সোমবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিপন্ন রোহিঙ্গাদের পাশে থাকতে হবে

মেজর জেনারেল মো. আবদুর রশীদ (অব.)

বিপন্ন রোহিঙ্গাদের পাশে থাকতে হবে

প্রতিদিন শত শত রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হত্যা ও নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য। সীমান্তের কঠোর পাহারার ফাঁক দিয়ে ঢুকেও পড়েছে কয়েক হাজার। শরণার্থীর স্রোত ক্রমে বেড়ে চলেছে সঙ্গে শুরু হয়েছে শরণার্থী পার ও আশ্রয় বাণিজ্য। বিপন্ন মানবতার পাশে থাকতে সব সময় ঐকান্তিক বাংলার মানুষ। মুসলমান নিধন করছে বৌদ্ধরাষ্ট্র মিয়ানমার ধুয়া তুলে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে তত্পর রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক আবরণে থাকা ইসলাম বণিকেরা সন্তর্পণে দেশের রাজনীতিতে ফায়দা লোটার অপচেষ্টায় লিপ্ত। সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে মিথ্যা ও বানোয়াট ছবি ও সংবাদ ছড়ানো থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে কালো সাপ গর্ত থেকে বের হয়েছে। মুসলমান হত্যার প্রতিবাদে সৌদি আরব, পাকিস্তানসহ মুসলিম দেশগুলোর নিথর নিস্তব্ধ। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় গণবিক্ষোভ হলেও তেমন আঁচড় কাটতে পারেনি আন্তর্জাতিক মহলে। প্রতিবেশী দেশের অস্থিরতা ও অরাজকতায় বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তায় নতুন নতুন ঝুঁকি তৈরি হয়। ঘটনার পেছনে থাকা অনেক অদেখা বিষয় থেকে উত্থিত হুমকি সময়মতো চিহ্নিত করে সময়োপযোগী কৌশল তৈরি করতে না পারলে দেশ বিপদে পড়তে পারে ও গণতন্ত্র নস্যাৎ হতে পারে।

বাংলাদেশের সীমানা ঘেঁষা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তর দিকে মংডু ও বুথিডং জেলায় রোহিঙ্গাদের বসবাস। নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে ঢুকতে শুরু করলে নজরে আসে বিপন্ন মানবতার। মানবিক কারণে তাদের জায়গা দিতে অনুরোধ আসে জাতিসংঘ শরণার্থী হাইকমিশন থেকেও। অতীতে বাংলাদেশ শরণার্থীদের জায়গা দিয়েছিল কয়েকবার। শরণার্থী সৃষ্টিকারী মিয়ানমার সেনাদের বীভৎস, নৃশংস ও অপেশাদার আচরণ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সন্ত্রাস দমনের অছিলায় নিরীহ রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন নতুন রেকর্ড তৈরি করেছে। মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘন নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘ ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের বিশ্বের ‘সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী’ বলে ঘোষণা করেছে। রাখাইন রাজ্যে সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সব পক্ষকে সংযমী হতে বলেছে। মিয়ানমার সেনাদের নিবৃত করার বদলে পক্ষ খোঁজার বিষয়টি বিশ্লেষকদের মতে দৃষ্টিকটু।

