শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগ আজ আর নেই

নূরে আলম সিদ্দিকী

সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগ আজ আর নেই

৫ ডিসেম্বর ছিল গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ৫৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৮৯২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা কলকাতা হাইকোর্টের প্রখ্যাত বিচারপতি স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দী। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ১৯১০ সালে তিনি গণিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ পান।  পরবর্তীতে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি যুক্তরাজ্যে গমন করেন এবং অক্সফোর্ডের সেন্ট ক্যাথেরিন কলেজে ভর্তি হয়ে আইন শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি (বিসিএল) অর্জন করেন। অক্সফোর্ড থেকে ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে আসার পর সোহরাওয়ার্দী কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশায় যোগ দেন।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার আকর্ষণে তিনি স্বরাজ পার্টিতে যোগদান করেন। দেশবন্ধু যখন কলকাতা সিটি করপোরেশন মেয়র, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হন এবং নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পান। সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে তখন একটি প্রবাদ প্রচলিত হয়েছিল যে, দেশবন্ধুর দুটি অনবদ্য সৃষ্টি শহীদ ও সুভাষ। সোহরাওয়ার্দী সমস্ত আভিজাত্যের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে ডকইয়ার্ড শ্রমিক, ধাঙড় থেকে শুরু করে নিম্নগোত্রের হিন্দু-মুসলমান সবাইকে নিয়ে তার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল তৈরি করেন। উল্লেখ্য, ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল ঢাকার আহসান মঞ্জিলে। নবাব, জমিদার, খান বাহাদুরদের প্রাসাদে ঘুরপাক খেত সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও হিসেব-নিকেশ। তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতিকে আভিজাত্যের প্রাসাদ থেকে মাটি ও মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসায় অনবদ্য ভূমিকা রাখেন। ফলশ্রুতিতে যা হওয়ার তাই হয়েছে। মুসলিম লীগের নেতৃত্ব আগলে থাকা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কারিগররা, এমনকি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সাহেবও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে আস্থায় নেওয়া দূরে থাক, তার যোগ্যতাকে ব্যবহার পর্যন্ত করেননি। তার রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতা। জনাব আবুল হাশিম সাহেবকে সামনে নিয়ে অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগকে তিনি শক্তিশালী সংগঠনে রূপান্তরিত করেন এবং তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রিমিয়ার পদে অধিষ্ঠিত হন।

৪৬-এর নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দী, হাশিম সাহেবদের ভূমিকাই মুখ্য ছিল। লাহোর প্রস্তাবে ংঃধঃবং ব্যাপারটিকে state-এ রূপান্তর করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শরৎ বোসকে সঙ্গে নিয়ে তিনি অবিভক্ত বাংলার একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে হলেও পাকিস্তান না হলে বংলাদেশের অভ্যুদয় হতো না। রক্ষণশীল হিন্দু নেতৃত্বের একটি অংশ তাকে ডাইরেক্ট অ্যাকশন দিবসের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে অভিযুক্ত করার অপচেষ্টা চালিয়েছিল। তবে গান্ধীজী এই অভিযোগটিকে গ্রহণ করেননি, কারণ তিনি সত্যটা জানতেন। শুধু অবিভক্ত বঙ্গের প্রিমিয়ার নয়, কলকাতার মুসলমানদের কাছে তিনি ছিলেন মুকুটহীন সম্রাট। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে কলকাতার অলিতে-গলিতে দাঙ্গাবিরোধী মিশন নিয়ে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন। এই সাহসিকতায় বিমুগ্ধ হয়ে মহাত্মা গান্ধী দাঙ্গাকবলিত নোয়াখালীতে তাকে সফরসঙ্গী করেন।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দূরদর্শিতা ছিল অনন্যসাধারণ। প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞান ও প্রদীপ্ত অভিজ্ঞতা তাকে তাত্ক্ষণিকভাবে সক্রিয় করে তোলে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে একটি জনসংগঠন গড়ে তোলার জন্য। দ্বি-জাতিতত্ত্ব ও ১৯৪৭ সালে জিন্নাহর গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা এবং নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে তিনি উপলব্ধি করতে ভুল করেননি বলেই তার প্রথম সংগঠনটির নাম হয়— জিন্নাহ মুসলিম লীগ। পরে এটা আওয়ামী মুসলিম লীগে রূপান্তরিত হয়। এই সুদূরপ্রসারী সংগঠক উপলব্ধি করেছিলেন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কোনো জনসংগঠনকে শিকড় গাড়তে হলে— অবয়বে, চিন্তাচেতনা ও মননশীলতায় এমন একটি ব্যক্তিত্বকে উপস্থাপন করতে হবে যাকে খাঁটি মুসলমান হিসেবে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করবে। সে কারণেই মওলানা ভাসানীকে আসাম থেকে এনে সংগঠনের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত করান। যার সাধারণ সম্পাদক হন টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাহেব, যুগ্ম-সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান। সোহরাওয়ার্দীর বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা এতই প্রকট ছিল যে, তার সযত্ন লালিত্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের জেলা, থানা, ইউনিয়ন এমনকি গ্রামে গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল।

