মঙ্গলবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিমানমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

বিমানমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই

কদিন থেকে কোনো কিছুতে স্বস্তি পাচ্ছি না, কিছুই ভালো লাগছে না। চারদিকে কেমন যেন এক নিদারুণ শূন্যতা বিরাজ করছে। কদিন আগে এক প্রিয় সহকর্মী এনামুল হকের ছেলে এহসানুল হক খান শাহীন হঠাৎই চলে গেল। পেটের ভিতর অ্যাপেনডিসাইটিস ব্লাস্ট হওয়ায় তার মৃত্যু। শাহীন ছোট দুটি বাচ্চা রেখে গেছে। তাদের কী যে হবে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমারও তিনটি ছেলেমেয়ে। বড় হয়েও তারা বড় হয়নি। তাই খারাপ লাগে, ভয় হয় ওদের একটু স্বস্তিতে শান্তিতে রেখে যেতে পারব না! বঙ্গবন্ধু নিহত হলে তার প্রতিবাদ-প্রতিরোধে নির্বাসনে ছিলাম ১৬ বছর। তারই এক পর্যায়ে বাবা-মা, ভাইবোন, ভাবী যখন শিলিগুড়ির হাকিমপাড়ায় তখন সেই বাড়ির গৃহিণীর পেটে অ্যাপেনডিসাইটিস ফেটেছিল। কিন্তু আল্লাহর দয়ায় তিনি বেঁচে যান। এনাম ভাইয়ের ছেলে ভাগ্নে শাহীনকে যখন ঢাকা মেডিকেলে দেখতে গিয়েছিলাম তখন সেই শিলিগুড়ির কথা মনে হয়ে আশায় বুক বেঁধেছিলাম, হয়তো প্রিয় ভাগ্নে ফিরে এসে তার পরিবারের হাল ধরবে। কিন্তু তা আর হলো না।

মনটা আরও খারাপ হয়ে আছে প্রতিবেশী মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে। ইন্টারনেটে ঝুলন্ত উলঙ্গ নারীর মৃতদেহ দেখলাম। রাম-রাবণের উপাখ্যানে ছিন্ন মস্তক দেখলেও রোহিঙ্গাদের মস্তক, খণ্ড-বিখণ্ড দেহ দেখে স্থির থাকতে পারিনি। সারা জীবন খুব একটা ঘুমের ওষুধ স্পর্শ করতে হয়নি, সেই আমি আজ কদিন নির্ঘুম কাটাচ্ছি। একসময় ছিল যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ-প্রতিকার করেছি। কিন্তু এখন দেখছি বেঁচে থেকেও লাভ নেই, প্রতিকারের কোনো পথ নেই। চোখের সামনে মৃত্যু, কিন্তু মানুষ বেখবর। ইয়াবার নেশা, মোবাইল, ফেসবুকের নেশা, অর্থের নেশায় মানুষ বুঁদ হয়ে আছে। মায়া-মমতা-ভালোবাসা এসব সুকোমল বৃত্তি যেন নির্বাসিত। ’৭১-এ হানাদাররা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে প্রতিবেশী মহান ভারত আমাদের এক কোটি নিরাশ্রয় মানুষকে হায়েনার মুখের গ্রাস হতে দেয়নি। অথচ মুসলমান হয়ে পাশের দেশের মুসলমানদের আমরা আশ্রয় দিতে পারি না। কী আমাদের মানবতা! কী আমাদের মনুষ্যত্ব! প্রতিদিন প্রচার হচ্ছে ৮ নৌকা-১০ নৌকা, ১০০ জন-৫০০ জনকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কী সফলতা! নির্যাতিত মানুষকে আমরা বিমুখ করি। কিন্তু ইয়াবা ফেরাতে পারি না বা ফেরাতে চাই না বরং আলিঙ্গন করি। অং সান সু চি শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন— এই কি শান্তির নমুনা! আগে না হয় মিয়ানমারের সামরিক জল্লাদরা ছিল, এখন তো তারা নেই। তাহলে এই অমানুষিক বর্বর নির্যাতন কেন? সু চির শান্তির নোবেল ফিরিয়ে এখন কি তাকে অশান্তিতে নোবেল দেওয়াই যথার্থ নয়? এ ব্যাপারে সারা দুনিয়ার সোচ্চার হওয়া উচিত। বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহর।

দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী। দয়া-মায়া-মানবতা যার হৃদয় ভরা থাকার কথা। উপরন্তু তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। আমার বোনের মিয়ানমারের অসহায় মুসলিম জনগোষ্ঠীকে এভাবে হায়েনার মুখে ফিরিয়ে দিতে তার অন্তরে কি একটুও বাধে না? আমি যে মানবতাবাদী মানুষটিকে দেখেছি দয়া-মায়া-মমতা-ভালোবাসায় ভরা ছিল তার হৃদয়। কেউ প্রধানমন্ত্রী হলে অথবা সরকারি ক্ষমতা পেলে তবে কি তিনি আর মানুষ থাকেন না? তার কোনো মানবিক গুণ থাকে না? না, এমন তো হওয়ার কথা নয়। বঙ্গবন্ধু তো কত ক্ষমতাবান ছিলেন, ভারতের কত বড় বড় নেতা দেখেছি— ইন্দিরা গান্ধী, জ্যোতি বসু, জয় প্রকাশ নারায়ণ, চন্দ্রশেখর, বিজু পট্টনায়েক, নরসিমা রাও, প্রণব মুখার্জি, মধু দণ্ডপাত, শরৎ পাওয়ার, লালকৃষ্ণ আদভানি, অটল বিহারি বাজপেয়ি আরও কত নেতাকে দেখেছি তাদের মধ্যে অফুরন্ত দয়া-মায়া-ভালোবাসার পরশ পেয়েছি। আমাদের বোনের তো এসবে সবার ওপরে থাকার কথা। আমি মনে করি এখনো তিনি এসবে সবার ওপরেই আছেন।

মনটা আরও অশান্ত হয়ে গেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরে বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটির কথা শুনে। এও কি সম্ভব! কোনো ষড়যন্ত্র না হলে আধুনিক বিমানে তেলের পাইপের নাট-বল্টু ঢিলা থাকে! জিনিসটা তো আপনাআপনি হয়নি। কেউ সেটা করেছে। শুনলাম পাইলট আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কয়েকবার উড়েছেন। তাতে দোষের কী? ভিআইপি ফ্লাইট চালালেই কেউ ভিআইপি হয় অথবা ভিআইপির ঘনিষ্ঠ হয়? না। আর সবাই শেখ হাসিনা না। যত কথাই বলুন, সবার খোঁজখবর নেওয়ার বাবার মতো বোনেরও অভ্যাস আছে। সেটা বোধহয় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছিল না। এও তো হতে পারে, দুর্ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী যাতে মারা যান এটা তার এক সুগভীর চক্রান্ত। আল্লাহর দয়ায় আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে হারাইনি। যারা চালাচ্ছিলেন তারা দক্ষ ছিলেন বলে বিমান ঠিক সময় নামিয়েছিলেন। তাই আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রাণে বেঁচে গেছেন। কিন্তু যা শুনছি তাতে যে কোনো সময় বিমানে আগুন ধরে যেতে পারত। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেই তার জীবন নিয়ে ছেলেখেলা মুখ বুজে সহ্য করতে হবে তা কিন্তু নয়। পিতা যদি জিজ্ঞাসা করেন, ‘কাদের, আমি তো বাঁচতে পারলামই না। আমার মেয়েটাকেও মেরে ফেলল! তুই কিছু করলি না!’ কী জবাব দেব? আমি যে এখন প্রতিকারের অবস্থায় নেই তাকে কী করে বোঝাব। বিমানমন্ত্রী একজন প্রবীণ রাজনীতিক। কখনো আমাদের কল্যাণ কামনা করেননি, সারা জীবন সর্বনাশ চেয়েছেন। কত গালি দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর হার কালা হয়ে গেছে; তবু তাদের ঝাল মেটেনি। তারাই আজ বোনের ছায়াতলে কী নিরাপদেই না আছেন। হয় নিজেরা ষড়যন্ত্র করছেন অথবা যোগ্যতা-দক্ষতার অভাবে যারা ষড়যন্ত্র করছে তাদের ধরতে পারছেন না। বিমান ব্যর্থ, মন্ত্রণালয় ব্যর্থ অথচ তিনি ব্যর্থ নন, তিনি সফল— এও কি হয়! প্রধানমন্ত্রীর বিমান যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে যখন অবতরণ করে তখনই সুষুম তদন্তের নির্দেশ দিয়ে নৈতিক দায়িত্ব স্বীকার করে পদত্যাগ করলে তার প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা বেড়ে যেত। এ কে খন্দকারের মতো যত কিছুই হোক গদি আঁকড়ে থাকবেন, তা কি হয়? একটা রেল দুর্ঘটনার নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী পদত্যাগ করে ভারতকে জাগিয়ে দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর, শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, দেশের এক নম্বর নেতা তার জীবন নিয়ে এমন টানাটানি কল্পনা করা যায়? সত্যিই যদি কোনো অঘটন ঘটত ভারসাম্যহীন এক ভয়াবহ শূন্যতা আমাদের গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত করত। বিমান মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা বিমানমন্ত্রীকে স্বপদে রেখে বিচার করা যাবে না। নিশ্চয়ই যারা বিমানের নাট-বল্টু খুলেছে তাদের সঙ্গে যন্ত্রপাতি হাতে তিনি ছিলেন না। কিন্তু যারা যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করেছে বা করে তাদের পরিচালনার দায়িত্ব মাননীয় মন্ত্রীর, তা অস্বীকার করার সুযোগ তার নেই। তাই অনতিবিলম্বে এই ব্যর্থতার নৈতিক দায়িত্ব স্বীকার করে মন্ত্রী পদত্যাগ করুন, না হলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, তাকে বরখাস্ত করুন।

 

 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিমানের ত্রুটি নিয়ে এ পর্যন্ত যা বলা হয়েছে তাতে অনেক কিছুই পরিষ্কার নয়। এত বড় একটা ঘটনার পর মাননীয় মন্ত্রী চট করে বলে বসলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য আলাদা বিমান কেনা প্রয়োজন। তার মানে যাত্রীবাহী বিমানে তবুও যে রক্ষাকবচ আছে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্দিষ্ট বিমান থাকলে সে রক্ষাকবচটিও থাকবে না। আমার এ সন্দেহ দূর করবে কে? জনাব মেনন জননেত্রীর দয়ায় মন্ত্রী হয়েছেন, না হলে তার রাজনীতির যে অবস্থা তাতে সরাসরি নির্বাচন করে কোনো দিন ইউনিয়ন পরিষদেও বিজয়ী হতেন না। তিনি অনেক বড় নেতা এটা স্বীকার করি। কিন্তু জনপ্রিয় নন। যে যতই সমালোচনা করুন, বামপন্থি