অক্টোবরের ৯ তারিখে মংডু জেলার বাংলাদেশ সীমানাসংলগ্ন তিনটি ফাঁড়িতে আকস্মিকভাবে সন্ত্রাসীরা হামলা করে ৯ জন সদস্যকে হত্যা করে, অস্ত্র লুট করে আনুমানিক ১০ হাজার গুলি নিয়ে পালিয়ে যায়। সন্ত্রাসীর সংখ্যা ছিল প্রায় তিন শত। মিয়ানমার সেনাবাহিনী সন্ত্রাসী পাকড়াও করতে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ নামে এক অভিযান শুরু করে। পরের দিন থেকে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে সন্ত্রাসী খুঁজতে মাঠে নামে তারা। অভিযান কালে হামলার মুখোমুখি হয়ে আরও কিছু সেনা প্রাণ হারালে তল্লাশি অভিযান বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ মানবতাকে বিপন্ন করে তোলে। অভিযানে নিরীহ মানুষ মারা পড়তে থাকে, নারীরা নির্যাতিত হতে থাকে, ঘরবাড়ি জ্বলতে থাকে এবং সন্দেহভাজন হিসেবে অনেক নিরীহ মানুষকে আটক করা হয়। এমনকি হেলিকপ্টার গানশিপ ব্যবহার করা হয় নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে। চলমান সহিংসতা থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকায় অনেক ভুয়া খবরে ভরে যায় সংবাদপত্রের পাতা। সেখানে মানবাধিকার ধুলায় গড়াগড়ি খেতে থাকে। জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে নির্যাতিত জাতিগোষ্ঠী বলে তার দায়িত্ব শেষ করেছে। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টিকে দায়সারা ভাবে নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দুই দেশকেই দোষী করে বলেছে দুই দেশই নির্দয় আচরণ করছে।

 

 

ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসসহ অন্য আন্তর্জাতিক সনদের চরম লঙ্ঘনের জন্য মিয়ানমারকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে দ্বিধা করছে আন্তর্জাতিক সমাজ। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় সেনাঅভিযান বন্ধের জন্য চাপ সৃষ্টির পরিবর্তে বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে বিপন্ন মানবতা রক্ষার খাতিরে তাদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দিতে যাতে বিশ্ব সম্প্রদায় দায় মুক্তি পেতে পারে সহজেই। চীনের বলয় থেকে মিয়ানমারকে সরিয়ে আনতে পশ্চিমাদের মিয়ানমার প্রীতি যেমন লক্ষণীয় তেমনি রাষ্ট্রহীন, অধিকারহীন মানুষগুলোর প্রতি নির্বিকার আচরণ বিশ্বের বিবেককে হতবাক করেছে।

সন্ত্রাস দমনের নামে নিরীহ রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অমানবিক, নিষ্ঠুর ও অসভ্য আচরণে তাদের চিরতরে আরাকান থেকে বিতাড়নের রাষ্ট্রীয় গোপন কৌশলের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। বসনিয়া হার্জেগোভিনা ও কসভোতে যা ঘটেছিল নব্বইয়ের দশকে সেখানে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক বাহিনীকে মাঠে নামতে দেখা গিয়েছিল।

ঐতিহাসিকভাবে আরাকান রাজ্য বার্মার অংশ ছিল না। যার ফলে রোহিঙ্গারা বার্মার শাসন মেনে নেওয়ার চেয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে মিলে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল। মিয়ানমারের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করার পরিবর্তে বিচ্ছিন্ন হতে বেশি উদ্যোগী ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তানি প্ররোচনা ও সাহায্যে মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে সশস্ত্র সংগ্রামে জড়িয়ে পড়লে রোহিঙ্গারা বর্মীদের অনাস্থায় পড়ে। ১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করলে উগ্র ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে সাম্প্রদায়িক বিভক্তির ওপর ভর করলে বৌদ্ধ-মুসলিম সম্প্রীতিতে চিড় ধরে এবং বেশ কয়েকটি দাঙ্গাও বাধে। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে ১৩৫টি ক্ষুদ্র জাতি সত্তার স্বীকৃতি থাকলেও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বানিয়ে নাগরিকত্বের অধিকার বঞ্চিত করার পাশাপাশি সব নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। এমনকি শিশু জন্মের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রহীনতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন দেশ তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগান যুদ্ধে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যোদ্ধা বানানো হয়। তারপর উন্মেষ ঘটে ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে থাকা জঙ্গি সংগঠনগুলো বিভক্ত হয়ে কেউ কেউ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে বা মিয়ানমার সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আরাকান রাজ্য যা বর্তমানে রাখাইন রাজ্য মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ড থেকে পাহাড়-পর্বত, গহিন জঙ্গল ও নদী দিয়ে বিচ্ছিন্ন। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী হওয়ায় ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গারা কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকার ওপর নিত্যদিনের চাহিদা মেটাতে নির্ভরশীল। চেহারা, ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির মিলের কারণে আন্তর্জাতিক সীমানা পারিবারিক সম্বন্ধ তৈরিতে বাধা হতে পারেনি। দুই দেশ ঘিরেই তাদের জীবন-যাত্রার নকশা তৈরি হয়েছে। বৈধ ও অবৈধ যাওয়া-আসা এবং ঠায় নেওয়া কিছুটা নৈমিত্তিক।