 

সোহরাওয়ার্দী শেরেবাংলার জনপ্রিয়তার কথা সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন বলেই ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন করার জন্য শেরেবাংলার নেতৃত্ব তার কাছে অপরিহার্য ছিল। তখনকার সময়ে মুসলিম লীগের ভরাডুবি একটি অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন সাহেবও ছাত্রনেতা খালেক নেওয়াজের কাছে নিদারুণ পরাজয়বরণ করেন। শেরেবাংলা ’৫৪-এর নির্বাচনে জয়ের কৃতিত্ব দিয়ে সোহরাওয়ার্দীকে বলেছিলেন, আপনি নির্বাচনের জাদুকর। পশ্চিম পাকিস্তানও (সাধারণ জনগণ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের একাংশ) ’৫৪-এর অভূতপূর্ব বিজয়কে গণতন্ত্রের বিজয় হিসেবে গ্রহণ করে এবং নির্বাচনের অব্যবহিত পরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী করাচি পৌঁছলে তাকে অভূতপূর্ব গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়।

’৫৪-এর নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মান্ধ মুসলমানদের চিন্তা-চেতনাকে এত সূক্ষ্মভাবে পরিবর্তিত করে পৃথিবীর ইতিহাসে অভূতপূর্ব ও বিস্ময়কর বিজয়ী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চেতনাকে শুধু শাণিত ও উজ্জীবিতই করেনি, তার মনে এই প্রতীতি ও প্রত্যয়ের জন্ম দিয়েছিল যে, কোনো রকমে একটা সাধারণ নির্বাচন করতে পারলে বাঙালিদের নিরঙ্কুশ বিজয় হবে।

তিনি ওয়েস্ট মিনিস্টার ধরনের গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। কেননা— তার ধারণা ছিল রাষ্ট্রপতি পাঁচ বছরের জন্য একবার নির্বাচিত হলে তিনি অপ্রতিরোধ্য হয়ে যান। তিনি প্রায়শই উদ্ধৃত করতেন— ‘I will defer you upto the last but I will protect your right to defer me unto my death.’ 11 জন সদস্য নিয়ে ১৩ মাস তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। একমাত্র লক্ষ্য ছিল ১৯৫৮ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনটি করা। সেন্টো-সিয়েটো চুক্তির প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে তখনকার ছাত্রসমাজের উদ্দেশে তিনি ভাষণ দেন। সমাজতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে চুক্তি কেন করেননি— ছাত্ররা এ প্রশ্ন করলে স্মিত হেসে তিনি জবাব প্রদান করেন —  zero plus zero plus zero is equal to zero.

’৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের অন্তর্নিহিত আঙ্গিক ছিল— হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুক্তি এবং মৌলিক গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রথা বাতিল করে সাধারণ ভোটে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা।

উনি তখন কাকরাইলে মানিক ভাইয়ের বাসায় অবস্থান করতেন। ওখানেই শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শেখ ফজলুল হক মণি, এনায়েতুর রহমান, ওবায়দুর রহমান প্রমুখ নেতার সঙ্গে কর্মী হিসেবে কাছ থেকে নেতাকে দেখতে পাই। ছাত্রলীগ নেতারা সবিনয়ে শহীদ সাহেবকে বললেন— স্যার, আপনার অবর্তমানে নূরুল আমিন সাহেবকে আহ্বায়ক করে যে এনডিএফ গঠিত হয়েছে এখন তার প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে, আপনার বর্তমানে নূরুল আমিন সাহেব এনডিএফ প্রধান থাকতে পারেন না। তিনি স্মিত হাস্যে জবাব দিলেন— গোলামের মধ্যে কে বড় গোলাম তা দেখার সময় এটি নয়, এটি গোলামি থেকে বিমুক্তির আন্দোলন।

তিনি বৈরুতে চিকিৎসা করতে যাবেন। তখন আতাউর রহমান খান, সালাম খান, জহিরউদ্দিন সাহেব, আবুল মনসুর আহমেদ, খাজা খয়রাত হোসেনসহ সবাই উপস্থিত ছিলেন। তাদের একজন নেতাকে প্রশ্ন করলেন— স্যার, আমাদের জন্য কি রেখে যাচ্ছেন? তিনি বললেন— একটি কলম (মানিক মিয়া) আর একটি মাঠ (মুজিব)। যুক্ত বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টার পুরো রাজনীতিটাই ছিল পূর্ব পাকিস্তানকেন্দ্রিক।

১৯৫৭ সালে তাত্ত্বিক সমাজতন্ত্রীরা কাগমারী সম্মেলনে শহীদ সাহেবের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ হিসেবে মওলানা ভাসানীকে দাঁড় করান। সেই সম্মেলন থেকেই মওলানা ভাসানী ও মোজাফফর সাহেবের নেতৃত্বে ন্যাপের জন্ম। এবার আওয়ামী লীগের আড়ম্বরপূর্ণ ২০তম সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে যথাযথ সম্মান দেখানো হয়নি। এটি ছিল খুবই দুঃখজনক এবং এর মধ্য দিয়ে দলটির বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বের মননশীলতার দীনতা উৎকটভাবে প্রকাশ পেয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনিই মওলানা ভাসানীকে আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত করান। তার লেবাস, চেহারা-সুরত তখনকার দিনে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কাগমারী সম্মেলনে আওয়ামী লীগের বিভক্তির (ন্যাপ ভাসানীর জন্ম হয়) পর মরহুম মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ সাহেব সভাপতি পদে মওলানা ভাসানীর স্থলাভিষিক্ত হন। আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতা-কর্মীদের কাছে সেসব ইতিহাস আষাঢ়ে গল্প বলেই মনে হবে। আমি ভেবে আশ্চর্যান্বিত ও বিস্ময়াভিভূত হই যে, এভাবে চলতে থাকলে এখনকার প্রজন্ম ভাবতে শিখবে— শেখ হাসিনাই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা।

মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও আমাদের মুজিব ভাইয়ের সযত্ন লালিত্যে গড়ে ওঠা আওয়ামী লীগের শিকড়টি বাংলার মাটিতে ও মানুষের হূদয়ের এত গভীরে প্রোথিত ছিল যে, দিল্লিতে অবস্থানকালীন ঢাকার কাউন্সিলে সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর দীর্ঘ ১৫ বছর বিরোধী দলের রাজনীতি করলেও শেখ হাসিনার চলার পথ অপ্রতিরোধ্য ছিল। কারণ সারাটি পথই মানুষের ভালোবাসার আবীর মাখানো ছিল। মানুষের নিষ্কলুষ ভালোবাসা ও জাতির জনকের প্রতি বাংলার মানুষের শর্তহীন আনুগত্য, তাদের আবেগ-উচ্ছ্বাস, মননশীলতা ও অনুভূতি, সব হারানোর বেদনায় হূদয়ে রক্তক্ষরণ হলেও কোটি মানুষের এই নিঃশর্ত আনুগত্য শেখ হাসিনাকে উদ্বেলিত করেছে, উচ্ছ্বসিত করেছে, আন্দোলিত করেছে।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শের উত্তরাধিকারের সত্তায় উদ্ভাসিত নতুন প্রজন্মের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাছে আমার দাবি, মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে ভূমিকা রাখুন এবং আওয়ামী লীগের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমণের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস হূদয়ঙ্গম করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করুন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চিন্তার আঙ্গিকেই সিক্ত ছিলেন মুজিব ভাই। একেকটি আন্দোলনের সোপান উত্তরণের মাধ্যমে নেতার অনুকরণেই তিনি ধীর পদক্ষেপে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার চেতনায় জনগণকে উজ্জীবিত করেন। তার চেতনার উত্তরাধিকার ও বাস্তবায়নের মূল কারিগর ছিল ছাত্রলীগ।

’৭০-এর নির্বাচন স্বাধীনতা প্রাপ্তির নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট এনে দেয়। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জীবনের স্বপ্ন ও সাধনা ছিল পাকিস্তানে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের। জীবদ্দশায় সম্ভব না হলেও তার আকাঙ্ক্ষিত নির্বাচনই পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে আর তা সম্ভব হয় তার অতি স্নেহ ও আদর্শের অনুসারী তারই মুজিবের হাত ধরে। একান্তে আমার ভাবতে ভালো লাগে— বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা ও শহীদ সাহেবের জ্ঞানপ্রদীপ্ত রাজনৈতিক দূরদর্শিতার সংমিশ্রণ হলে বাংলাদেশ আজ কোথায় যেতে পারত।

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার দাবি করছেন। সেনাবাহিনীকে দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অলীক দাবিটি আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসির সঙ্গে মিলে যায়। গণতন্ত্র বা নির্বাচন রাজনৈতিক শক্তির অনুশীলনের বিষয়। সেখানে সেনাবাহিনীকে প্রয়োজন হলে তো রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রয়োজন থাকে না।

বৈদ্যুতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতে রোহিঙ্গা প্রশ্নে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই এমন মর্মান্তিকভাবে আলোচনা করছেন যে, তাতে একটা ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে— ভিটামাটি ছেড়ে উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষায় যেন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পাড়ি দিচ্ছে। সামরিক জান্তার নির্মম হত্যাকাণ্ড, অগ্নিকাণ্ড, ব্যভিচার, লুণ্ঠন তাদের যে ঘরবাড়ি থেকে নির্মম ও পৈশাচিকভাবে উচ্ছেদ করেছে— এটা তারা আমলেই আনতে চান না। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক যে অকুতোভয় সাহসী ভূমিকা নিয়েছেন, তার প্রতি অভিনন্দন জানিয়ে আমি শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করব, মালয়েশিয়াকে বলিষ্ঠ সমর্থন প্রদানের। রাজাক যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, সেটি বিশ্বের মুসলমানদের জন্য মানবিকতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ এখনো যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোস্টগার্ড ও বিজিবি দিয়ে তাদের প্রবেশ রুদ্ধ করছে, এটি অচিন্ত্যনীয়। তাদের আশ্রয় দিয়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে প্রয়োজনে তীক্ষ নজরদারির মধ্যে রেখে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ঝুঁকি এড়ানো যায়।  ওআইসি, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটা গ্রহণযোগ্য ও যৌক্তিক সমাধানের ব্যাপারে বাংলাদেশ উদ্যোগ নিতে পারে।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহনশীলতা, প্রাপ্তির প্রত্যাশা না করে শুধুই দেওয়ার ঔদার্যময় আদর্শের অনুকরণে নতুন প্রজন্ম সূর্যস্নাত হবে— জীবনসায়াহ্নে এসে এই আমার অন্তিম প্রত্যাশা।

            লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর