাশের রাষ্ট্র বাংলাদেশের ভিতর ঢোকাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। বাঙালিরা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদারদের অত্যাচারে একই পরিস্থিতিতে পড়েছিল। জীবন বাঁচাতে বাঙালিরা পাশের রাষ্ট্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, ত্রিপুরা, আসাম, বিহারে আশ্রয় নিয়েছিল। সেদিন ভারত আশ্রয় না দিলে বাঙালিদের অবস্থা রোহিঙ্গাদের চেয়ে শোচনীয় হতো।

বাংলাদেশে অনেক সমস্যা রয়েছে। অস্বীকার করা যাবে না যে রোহিঙ্গাদের ভার বহন করার মতো সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। এর আগে যারা এসেছিল তারা অনেক অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতির জন্য দায়ী। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে রোহিঙ্গারা বিদেশে বাংলাদেশি পরিচয়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে এ দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে। বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমজীবীদের খ্যাতি বিনষ্ট করেছে। অনেকে মাদকের সঙ্গে জড়িত। এমন যুক্তি তুলে যারা রোহিঙ্গা আশ্রয়ের বিপক্ষে তারা দেশের স্বার্থ বিচারে সঠিক। আবার মানবাধিকারের বিবেচনায় দুর্দিনে দুর্বিপাকে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে এটাই মানবতা। তারাও মানুষ। মানবাধিকারে কোনো ধর্ম কোনো বর্ণ কোনো জাতি বিবেচ্য বিষয় নয়। তাদের মানবিক অধিকার নিশ্চিত করা প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব। জাতি-ধর্মের দোহাই দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো পদক্ষেপ মেনে নেওয়া যায় না। কালবিলম্ব না করে বিশ্বের সব মানবাধিকার সংগঠন ও মানবাধিকার বোধসম্পন্ন ব্যক্তির রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। রোহিঙ্গা নিধন এখন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ফায়দা অর্জনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী কয়েক যুগ ধরে রোহিঙ্গা নিধনের কলাকৌশলে হাত পাকিয়েছে। মিয়ানমার সরকারের কর্মকাণ্ডে মনে হয়, রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন, উচ্ছেদ নিধনই জাতিগত সমস্যার একমাত্র সমাধান। কী সাংঘাতিক নরপশু নরঘাতক হলে এমন কথা তারা ভাবতে পারে। তাদের এক ধর্মগুরু ঘোষণা দিয়েছেন সে দেশের পশ্চিমাঞ্চল রাখাইন থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত না করলে মিয়ানমার মুসলমান রাষ্ট্র হয়ে যাবে। ১৯৬২ সালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের পর রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তাদের ওপর চালানো হয় নির্মম নিপীড়ন; যার আলামত হলো, সন্তান জন্ম দিলে কর, বিয়ে করলে কর, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে হলে অনুমতি। আরও কত বালা-মুসিবত। দক্ষিণ আফ্রিকার সেই জাহিলিয়ার মতো রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রিত জায়গায় রেখে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে।

রাখাইনে তেল-গ্যাস খনি থাকলে নাক গলানোর জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর গলা সোচ্চার হতো। সে দেশে উৎকণ্ঠার মধ্যে রোহিঙ্গারা বসবাস করে সামরিক বাহিনীর কৃপায় সম্বলহীন আশ্রিতদের মতো। নিজের বলতে কোনো পরিচয় নেই। মিয়ানমারের জননেত্রী সু চির নীরবতা গণহত্যার বৈধতা দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের শেষ ভরসার প্রদীপটি সু চি নিভিয়ে দিচ্ছেন। গণতন্ত্রের নামে সু চি পরিচালিত হচ্ছেন সেনাবাহিনীর দ্বারা। গণতন্ত্রের সাইনবোর্ড কাজে লাগিয়ে পশ্চিমাদের সামাল রাখতে পারছেন। মিয়ানমারের উগ্র জাতীয়তাবাদীরা রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক মনে করে না। তাই সু চি তাদের পক্ষে আওয়াজ তুলে নিজের জনসমর্থন হারাতে চাচ্ছেন না। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের আহাজারি মার খাছে রাজনীতির পাশা খেলায়। এশিয়ার কয়েকটি দেশ ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখিয়েছে সাধারণ মানুষ। কিন্তু পশ্চিমা দুনিয়া নিশ্চুপ। মিয়ানমারের সঙ্গে এখন পরাশক্তিগুলো পিরিতির বন্ধনে আবদ্ধ। সু চির কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে তারা সে দেশের মজুদ তেল-গ্যাসের ভাগ থেকে বঞ্চিত হতে চায় না। অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ার লোভে বিশ্বমাতব্বররা কিছু বলছে না। কিছু দেশি-বিদেশি চ্যানেলে দেখা যায় কী বীভৎস নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গারা। বাসগৃহে আগুনের লেলিহান শিখায় প্রাণভয়ে রাস্তাঘাট, বন-জঙ্গল, সমুদ্রে যেভাবে যে পারছে ছুটছে। শিশুর মুখে মা তার স্তন দিয়ে কাঁকে করে সরু জঙ্গলের পথে দৌড়াচ্ছে। কোনো কোনো শিশুর মা কয়েক দিন অভুক্ত থাকায় স্তনের দুধ শুকিয়ে গেছে। শিশুর মুখে স্তন দিতেই স্তন ফুটা বেলুনের মতো চুপসে যাচ্ছে, দুর্বল শিশু মাতৃদুগ্ধ না পেয়ে ম্রিয়মাণ কণ্ঠে কাঁদছে। বিপদের সহযাত্রীরা তাড়া করছে দ্রুত স্থান ত্যাগের, নইলে আর্মি এসে ধরে ফেলবে। জীবন-মৃত্যুর এমন সন্ধিক্ষণে রোহিঙ্গারা। পাশের কোনো দেশই তাদের দিকে স্বতঃস্ফূর্ত সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছে না। যতটুকু যা আশ্রয় বাংলাদেশেই।

১৯৫১ সালের জাতিসংঘ শরণার্থী চার্টারে অনেক দেশ স্বাক্ষর করলেও তার প্রতি তারা শ্রদ্ধা দেখাচ্ছে না। জীবন রক্ষায় কাউকে আশ্রয় দেওয়া কোনো দয়া-দাক্ষিণ্য নয়, তা শরণার্থীদের অধিকার।  জাতিসংঘ এ অধিকার তাদের দিয়েছে। কসোভোয় যেভাবে বিশ্ব এগিয়ে এসেছিল রোহিঙ্গাদের জন্য একই পরিস্থিতি। কিন্তু বিশ্ব এগিয়ে আসছে না। কোনো মানবাধিকার সংস্থা ও গণমাধ্যম কর্মীদের রাখাইনে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। রাজ্যটি সেনাবাহিনী অবরোধ করে রেখেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী কর্তা মিয়ানমারের এই হত্যাযজ্ঞকে নৃতাত্ত্বিক নির্মূল অভিযান আখ্যা দিয়েছেন।

বর্তমান পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশের পক্ষে সামাল দেওয়া মোটেই সম্ভব নয়। মিয়ানমার দুষ্টের শিরোমণি। ১৯৯১ সালে তারা আমাদের এক ক্যাম্প লুট করে যুদ্ধাবস্থা তৈরি করেছিল। মাঝেমধ্যে তাদের ভেলকিবাজি স্বভাব আমরা সীমান্তে দেখি। বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যুক্ত করা, শক্তিশালী দূতিয়ালির মাধ্যমে সমস্যাটি তামাম দুনিয়ায় তুলে ধরা। সব মুসলিম রাষ্ট্রসহ মানবাধিকার সংস্থা, ওআইসি, জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করে রোহিঙ্গা সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধানের পথ অতি দ্রুত বের করতে হবে। সীমান্তের অন্য পাশে কোনো রাষ্ট্রের জাতিগত দাঙ্গা-হাঙ্গামার আঁচ পাশের দেশে পড়বেই, সেই আগুন কোনো বন্দুক-কামান দিয়ে নেভানো যাবে না। রোহিঙ্গা সমস্যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিয়ে সমাধান করার বিকল্প আর কিছু নেই। রোহিঙ্গা সমস্যা যাতে বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দেখা না দেয়, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে।

     লেখক : সম্পাদক, জি নিউজ ২৪ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

     [email protected]

সর্বশেষ খবর