একজন নেতার এমনতর উদ্ভট প্রস্তাব মুহূর্তে জননেত্রী উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর জন্য আলাদা বিমান কেনা বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়। আমি তার এই অভিমতকে অভিনন্দন জানাই। তিনি আরও বলেছেন, তার যাত্রাপথে বিমানে স্বাভাবিক গোলযোগও হতে পারে, আবার মনুষ্যসৃষ্টও হতে পারে; এটাই নেতৃসুলভ যথার্থ মূল্যায়ন বা মতামত। আমি সারা জীবন এটাওটা নিয়ে নটখট করেছি। রেডিও খুলে ভিতরে কী আছে, টেপরেকর্ডারের মধ্যে কী আছে, ক্যামেরা খুলে ক্যামেরার ভিতর কী আছে, টিভি খুলে দেখার চেষ্টা করেছি তাতে কেন ছবি আসে। ছোটবেলায় সাইকেলে চড়তাম তারপর মোটরসাইকেল তারপর কার, জিপ। আমার জন্য কোনো গাড়ি-ঘোড়া ঠিক থাকত না। এটাওটা খোলা-লাগানো আমার সেই ছেলেবেলার অভ্যাস। কোনো গাড়ির তেলের পাইপ এমনি এমনি ঢিলা বা লুজ হয়? আর এমন সর্বাধুনিক বিমানের তেলের পাইপ লুজ তা তো কল্পনাও করা যায় না। কোনো শয়তানের আছর না হলে সর্বাধুনিক কম্পিউটারাইজড বিমানে কোথাও মাছি বসলেও তার খবর ককপিটে বসে পাওয়া যায়। আমার গাড়ির চালক যীশু একবার গাড়ির চাকায় একটা বোটপিন লাগায় অস্বস্তি বোধ করছিল। বার বার বলছিল, কী জানি হয়েছে, চাকা থেকে একটা আওয়াজ আসছে। সাভারের রাস্তায় আমিও ১-২ কিমি চালিয়ে ডান পাশের চাকায় আওয়াজ পাচ্ছিলাম। পরে গাড়ি থামিয়ে জগ লাগিয়ে ২-৩ মিনিট চাকা এদিক-ওদিক ঘুরাতে চোখে পড়ে একটা বোটপিন। একজন সাধারণ জিপ চালকের হাতে স্টিয়ারিং থাকলে তার অনুভূতিতে চাকার বোটপিন ধরা পড়ে তাহলে এত আধুনিক বিমান স্টার্টের পর দক্ষ পাইলটের অনুভূতিতে কিছুই ধরা পড়ে না; তা কি হয়? হয় না বলেই পাইলটরা নিজেদের জীবন বাঁচিয়েছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের বাঁচিয়েছে। এজন্য সেদিনের প্রধানমন্ত্রীকে বহন করা বিমানের কলাকৌশলী, পাইলট ও অন্য সবার অভিনন্দন পাওয়া উচিত এবং তাদের জাতির পক্ষ থেকে পুরস্কৃত করা উচিত।

দেশে অস্থিরতার যেন শেষ নেই। সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা তো আছেই। শিক্ষাঙ্গনও যেন কেমন একটা ভয়াবহ অরাজকতার মধ্যে রয়েছে। ফুলবাড়িয়া কলেজ সরকারিকরণের দাবি নিয়ে যে তুঘলকি কাণ্ড ঘটেছে তা একেবারেই বলার মতো না। উপজেলার একমাত্র প্রতিষ্ঠিত কলেজটি স্বাভাবিক নিয়মেই সরকারি হওয়ার কথা। কিছু দুষ্টচক্রের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সেটি না হয়ে যেটি এমপিওভুক্তিই হয়নি সেটি সরকারি করার কোনো মানে হয়? মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ করায় পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে সাধারণ পথচারী, শিক্ষক হত্যা— এর চেয়ে নিন্দার আর কী থাকতে পারে? মুক্তিযুদ্ধের সময় ফুলবাড়িয়ার রাঙামাটি, আছিম বহুদিন আমাদের স্থায়ী ক্যাম্প ছিল। রাঙামাটিতে দীর্ঘ কয়েক মাস লড়াই হয়েছে। রাঙামাটি হয়ে গারো বাজার, সেখান থেকে বেহুলা লখিনদর; তারপর সাগরদীঘি, সেখান থেকে বড়চওনা সখীপুর— এই রাস্তায় হানাদাররা ঢোকার চেষ্টা করেছে। আমরা সফলভাবে বার বার ফুলবাড়িয়া কেশরগঞ্জের কাছে রাঙামাটিতেই তাদের থামিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছি। কোনো দিন রাঙামাটির বাইদ পাড় হতে পারেনি। শুধু স্বাধীনতার যুদ্ধে নয়, তার আগে থেকেই ফুলবাড়িয়ার সঙ্গে আমাদের একটা নিবিড় যোগাযোগ ছিল। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে তেমন কলেজ ছিল না। বৃহত্তর ময়মনসিংহে আনন্দ মোহন, কিশোরগঞ্জে গুরুদয়াল, জামালপুরে আশেক মাহমুদ, টাঙ্গাইলে করটিয়া সা’দত কলেজ ও মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ ছিল একমাত্র সম্বল। আর বলতে গেলে সারা পূর্ব পাকিস্তানে একমাত্র কুমুদিনী মহিলা কলেজ। সেহেতু দেশের নানা জায়গার মেয়েরা যেমন কুমুদিনী কলেজে পড়তে আসত, ঠিক তেমন ছেলেরা আসত করটিয়া সা’দত কলেজে। সাগরদীঘি, আছিম, ফুলবাড়িয়ার অনেক ছাত্র করটিয়া কলেজে পড়ত, আমাদের সঙ্গে চলাফেরা করত। সেই সুবাদে ফুলবাড়িয়া চিনতাম, ত্রিশাল চিনতাম, উথুরা ভালুকা চিনতাম। বলতে গেলে বেশ ভালোভাবেই চিনতাম।

ফুলবাড়িয়ার এমপি মোসলেম উদ্দিন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, ভারতে যাননি। পাকিস্তানিদের সঙ্গে যতরকম উঠবোস সম্ভব সবই করেছেন। বেশ কয়েকবার তাকে ধরতে অভিযান চালিয়েছি। কিন্তু ধরতে পারিনি। স্বাধীনতার পর কীভাবে পার পেয়ে গেলেন বুঝতে পারলাম না। এখনো সেই একই অবস্থা। ’৭২ সালে  ফুলবাড়িয়া কলেজ হয়। সরকারি অর্থে দালানকোঠা যা দরকার তার প্রায় সবই আছে। তবু কলেজটি সরকারি হয়নি। এমপি মাত্র ৭ ডিসিমেল জায়গার ওপর ফজিলাতুন নেছা মহিলা কলেজ নাম দিয়ে এমপিওভুক্তির আগেই সরকারি করে ফেলেছেন। কেরামতির শেষ নেই। প্রথম প্রথম নিজের নামে মোসলেম উদ্দিন মহিলা কলেজ নাম দিয়েছিলেন। পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মায়ের নামে সরকারি করেছেন। এমন অন্যায় মানুষ সহ্য করে? তাই অশান্তি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এসব দেখা দরকার, ভাগাড়ের শকুনিরা কীভাবে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছে।

এমপি হিসেবে জনাব মোসলেম উদ্দিন ফুলবাড়িয়া কলেজের সভাপতি হয়ে প্রায় ৪০ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন। সেখানে তারাকান্দা বঙ্গবন্ধু কলেজ থেকে দুর্নীতির দায়ে বহিষ্কৃত তার, না তার ছেলের মেয়ের জামাই, নাকি ভাস্তির জামাই কাকে একজন প্রিন্সিপাল করেছেন। প্রফেসর, পিয়ন, চাপরাশি আরও ৮-১০ জন আত্মীয়কে নিয়োগ দিয়েছেন। সম্ভব হলে বাড়ির বিড়ালকেও একটা ভালো পদে নিয়োগ দিতেন যদি এ রকম লঙ্কাকাণ্ড না ঘটত। মানুষ তখনই ফুঁসে ওঠে যখন তার সহ্যের সীমা পার হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কলেজের শিক্ষক ও ছাত্রদের কথাবার্তায় বড় হতাশ হয়েছি। নকল করে পাস করা, ঘুষ দিয়ে চাকরি নেওয়া শিক্ষকদের কোনো জ্ঞান-গরিমা থাকে না। তাদের ওপর পুলিশি জুলুমের বর্ণনাও তারা দিতে পারেনি। মনটা ভেঙে গিয়েছিল। এই যদি শিক্ষাদীক্ষা হয়, জ্ঞান-গরিমা হয় তাহলে পরে তারা চলবে কী করে, দেশ চালাবে কী করে? গুলি খেয়ে মারা গেলে যন্ত্রণা কম। কিন্তু লাঠিপেটা করে কাউকে মারতে কত সময় লাগে, কত যন্ত্রণার সে মৃত্যু ভাবা যায়? ভারী মনে জুমার নামাজ আদায় করতে গিয়েছিলাম। নামাজ শেষে মোনাজাতে বুক ভরে গিয়েছিল। মনে হলো ইমাম ফুলবাড়িয়া কলেজের শিক্ষক। তিনি যখন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন, ‘হে আল্লাহ! ৩০ বছর আবুল কালাম আজাদ স্যারের সঙ্গে কাজ করেছি। এমন একজন ভালো মানুষকে তুমি বেহেশত নসিব কর। তার সমস্ত ত্রুটি ক্ষমা কর। দেশব্যাপী তার কত হাজারো ছাত্র আছে তাদের দোয়ার অসিলায় তুমি তাকে ক্ষমা কর।’ নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। ফেরার পথে বহুদিন পর ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে গিয়েছিলাম। মনোরম পরিবেশে বড় ভালো লেগেছে। সেখানে বলেছি জীবনে কোনো কোর্টে সাক্ষী হইনি। মোসলেম উদ্দিনকে নিয়ে যদি সরকার মামলা করে আমি অবশ্যই সাক্ষ্য দেব। স্বাধীনতার মাসে এ পর্ব পড়ায় স্বাধীনতা সম্পর্কে দুই কথা না লিখে পারছি না। কয়েকটা চ্যানেলে ৩ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অবিস্মরণীয় অবদানের কথা যেভাবে তুলে ধরছে তাতে কয়েক যুগ পর আমরা যে একেবারে মাঠে মারা যাব তার কী হবে? কোথায় ডিমাপুর আর কোথায় নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল? সেই ডিমাপুর থেকে উড়ে এসে হেলিকপ্টার থেকে নারায়ণগঞ্জে বোমা ফেলে সব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া— এও কি সম্ভব? যুদ্ধক্ষেত্রে রিভলবার আর হেলিকপ্টার প্রায় একই ধরনের অস্ত্র, কোনো কাজে আসে না। বর্তমান আধুনিক হেলিকপ্টারেও ৭০০-৮০০ মাইল উড়ে এসে আক্রমণ করা খুব একটা সম্ভব নয়। বলা হচ্ছে নবগঠিত বাংলাদেশ বিমান ভারতীয় বিমানবাহিনীকে সাহায্য করেছে, হানাদারদের চলাচল বন্ধ করেছে, ঢাকার অদূরে ছত্রীসেনা অবতরণে সাহায্য করেছে। এমন ইতিহাস বিকৃতি শতবর্ষ পর কী হবে? সবই তো তখন হবে একটা ফাঁকিঝুঁকির কারবার। ঢাকার অদূরে ছত্রীসেনা নামানোয় সাহায্য করেছে, ঢাকার আশপাশে কোনো ছত্রীসেনা কখনো নামানো হয়নি; কী করে সাহায্য করবে? ছত্রীসেনা এসেছিল শিলিগুড়ির বাগডোগরা থেকে। আর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে ভাঙাচোরা তিনটি তিন ধরনের যে বিমান ছিল সে তো ছিল ডিমাপুরে, প্রায় ১০০০ কিমি দূরে। এখনো অনেক আধুনিক হেলিকপ্টার অতদূর পাল্লা দিতে পারে না। ১০০০+১০০০=২০০০ কিমি চাট্টিখানি কথা! ছত্রীসেনা নেমেছিল আমার বুকের ওপর টাঙ্গাইলে, ঢাকার আশপাশে নয়। আর তাদের পাহারা দেওয়ার যুদ্ধবিমান তাদের সঙ্গেই ছিল। সাধারণত তাই থাকে। আর যা কিছুই হোক পরের ধনে কোনো ছত্রীবাহিনী পোদ্দারি করে না। আর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠনের সময় তাদের যে ভাঙা তিনটি বিমান দেওয়া হয়েছিল সেগুলো ছিল খুবই ধীরগতির। অনেক বেসরকারি টিভি চ্যানেল হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নানারকম হচ্ছে। বিমানবাহিনীর জনক এ কে খন্দকার নিজেই বলেছেন, তিনটি বেসামরিক বিমান নিয়ে গঠিত তার একটি অটার, একটি অ্যালোয়েট হেলিকপ্টার এবং একটি বিসি-৩ ডেকোটা (সি-৪৭)। যেটি ছিল জোতপুর মহারাজার। এগুলো কোনো যুদ্ধবিমান ছিল না। তিনটি বিমানকেই ঘষামাজা করে ওড়ার মতো করে তোলেন। বেসামরিক ছোট আকারের দুটি বিমান তার মধ্যে ডেকোটা সি-৪৭ মালামাল টানার জন্য ব্যবহৃত হতো। এসব বিমান দিয়ে যুদ্ধ করা যায় না। অ্যালোয়েট হেলিকপ্টারে স্বাভাবিক সময় একটানা ১০০০ কিমি পাড়ি দেওয়া অসম্ভব। কোনো কিছু ছাড়া শুধু তেল ভরা হয় তাহলেও একটানা হাজার কিমি দৌড়ানো সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের এসএমজির ভয়ে মিগ-১৯ খুব একটা আমাদের এলাকায় নিচু দিয়ে চলাচল করতে সাহস পেত না, হেলিকপ্টার তো দূরের কথা।

সেই কোথায় ডিমাপুর, তারপর কমলগঞ্জ, সেখান থেকে তেলিয়াপাড়া, তারপর প্রায় আড়াই-তিন ঘণ্টা উড়ে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল তেলের ডিপো জ্বালিয়ে ছারখার করে দিলেন— যুদ্ধের এত বছর কখনো ওসব শুনিনি। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এ রকম ধীরগতির মাত্র তিনটি মান্ধাতার আমলের জাহাজ নিয়ে ভারতীয় বাহিনীকে সাহায্য করল কোনো ক্ষতি হলো না? অথচ রাশিয়ার মিগ-২১ শব্দের দ্বিগুণ গতি যার সেই জেট বিমান পাকিস্তানের হাতে কয়েকটা ধ্বংস হলো? জানি না ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে আমরা কবে মুক্তি পাব। আর কার স্বার্থে এই ইতিহাস বিকৃতি? আজ থেকে ২০-৫০-১০০ বছর পর যখন ইতিহাসবিদরা স্কেল দিয়ে মেপে দেখবেন ওই ধরনের একটা অ্যালোয়েট হেলিকপ্টার স্বাভাবিক অবস্থায়ও একটানা এত সময় উড়তে পারে না তার তেল ফুরিয়ে যায়, তখন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এই গৌরবের কথা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাবে। তখন নকল মুছতে গিয়ে আসলও যে ঢাকা পড়বে, এ নিয়েই আমার যত চিন্তা। বিষয়গুলো একটু ভেবে দেখা দরকার। ঢাকার কাছে কোথাও ছত্রীবাহিনী নামেনি বা নামতে পারেনি। তাহলে কেন টিভি চ্যানেলগুলো নতুন ইতিহাস বানাচ্ছে, বুঝতে পারছি না।

লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর