শুক্রবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

দাওয়াতুন্নবী (সা.)-এর প্রয়োজনীয়তা

মুফতি আমজাদ হোসাইন

দাওয়াতুন্নবী (সা.)-এর প্রয়োজনীয়তা

আম্বিয়ায়ে কেরামদের (আ.) দুনিয়ার বুকে আগমনের উদ্দেশ্যই হলো মানব জাতিকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করা। দাওয়াত শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর আল্লাহ শান্তি-নিরাপত্তার আলয়ের প্রতি আহ্বান জানান এবং যাকে ইচ্ছা সরল পথ প্রদর্শন করেন’। (সূরা ইউনুস : ২৫) আলোচ্য আয়াতে ‘দারুসসালাম’-এর দিকে আল্লাহ পাক মানব জাতিকে আহ্বান করেন।  ‘দারুসসালাম’-এর অর্থ হলো জান্নাত। এক কথায় আল্লাহতায়ালা মানব জাতিকে শান্তির আলয়ের দিকে আহ্বান করেন। অর্থাৎ এমন গৃহের দিকে আহ্বান করেন যাতে আছে সর্ববিধ শান্তি ও নিরাপত্তা। যেখানে দুঃখ-বেদনার কোনোই স্থান নেই। এ কারণেই জান্নাতের নাম দারুসসালাম রাখা হয়েছে। দাওয়াত কবুল করার মাধ্যমেই মানুষ প্রকৃত মানুষ হতে শিখে। নবী ও রসুলদের সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী হলেন হজরত মোহাম্মদ (সা.)। তিনি শুধু দুনিয়ার বুকে এ জন্য আসেননি যে, দুনিয়ার সব জাতি-গোষ্ঠীর মাঝে মুসলিম জাতি বা উম্মতে মোহাম্মদী নামের একটি নতুন জাতির সংযোজন করবেন বরং তিনি দুনিয়ার বুকে আগমন করেছেন দুনিয়াবাসীর জন্য এক বিশেষ বার্তা নিয়ে। তা হলো, এক আল্লাহর ওপর এবং আখেরাতের প্রতিদান ও বিশ্বাস, নেক আমল, চরিত্র গঠন এবং দুনিয়ার বুকে কল্যাণের প্রচলনে নিষ্ঠাপূর্ণ ফিকির ও প্রচেষ্টা করে যাওয়া। এই মহাবিধানের নামই হলো ইসলাম। ইসলামের দিকে এই আহ্বানটি দুনিয়াবাসীর জন্য কোনো অভিনব বা নতুন কোনো বিধান ছিল না। বরং এটা ছিল সেই মৌলিক ও বুনিয়াদী বিধান যে কাজটি হুজুর (সা.) আগে আগত আল্লাহর সব নবীই করেছেন। নবীজী দরদমাখা ভাষায় মানুষদের ইমান ও ইসলামের প্রতি দাওয়াত দিয়েছেন। এখানে একটি প্রশ্ন আসতে পারে যে, নবীজী যখন দুনিয়ার বুকে আগমন করেছিলেন তখন পয়গম্বরদের নাম উচ্চারণকারী কয়েকটি জাতি বিদ্যমান ছিল। হজরত মুসা (আ.)-এর উম্মত বিদ্যমান ছিল, হজরত ঈসা (আ.)-এর উম্মত বিদ্যমান ছিল, হজরত ইবরাহিম ও হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর নাম উচ্চারণকারীরাও বিদ্যমান ছিল। তাহলে নতুনভাবে দাওয়াতের প্রয়োজন কেন ছিল? এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হবে যে, আলোচ্য নবী ও রসুলরা যেসব বিধান তাদের কাছে রেখে গিয়েছিলেন তখনকার মানুষ তার সবই নিজেদের হীনস্বার্থে বিকৃত করে ফেলেছে। এবং এই পরিমাণ বিকৃতি সাধিত হয়েছিল যে, চারদিকেই ছিল শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। স্বয়ং নিজের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়ে ইবলিসের প্ররোচনায় তাগুতের পূজা করতে শুরু করেছিল। পরকালের প্রতিদান ও শাস্তির বিষয়ে সবাই ছিল গাফেল ও উদাসীন। তখন তাদের আমল ছিল পূতিগন্ধময় আর চরিত্র ছিল পশুসুলভ। একপর্যায়ে তো তারা বলেই বসল যে, যেমনটি পবিত্র কোরআনে মহান রব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন। ‘তারা বলে : আমরা কি উল্টো পায়ে প্রত্যাবর্তিত হবই- গলিত অস্থি হয়ে যাওয়ার পরও। (সূরা নাযিআত : ১০, ১১) আলোচ্য আয়াতের মধ্যে আল্লাহপাক কাফের-মুশরিকদের কথাই বর্ণনা করছেন। এক কথায় মানব জাতি এক আল্লাহ ও পরকালকে ভুলতে বসেছিল। তাদের কাছে আল্লাহর যে কিতাব রক্ষিত ছিল যেমন— তাওরাত, জবুর ও ইনজিলের মধ্যে মহানবীর আগমনের কথা সুস্পষ্ট অক্ষরে লেখা ছিল। তারা তাও বিকৃত করে ফেলেছিল। দুনিয়াবাসীর চরিত্রের এই নাজুক পরিস্থিতিতে আল্লাহপাক মহানবী (সা.)কে পাঠিয়ে মানব জাতিকে মানবতা ইনসানিয়াত শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বিদায় হজের ভাষণে বলে গেছেন তোমাদের জন্য ইসলামই একমাত্র আল্লাহর মনোনীত ধর্ম। যারা ইসলামকে মানবে তাদের ওপরই আল্লাহপাক সন্তুষ্ট থাকবেন। প্রিয় পাঠক, রসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর কিছুকাল পর্যন্ত দুনিয়ার নকশা এবং মানুষের চরিত্র নবীজীর দাওয়াতের প্রভাবে ঠিক ছিল। এরপর থেকে মানুষের ইমান-একিন ও চরিত্রের মাঝে পরিবর্তন আসতে থাকে। এর একমাত্র কারণ হলো মানুষ দাওয়াতুন্নবীর পথ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। রসুল (সা.)-এর আহ্বান বাদ দিয়ে শয়তানের আহ্বানের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েছিল। এ আলোচনা দ্বারা আশা করি আমরা বুঝতে পেরেছি যে, যতদিন পর্যন্ত দুনিয়ার বুকে সঠিক পদ্ধতিতে তালিম-তারবিয়্যাত, তাজকিয়া, খানকা ও দাওয়াতের কাজ থাকবে ততদিন পর্যন্ত দুনিয়ার বুকে কলেমা পড়া লোক থাকবে। যদি এই কাজগুলো না থাকে তাহলে কলেমা পড়া লোক থাকবে না। তখনই দুনিয়া বিলীন হয়ে যাবে। প্রিয় পাঠক, সমাজে অনেক মানুষ এখনো এমন আছে যারা কলেমা কি জিনিস, নামাজ-রোজা কি জিনিস, হালাল-হারাম কাকে বলে কিছুই জানে না। তালিম-তারবিয়্যাত ও দাওয়াতের মাধ্যমে তাদের দীন ইসলাম ও অনাবিল শান্তি জান্নাতের দিকে আহ্বান করা কি আমাদের দায়িত্ব নয়? মানুষের ভিতরে যখন আল্লাহর ভয় আসবে তখন সে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকবে। তাদের মধ্য থেকে হিংসা-বিদ্বেষ চলে যাবে। মানুষ শান্তি ও সুখী সমাজে বসবাস করবে। যেখানে চুরি-ডাকাতি থাকবে না। থাকবে না দুর্নীতি বা অসদাচরণ।  থাকবে শুধু ন্যায়-ইনসাফ। সবাই এক মনে এক ধ্যানে এক আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকবে। মহান রব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে সঠিক পদ্ধতিতে দাওয়াতের কাজ বেশি বেশি করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

            লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব বারিধারা, ঢাকা।।

সর্বশেষ খবর