সোমবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

কী হচ্ছে টেলিভিশনে

সামিয়া রহমান

কী হচ্ছে টেলিভিশনে

জীবনের সবক্ষেত্রে পরাজিত এক লোক হতাশায় ভেঙে পড়ে মন খারাপ করে একা ঘরে বসেছিল। তার মনে হতে লাগল, সে এতই বোকা যে পৃথিবীতে তার বেঁচে থেকে আসলে কোনো লাভ নেই। এতটা বোকামি সে সারা জীবন করেছে যে পুরো পৃথিবীর মানুষ তাকে হেয় করে, ঘৃণা করে। মনে হতে লাগল, বেঁচে থেকে তার আর কী লাভ! কেউ তো নেই তার জীবনে— ভালোবাসার, ঝগড়া করার। লোকটি ভাবল সে আত্মহত্যা করবে। সিদ্ধান্তটি নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হলো, মরেই যখন যাবে তার আগে পৃথিবীকে শেষবারের মতো দেখে নেওয়া দরকার। তার এ অবস্থার জন্য পৃথিবীও তো দায়ী। মনে মনে অনেক হম্বিতম্বি করে শেষ পর্যন্ত আর কিছু করতে না পেরে লোকটি টিভি অন করল। টেলিভিশনে তখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচন-পরবর্তী বক্তৃতা দেখাচ্ছিল। সেই সঙ্গে ছিল সিএনএনের নির্বাচন-পূর্ববর্তী ট্রাম্পের হেরে যাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণীর জরিপের তুলোধোনা করে চরম উত্তেজিত টকশো। ট্রাম্পের অহংকারী চিৎকার আর সিএনএনের অজস্র প্রতিবেদন, সাক্ষাৎকার আর টকশো দেখে জীবনে প্রথমবারের মতো লোকটির মনে হলো, আরে এই পৃথিবী তো বোকাদেরই আস্তানা। সবাই ট্রাম্পকে ঘৃণা করেও তাকেই তো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছে, তাহলে ভবিষ্যতে সেও তো যে কোনো সময় খোদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়ে যেতে পারে। ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে তার মধুর উপলব্ধি, এই পৃথিবী বোকাদের স্বর্গ, বোকাদের বাস, হোক না তাতে বিশ্বের সর্বনাশ।

নেহায়েতই কথার কথা। কিন্তু ঝাঁপি যখন খুললাম তখন আরও কিছু গুরুত্বহীন কথা শুনিয়ে দিই। এনবিসি টেলিভিশন একবার প্লেন ক্রাশের ওপর একটি ভুল রিপোর্ট প্রচার করে চরম বিপদে পড়ে। রিপোর্টটি ছিল অনেকটা এরকম— ৪৯ যাত্রীর সবাই প্লেন ক্রাশে সমুদ্রে ডুবে নিহত। চারদিক সমালোচনায় মুখর হলে এনবিসি দুঃখ প্রকাশ করে। ক্ষমা প্রকাশে তারা জানায়, আমরা জানতাম না আমাদের এখনো এত দর্শক আছে।

গল্প শেষ হয়নি, এক পরিবারের মা এবং ছোট কন্যা টেলিভিশন দেখছে। টেলিভিশনে চলছিল টকশো। যেনতেন টকশো নয়। তুমুল গরম উত্তেজিত আলোচনা। ট্রাম্প আর হিলারির পক্ষে-বিপক্ষে। এক আলোচক বলেন, ‘আমেরিকার এখন চেঞ্জ দরকার। আর কতকাল ডেমোক্রেট শাসন চলবে!’ আর এক আলোচক আরও তড়পে বললেন, ‘অবশ্যই চেঞ্জ দরকার, তবে ট্রাম্পের মতো মানুষ যাতে আর বর্ণবাদী বিদ্বেষ না ছড়ায় তার জন্য চেঞ্জ দরকার।’ আর এক আলোচক কথা কেড়ে নিয়ে বলেন, ‘আমি সব সময় চেঞ্জের পক্ষে সে যে বা যাই হোক না কেন।’ ক্লান্ত শিশুটি বলে উঠে, ‘মা ওদের মতো আমারও তো চেঞ্জ দরকার। আমার ন্যাপিটা চেঞ্জ করে দাও না।’