রোহিঙ্গাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রবণতাকে স্বাধীনতা ও অখণ্ডতার হুমকি হিসেবে দেখছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের বৈরী জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করছে তারা। রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন বা আরএসও বা আরাকান লিবারেশন আর্মিসহ আরও অনেক জঙ্গি সংগঠনের উভয় দেশে গোপন আস্তানা ও সীমানা অতিক্রম করে অবাধ চলাচল থেকে ঝুঁকির মাত্রা বেশি অনুভব করেছে মিয়ানমার। আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গা আধিপত্য কমাতে অন্য রাজ্য থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের এনে রাখাইনে বসতি স্থাপন করা হয়েছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। রোহিঙ্গা মুসলিমরা উত্তরে চলে এসে সংখ্যাধিক্যতা বজায় রেখেছে মংডু ও বুথিডং জেলায়।

১৯৭৮ সালে অপারেশন ড্রাগন কিং এর নিষ্পেষণ এড়াতে প্রায় আড়াই লাখ এবং ১৯৯২ সালে দ্বিতীয়বার সমসংখ্যক রোহিঙ্গা প্রাণের ভয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে এদের একাংশকে মিয়ানমার ফেরত নিয়েছিল। যদিও দুটি বৈধ শরণার্থী ক্যাম্পে এখনো ২৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা রয়ে গেছে। শরণার্থীর জোয়ার-ভাটায় প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জনপদে মিশে গিয়েছে। তাদের ওপর ভিত্তি করে জামায়াতী ইসলামীর মতো সংগঠনগুলো যেমন শক্তিশালী হয়েছে তেমনই জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলো চাঙ্গা হয়েছে গোপনে। সেই সঙ্গে পাকিস্তান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্কসহ অনেক দেশের জঙ্গি দলের সঙ্গে আঁতাত বা যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। এ অঞ্চলে অস্ত্র পাচার, মাদক পাচারের মতো আন্তঃদেশীয় সংগঠিত অপরাধ চক্র বাসা বেঁধেছে। ফলে ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশ। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা যুক্ত হয়ে পড়েছে এসব অবৈধ ব্যবসাতে। স্থিতিশীল ও শান্ত সীমান্ত জঙ্গি ও চোরাচালানিদের স্বর্গরাজ্যের বিনাশ ঘটাবে বিধায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও সীমান্তে অশান্তি ধরে রাখতে দুই দেশের অশুভ চক্র সমানভাবে তত্পর থাকে।

বাংলদেশের মানুষকে ইসলামী আবেগে ধরাশায়ী করে রোহিঙ্গাদের জন্য শরণার্থী শিবির চালু হলে আন্তর্জাতিক ও বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলো সক্রিয় হতে পারে এবং শরণার্থীদের দোহাই দিয়ে তহবিল সংগ্রহের সুযোগ সৃষ্টি হবে। জঙ্গি সংগঠনগুলো শরণার্থীদের দুরবস্থতার সুযোগ নিয়ে অর্থ সংগ্রহ করতে পারবে সহজেই। সাহায্য সংস্থার আবরণে অনেক অশুভ শক্তি বাংলাদেশের মাটিতে জায়গা করে নিতে পারবে এবং বিদেশি অর্থের আগমনে জঙ্গি অর্থায়ন সহজ হবে। বিপন্ন মানবতার পক্ষে বাংলাদেশ নামলেই নিরাপত্তার অনেক ঝুঁকি সঙ্গে নিয়েই নামতে হবে।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেকে বাঁচাতে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিলে তা সমস্যার স্থায়ী সমাধান বয়ে আনলে বাংলাদেশকে দ্বিতীয়বার না ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা উচিত। অতীতে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জায়গা দিলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সাময়িক ব্যবস্থাকে স্থিতি অবস্থা গণ্য করে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিতের ব্যাপারে তেমন কোনো ভূমিকা না রেখেই গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন হয়েছে বলে আত্মতুষ্টি নিয়ে নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত থেকেছে। মিয়ানমারের ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ নির্দ্বিধায় তুলে নিয়েছে। রোহিঙ্গা-জাতিসত্তা অস্তিত্বের হুমকিতেই পড়ে খাবি খাচ্ছে, শরণার্থীর পুনঃস্রোত বাংলাদেশের দিকে সুনামির মতো এগিয়ে আসছে।

বিপন্ন মানবতার পক্ষে বাংলাদেশের সংবিধান, সরকার ও জনগণ। বিশ্বকে এটাও সুস্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে মানবতার দায় বাংলাদেশের একার নয় বিশ্বের সব দেশের ওপর সমানভাবে বর্তায়। শরণার্থী ব্যবস্থাপনার আন্তর্জাতিক কৌশল ও প্রতিশ্রুতি ছাড়া বাংলাদেশ এককভাবে এগোলে রোহিঙ্গা অধিকারের দাবি হাল্কা হয়ে যাবে এবং আন্তর্জাতিক এজেন্ডা থেকে বাদ পড়বে। ঠিক তেমনিভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক প্রত্যয় ও অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে এগোলে অতীতের মতো জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি মাথায় নিয়েই শরণার্থীদের আগমন ঘটবে কিন্তু রোহিঙ্গা অধিকার ধুলায় মিশিয়ে যাবে চিরতরে।

বাংলাদেশকে এগোতে হবে সুনির্দিষ্ট কৌশল ও প্রত্যয় নিয়ে যাতে করে একই বৃত্তে বারে বারে ঘুরপাক না খেতে হয়। মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সুসম্পর্ক রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান খোঁজার জন্য অপরিহার্য। পারস্পরিক নিরাপত্তা সহযোগিতাও সমগুরুত্ব বহন করে। অং সান সু চির গণতান্ত্রিক সরকারকে কয়েক দশক ধরে গড়ে ওঠা সামরিক আধিপত্যের ঘোড়াকে পোষ মানাতে আমাদের সহযোগিতা করা উচিত। সামরিক বাহিনীর পাগলামি দূর করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে অবস্থান আরও কঠোর করতে হবে। বাংলাদেশে ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করা দলগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে ধর্মীয় রং লাগিয়ে মানুষের ইসলামী অনুভূতিকে চাঙ্গা করে ফায়দা হাসিল করতে চাচ্ছে। জঙ্গি সংগঠনগুলো একই তানপুরার সুর ধরেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুরবস্থা জিহাদি সংগ্রহের বড় সুযোগ করে দেবে। মিয়ানমারের সীমান্ত ফাঁড়ির ওপর সন্ত্রাসী হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আল-কায়েদার ঘোষিত ত্রিদেশীয় পরিকল্পনা থেকে এ ঘটনাকে আলাদা করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। বাংলাদেশের নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ করতে মিয়ানমারকে বাধ্য করা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাহলে শরণার্থী স্রোত কমবে এবং রাজনৈতিক ইসলামচর্চা কারীদের অশুভ কৌশল ভেস্তে যাবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সক্রিয় হয়ে রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রের অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারলে মানবতা রক্ষা হবে এবং নিরাপত্তার ঝুঁকিও কমবে।

লেখক : নিরাপত্তা ও স্ট্রাটেজি বিশ্লেষক। ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস (আই ক্ল্যাডস)-এর নির্বাহী পরিচালক

সর্বশেষ খবর