বিখ্যাত আমেরিকান স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান হেনরি ইয়াংম্যান একবার টেলিভিশন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘টেলিভিশন নিয়ে আমরা এত কথা বলি, কিন্তু আমরা কি কখনো খেয়াল করেছি টেলিভিশনের এমনই দুর্দশা যে এমনকি টেলিভিশনের নাটক বা গল্পের চরিত্রগুলো পর্যন্ত নিজেরা টেলিভিশন দেখে না।’

গণমাধ্যমের বোকা বাক্স টেলিভিশন নিয়ে মাতামাতি, উত্তেজনা, বিরাগ বা সমালোচনা নতুন নয়। এক সময়ের উত্তেজনা আজ অনেকটাই হতাশায় পরিণত হয়েছে। এমনকি শুধু দর্শক নয়, এ হতাশা কাজ করছে গণমাধ্যম কলাকুশলীদের মধ্যেও। কী হলো যে এত জনপ্রিয় মাধ্যম নিয়ে এত সমালোচনা বা একঘেয়েমির অভিযোগ? আর এক আমেরিকান কমেডিয়ান ফ্রেড অ্যালেন বলেছিলেন, ‘টেলিভিশন হলো এমন এক মাধ্যম যেখানে কোনো ভালো কিছু দুর্লভ।’ তাই কি? ফ্রেড অ্যালেনের মতে, মজার বিষয় হলো টেলিভিশন এমন মাধ্যম যা সেলিব্রিটি বানায়। এমনই সেলিব্রিটি যে তার সারা জীবন পরিশ্রম করে পরিচিত হওয়ার জন্য। তারপর? তারা সানগ্লাসে মুখ ঢাকে যাতে তাদের চেহারা কেউ চিনতে না পারে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে সেখানেই। টেলিভিশনের চরিত্র কি এমনই দ্বান্দ্বিক, এমনই বিভ্রান্তিকর! তাহলে আর একটি গল্প বলি। এক মহিলা অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে তার অফিসে দীর্ঘদিনের ছুটির আবেদন করল। বস ছুটি মঞ্জুর করায় সে মহাখুশি। বাসায় এসে ছুটির আনন্দে মহিলা তার বন্ধুদের সঙ্গে বাণিজ্য মেলায় গেল। দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানে তখন টেলিভিশনের লাইভ কাভারেজ হচ্ছিল। যথারীতি মহিলার ইন্টারভিউসহ লাইভ কাভারেজ হলো। ফলাফল- পরদিন তার ছুটি ক্যান্সেল। 

টেলিভিশনের একঘেয়েমি, বৈচিত্র্যহীনতা, বিষয়বস্তুর দুর্বলতা নিয়ে হাজারো অভিযোগ থাকলেও টেলিভিশন কিন্তু মানুষ দেখছে। সেটি নিউ মিডিয়ার বদৌলতে মাধ্যম পরিবর্তন করে অন্যখানে হলেও, টেলিভিশনের অনুষ্ঠান তারা কোথাও না কোথাও দেখছে। অনলাইনের হিট বা শেয়ারের সংখ্যাই তার প্রমাণ। কিন্তু বিখ্যাত মার্কিনি চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা, লেখক, মিউজিশিয়ান উডি অ্যালেন টেলিভিশনের ওপর এতটাই বিরক্ত ছিলেন যে বলতে দ্বিধা করেননি, ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষেরা তাদের বাড়ির ময়লা বাইরে কোথাও ফেলে না বরং তা দিয়ে টিভি শো তৈরি করে। গণমাধ্যমের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে সমালোচনা বরাবরই ছিল। আমেরিকান টিভি অ্যাংকর, প্রযোজক, অভিনেতা, লেখক, গণমাধ্যম সমালোচক, কমেডিয়ান স্টিফেন কোলবার্ট পক্ষপাতিত্বের উদাহরণ দিতে গিয়ে ফক্স নিউজ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ফক্স নিউজ প্রত্যেক স্টোরির দুটি দিকই তুলে ধরে, এক হচ্ছে প্রেসিডেন্টের দিক এবং দ্বিতীয় হচ্ছে ভাইস প্রেসিডেন্টর দিক।’ হয়তো তিনি সিবিএস এ ছিলেন বলেই ফক্স নিউজের সমালোচনায় তার সমস্যা হয়নি।

কিন্তু সমস্যা কি শুধু পক্ষপাতিত্ব না কি বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যের দুর্বলতায়! সৃজনশীলতায় সংকট! প্রযুক্তিগত দুর্বলতা! নাকি দক্ষ সৃষ্টিশীল কর্মীর অভাব! এক সময় মনে করা হতো আধুনিক প্রযুক্তি টেলিভিশনে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেবে। কিন্তু দেখা গেছে খুব উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করেও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সফলতার মুখ দেখছে না। তাহলে সমস্যাটি কোথায়? আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি যা অদ্ভুত সব সমস্যার চারণ ক্ষেত্র। পৃথিবী যত এগিয়ে যাচ্ছে, প্রযুক্তি যত বিকশিত হচ্ছে সমস্যার ধরনও তত বদলে যাচ্ছে। অনেকেই বলে থাকেন এত চ্যানেল, এত অনুষ্ঠান— কারা দেখবে বা কেন দেখবে? আমরা যারা গণমাধ্যমে কাজ করি তারা অনেকটা ‘দিন আনি দিন খাই’-এর মতো কাজ করি। আমরা সংবাদ সাজাই, অনুষ্ঠান বানাই, কিন্তু চিন্তা করি না কেন আমরা এটা করছি। আমরা কীভাবে তৈরি করব তা নিয়ে যতটা চিন্তা করি, কিন্তু কেন এগুলো তৈরি করা হবে বা অডিয়েন্স কোন তাগিদে এগুলো দেখবে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাই না। আমরা আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগি। ধরেই নিই কিছু সংবাদ, কিছু টকশো, কিছু নাটক, চলতি ট্রে-অনুযায়ী গানের অনুষ্ঠান করলেই দর্শক হুমড়ি খাবে আমার চ্যানেলে। কিন্তু বোকা বাক্সের বোকামিতে দর্শকদের বোকা বানানোর দিন শেষ। বরং দর্শকরাই এখন বলা যায় বিভ্রান্ত করে টেলিভিশনকে। স্পষ্ট প্রত্যাখ্যানে টেলিভিশন থেকে তারা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। অনেকেই বলেন টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে বড় ধরনের বিপ্লব আনতে হবে, নইলে দর্শক তা দেখবে না। ঘুরে-ফিরে সেই একই তো অনুষ্ঠান, একই সংবাদ। এর মধ্যে বিপ্লব আসবে কোথা থেকে বা কেমন করে আসবে!

কিন্তু সমস্যা যত বড় বা গূঢ় হবে তার সমাধানও তত অদ্ভুত বা সৃজনশীল হওয়া উচিত। তাই নয় কি? বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হলে শুধু খরচ কমানো বা কিছু সাধারণ প্রচলিত দক্ষতা এখন আর একমাত্র প্রযোজ্য শর্ত নয়। বরং প্রয়োজন সৃষ্টিশীল চিন্তা আর তার বাস্তবায়ন যাকে আমরা বলি ক্রিয়েটিভ রেভোল্যুশন। আমাদের টেলিভিশনগুলো কতটা ভারতীয় বা পশ্চিমা গণমাধ্যমের বাইরে গিয়ে নতুন চিন্তাকে উৎসাহিত করতে পারছে? সৃজনশীল ভাবনা কি আসছে না? নাকি সৃজনশীল ভাবনাকে উৎসাহিত করার মতো বিপ্লবী ব্যবস্থাপনা আর নেই। কোনো রকমে সংবাদ বা অনুষ্ঠান প্রচারই কি আমাদের লক্ষ্য? যে কোনোভাবে ব্যবসা করাই কি সাফল্যের একমাত্র চাবিকাঠি? নাকি জনগণের মধ্যে থেকে জনগণের ভাবনাকে তুলে আনায় অনাগ্রহ? আমরা টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কি এখন আর নতুন চিন্তাকে উৎসাহিত করছি না! পৃষ্ঠপোষকতার দুর্বলতা?  স্যার আন্থনি জে কে উদ্ধৃত করে মার্কিন লেখক জন ম্যাক্সওয়েল বলেছিলেন, ‘অসৃজনশীল চিন্তাও খুব সহজে ভুল উত্তর খুঁজে বের করতে পারে। কিন্তু ভুল প্রশ্নটি খুঁজে বের করা অনেক জরুরি কারণ সেই ভুল প্রশ্নটিই হচ্ছে নতুনত্বের, সৃজনশীলতার উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা’। ম্যাক্সওয়েল বলেছিলেন, ‘আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক উত্তরটি পাব না, যতক্ষণ না সঠিক প্রশ্নটি জানব।’ নতুন আইডিয়া তৈরি তাই কোনো দুর্ঘটনা নয়, ম্যাজিকও নয়। এটা ঘটতে হলে পরিবর্তন দরকার। স্বপ্ন শুধু দেখলেই হবে না। প্রয়োজন অন্তর্চক্ষুর উন্মোচন। সত্যের সঙ্গে, বাস্তবতার সঙ্গে তার সম্মেলন। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী থমাস আলভা এডিসনের কথাটি যদি বাংলায় ভেঙে বলি, এই গুরু বলে গিয়েছিলেন, ‘জিনিয়াস হলো এক পার্সেন্ট ঈশ্বর প্রদত্ত আর নিরানব্বই ভাগই ঘাম অর্থাৎ শ্রম।’ সেই ঘাম বা শ্রম আমরা কতটুকু দিচ্ছি বা এর সঙ্গে চিন্তার জোগান দিচ্ছি তো!

এবার আসি আমাদের টেলিভিশন প্রসঙ্গে। এত অনুষ্ঠান, চব্বিশ ঘণ্টা সংবাদ সম্প্রচার কিন্তু আদতে কি ঘটেছে বাংলাদেশের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে? কতজন মনোযোগী দর্শককে পাই আমরা আমাদের সঙ্গে? যদিও আমি আমার সহকর্মীদের মতো নিরাশাবাদী কণ্ঠে বলতে চাই না, যে কিছুই ঘটছে না বা কিছুই ঘটবে না। এখনো বিশাল সম্ভাবনা আছে এই গণমাধ্যমের। এখন পর্যন্ত গণমাধ্যম নীতিনির্ধারক/ব্যবস্থাপক বা আমরা কলাকুশলীরা একটা সেফ জোনে নির্দিষ্ট ঘেরাটোপে কাজ করে যাচ্ছি। নতুন প্রযুক্তির সীমাহীন সম্ভাবনাকে পুরোদস্তুর কাজে না লাগিয়ে বরং সীমিত প্রাপ্তিতেই আত্মসন্তুষ্টিতে আছি। সম্ভবত সীমানা ভাঙার সীমাবদ্ধতার আতঙ্কে ভীত আমরা। সে কারণেই হয়তো দর্শকরা ছেড়ে যাচ্ছে আমাদের। হয়তো ভিন দেশে, হয়তো ভিন্ন মাধ্যমে। নতুন প্রযুক্তির বিপুল প্রভাব ও প্রসারে রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র পরিণত হয়েছে সনাতন গণমাধ্যমে। আমরা দর্শক হারানোর আতঙ্কে আছি অথচ এই সনাতন গণমাধ্যম যে অপার সম্ভাবনা নিয়ে মানসজগতে বিচরণ করে এসেছে তার ক্ষেত্র কিন্তু সত্যিকার অর্থে একটুও কমেনি। বরং নতুন প্রযুক্তি আমাদের আরও সুবিধা করে দিয়েছে ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করার। কিন্তু সে সম্ভাবনাকে কতটুকু কাজে লাগাতে পারছি আমরা? চিন্তাকে আমরা বাক্সবন্দী করে ফেলছি। বাক্সের বাইরের দুনিয়া নিয়ে আমরা ব্যস্ত বা চিন্তিত নই বলেই ‘আউট অব দ্য বক্স’ কিছু করার ক্ষমতা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছি। সাইমন সিনেক তার বহুল বিক্রীত ‘দ্য গোল্ডেন সার্কেল’ বইটিতে লিখেছিলেন, যে কোনো কাজে আমরা কাজটি ‘কেন’ করছি জানার চেয়ে ব্যস্ত থাকি ‘কীভাবে’ কাজটি করব। অথচ ‘কেন’ এর মধ্যেই সব প্রশ্নের উত্তর নিহিত। আমরা গণমাধ্যমকর্মীরা কি আদতেই কোনো পরিকল্পনার পেছনে ‘কেন’ পরিকল্পনা করা হচ্ছে বা ‘কেন’ সেটি গণমাধ্যমে প্রচারিত হবে এবং ‘কীভাবে’ এর বিষয়বস্তু সব প্রযুক্তি, ইন্ডাস্ট্রি ও অডিয়েন্সের ওপর প্রভাব ফেলবে- তা কি কখনো ভেবে দেখি? ওই যে ম্যাক্সওয়েলের কথায় আবার ফিরে আসতে হয়। ভুল উত্তর তো গত্বাঁধা সব মানুষই বুঝতে পারে। কিন্তু ভুল প্রশ্নটি কি ধরতে পারি? আর সঠিক পথের সন্ধানে না গেলে যে বিদিশা হয়েই পথে পথে ঘুরতে হয়। সেই ঘেরাটোপেই বোধহয় আবদ্ধ আজ আমাদের প্রায় ২৯টি চ্যানেল। দর্শকদের অভিযোগ একই বিষয়বস্তু, একই অনুষ্ঠান, একই গল্প, ঘুরে ফিরে সেই একই মানুষের মুখ। কখনো সখনো দর্শক ফেরানোর চেষ্টায় চ্যানেলের চরিত্র বদলে ফেলে ভারতীয় অনুকরণে নাটক নির্মাণ। অথচ আমাদের টেলিভিশনে এখনো অসাধারণ সব মৌলিক নাটক বা অনুষ্ঠান হচ্ছে এবং হচ্ছে যে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ইউটিউবে তার হাজার হাজার হিট বা লাইক বা শেয়ার। তাহলে দর্শক কি মাধ্যম বদলে ফেলছে? আজ ইন্টারনেটেও টেলিভিশন দেখা যায়। মোবাইলের মুঠোয় চলে এসেছে এখন টেলিভিশন। প্রচলিত ড্রইংরুম মিডিয়ার ধারণা থেকে বের হয়ে এসে প্রযুক্তির সহায়তায় টেলিভিশনকে মানুষের হাতের মুঠোয় পৌঁছে দেওয়ার সময় এখন এসেছে। সময় এসেছে এই নীরব কিন্তু বিশাল জনগোষ্ঠীর কথা ভাবার, যারা হয়তো সময় নিয়ে টেলিভিশনের সামনে এসে বসে না, কিন্তু এই টেলিভিশনের সংবাদ, নাটক বা অনুষ্ঠানের তারা ভক্ত। এখানেই সুযোগ আছে আমাদের গণমাধ্যম কর্মীদের বিষয়বস্তুর উন্নয়নের। নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থেই এই উন্নয়ন। বৈপ্লবিক ভাবনা, অসাধারণ চিন্তা, সৃজনশীল আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানই পারবে এই জনগোষ্ঠীকে নিয়মিত দর্শকের আসনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। প্রযুক্তি আর সৃষ্টিশীলতার মিলন এখানে জরুরি। আর তখনই টেলিভিশনকে আবারও জনপ্রিয়তার কাতারে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। সম্ভব হবে এই টেলিভিশনের অস্তিত্বহীনতার শোরগোলের বিনাশ করা। বিশ্ব টেলিভিশন দিবস চলে এসেছে প্রতি বছরের মতো। আবারও সমালোচনা, আবারও আত্মজিজ্ঞাসা। কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবায়নের সেই প্রত্যয় নিয়ে দর্শকদের প্রতি গভীর ভালোবাসায় আমরা ক’জনা আছি টেলিভিশনের বৈপ্লবিক উন্নয়নে! 

শেষ করছি একটি জোকস দিয়ে। দুই বন্ধু কিঞ্চিৎ তরল অবস্থায় মদ্যপান করছিল আর টিভি দেখছিল। টিভিতে সে সময় সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে। এক ব্যক্তি ২০ তলা বিল্ডিং থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। দুই বন্ধুর একজন বলল, আমি বাজি ধরে বলতে পারি এই লোক আত্মহত্যা করবে। দ্বিতীয় বন্ধু বলল, না এই লোক আত্মহত্যা করবে না। টিভিতে দেখা গেল ব্যক্তিটি চোখ বন্ধ করে ছাদের কিনারায় দাঁড়াল আর ঝাঁপ দিল। দ্বিতীয় বন্ধু টাকা বের করে প্রথম বন্ধুকে দিয়ে বলল, আমি বাজিতে হেরে গেছি। প্রথম বন্ধু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, না এই টাকা আমি নিতে পারি না। আমি আসলে সংবাদটি দুপুরেই টিভিতে দেখে ফেলেছিলাম। দ্বিতীয় বন্ধু বলল, আরে তাতে কী হয়েছে আমিও তো সকালের বুলেটিনে সংবাদটি দেখেছিলাম, কিন্তু আমি ভাবতে পারিনি লোকটি একই ভুল দুবার করবে!

আমরা গণমাধ্যম কর্মী, নীতিনির্ধারক, ব্যবস্থাপকরা কি একই ভুল বারবার করছি!  কোন পথে হাঁটছি, জানি কি আমরা?

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর