শনিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা শরণার্থী : সমস্যা নাকি বাণিজ্য

তুষার কণা খোন্দকার

রোহিঙ্গা শরণার্থী : সমস্যা নাকি বাণিজ্য

রোহিঙ্গা সমস্যা ঘুরেফিরে আবার খবরের শিরোনামে এসেছে। মিয়ানমারের পাশে বাংলাদেশের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ, উখিয়া, রামু কিংবা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ নতুন নয়। এদের অনুপ্রবেশ যখন বাড়াবাড়ি রূপ নেয় তখনই খবরটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার পায়। আদতে বাংলাদেশের ভিতরে রোহিঙ্গাদের আনাগোনা নিত্যদিনের ঘটনা। অনেক সময় বিশেষ কারণে বাংলাদেশে তাদের উপস্থিতি সরব হয়ে ওঠে। রোহিঙ্গাদের আসা-যাওয়ার কার্যকারণ নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বিচার করে মনে হয়, রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের সমস্যা নয়, সমস্যা বাংলাদেশের। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ভালো আছেন আমি সে কথা বলছি না। সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের কারণে পৃথিবীর বহু দেশে বহু সম্প্রদায় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতা প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করছে। ঘরের পাশে ইন্ডিয়ায় মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগ তুলে সাতজন মুসলমানকে স্রেফ পিটিয়ে মারা হয়েছে। মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী তখন সেখানে দুই দিনের দাঙ্গায় আড়াই হাজার মুসলমানের প্রাণ গিয়েছিল। ইন্ডিয়ায় এখনো হরিজনকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা বিরল নয়। প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বৈরিতা মোকাবিলা করে হরিজন কিংবা মুসলমান সম্প্রদায় ইন্ডিয়ায় টিকে আছে। গুরুতর যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি না হলে কেউ সীমান্ত অতিক্রম করে ভিন্ন দেশে শরণার্থী হতে যায় না। রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। তারা বার বার সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে চলে আসে। আসলে রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় সীমান্ত অতিক্রম করে এ দেশে চলে আসে, নাকি বাংলাদেশের স্বার্থান্বেষী একটি মহল মিয়ানমারের বৈরী পরিবেশের অজুহাতে তাদের প্ররোচনা দিয়ে টেনে আনে?

বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবারও বললেন, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিন। জামায়াত ঘরানার বিএনপি নেত্রী তার অবস্থান নিয়ে নতুন কিছু বলেননি। তিনি তার নির্বাচনী ফায়দার চিন্তা মাথায় রেখে তার পুরনো অবস্থান নতুন করে ব্যক্ত করেছেন। ২৬ নভেম্বর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কথা বলতে তিনি বিব্রতবোধ করছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা থেকে কে কী বুঝেছেন জানি না, তবে আমি দেশের দায়িত্বশীল একজন মন্ত্রীর বিব্রত হওয়ার মর্তবা বুঝতে পারিনি। বিব্রত ব্যক্তিটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে বহাল থেকে মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব নিয়েই তার বিব্রতভাব তুলে ধরেছেন। তার কথার সূত্রে আমরা ধরে নিতে পারি রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বর্তমান সরকার সুনির্দিষ্ট অবস্থান নিতে পারছে না। কাজেই সরকার বিব্রত। তাই যদি সত্য হয় তাহলে বলতে বাধ্য হচ্ছি, রোহিঙ্গা ইসু্যু নিয়ে খালেদা জিয়ার অবস্থান যতখানি স্বচ্ছ তার বিপরীতে সরকারের অবস্থান ততখানি অস্বচ্ছ। আওয়ামী লীগ সরকারের তিন কিস্তিতে গদিনশিন থাকার আমলনামা ঘেঁটে দেখা যায়, রোহিঙ্গা বিষয়ে সরকারের এমন অস্বচ্ছ অবস্থান নতুন নয়। বিএনপি সরকার গঠন করলে রোহিঙ্গাদের ঘটা করে দাওয়াত দিয়ে বাংলাদেশে আনা হয়। এতে তাদের কোনো রাখঢাক নেই। তিন কিস্তিতে আওয়ামী লীগ প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকেও রোহিঙ্গা প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান স্বচ্ছ করতে পারল না কেন, তা একটি প্রশ্ন। ১৯৭৮ কিংবা ’৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে নাফ নদের বাংলাদেশ তীরে ‘আহলান ওয়া সাহলান’ ব্যানার টানিয়ে প্রকাশ্যে দাওয়াত দিয়ে রোহিঙ্গাদের এপারে আনা হয়েছে। বিএনপির দোসর জামায়াতে ইসলামীর নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি হয়তো প্রয়োজন ছিল। রোহিঙ্গাদের নিয়ে জামায়াতের বিভিন্ন কর্মসূচির খবর সেই সময়ের পত্রপত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হতো। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি অংশ আফগানিস্তানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে দুর্ধর্ষ তালেবান হয়েছিল, সে খবর আপনারা নিশ্চয়ই পত্রিকায় পড়েছিলেন। ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গাদের মদদ দেওয়ার জন্য জামায়াত সমর্থিত এনজিও রাবেতা আল আলম আল ইসলাম, আল মারকাজুল ইসলাম ইত্যাদি তড়িঘড়ি নাফের তীরে গিয়ে হাজির হয়েছিল। রাবেতা কিংবা আল মারকাজুল ইসলামকে যথাবিহিত মদদ দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনও ‘আমি হাজির, আমি হাজির’ বলে সেখানে ছুটে এসেছিল। যেখানে যে দেশে দাঙ্গা-সংঘাতের ঘটনায় পশ্চিমা স্বার্থ জড়িত থাকে সেখানে শরণার্থী হাইকমিশন পশ্চিমা স্বার্থের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মনমতো গল্প সাজায়। জামায়াত এবং জাতিসংঘ একযোগে কেন রোহিঙ্গা নিয়ে মাতামাতি করে সে তথ্য বিশ্বরাজনীতিসচেতন মানুষ এখন ভালো করেই জানে। মধ্যপ্রাচ্যে হামাস, আল-কায়েদা, আল নুসরা কিংবা আইএসের উত্থানের পেছনে পশ্চিমা মদদের কেচ্ছা দুনিয়ায় কারও অজানা নেই। রোহিঙ্গা নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়া কেন কাঁদে, তা বুদ্ধিমান মানুষ দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নিজেরা বেশ বুঝতে পারে। শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের একপেশে ভূমিকা যাচাই করার জন্য দূরে যাওয়ার দরকার কী। বাংলাদেশে বসবাসকারী বিহারিদের বিষয়ে ইউএনএইচসিআরের ভূমিকা স্মরণ করে দেখুন। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বিহারি সম্প্রদায় যথেষ্ট কষ্ট ভোগ করেছে। তারা পাকিস্তানে প্রত্যাবাসিত হতে চেয়েছিল। ইউএনএইচসিআর বিহারিদের কোনো দিন শরণার্থী স্বীকৃতিটুকু দেয়নি। যুদ্ধবিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্যের শরণার্থীদের সেবায় শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন কতটুকু তৎপর? ইউএনএইচসিআর তৎপর থাকলে কি এত মানুষ সাগরে ডুবে মরতে পারত? মধ্যপ্রাচ্যের শরণার্থীদের সাহায্য করার ব্যাপারে জাতিসংঘ কতটা আন্তরিক, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া না গেলেও রোহিঙ্গাদের বিষয়ে হাইকমিশনের অতি তৎপরতা আমার কাছে সব সময় দৃষ্টিকটু, বাড়াবাড়ি। ১৯৯১ সালে জামায়াত ঘরানার বিএনপি সরকার রোহিঙ্গাদের ফুসলানি দিয়ে সাদরে বাংলাদেশে ডেকে এনেছিল। সেই সঙ্গে শরণার্থী কর্মসূচি চালানোর জন্য দেশি-বিদেশি ৩৩টি এনজিওকে মাঠে নামায়। সর্বোপরি ইউএনএইচসিআরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে বিএনপি সরকার রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী রূপ দেওয়ার কাজটি সফলভাবেই করেছে। তার পরও আমি বলব, রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বিএনপি সরকারের অবস্থান বেশ স্পষ্ট ছিল। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে সাদরে বরণ করে নিয়ে তারা বলেছে, ‘ওরা আমাদেরই লোক’। আওয়ামী লীগ কি রোহিঙ্গা প্রশ্নে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে একমত? আওয়ামী লীগ তিন দফায় সরকার গঠন করার পরও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারল না কেন? তিন দফায় প্রায় দেড় দশক ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে সমস্যার সমাধান না করে রোহিঙ্গা সমস্যা প্রশ্নে তার অবস্থান বড্ড ঘোলাটে করে ফেলেছে। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে কথা বলতে বিব্রত হয়েছেন। ২৬ নভেম্বর ডেইলি স্টারের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা ছবি ও তথ্য আমাদের বিব্রত নয়, বরং চিন্তিত করে তুলছে। দুনিয়ার নানান প্রান্তের নানান ঘটনা-দুর্ঘটনার ছবি জোগাড় করে সেগুলোকে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ছবি হিসেবে যেভাবে চালানো হচ্ছে বলে পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় খবর প্রকাশিত হয়েছে তাতে আমরা বিব্রত নই, শঙ্কিতবোধ করছি। ১৯৯১ সালে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে ২০টি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল। ’৯৫ সালের মধ্যে তাদের প্রায় সবাই নিজেদের দেশে ফিরে গিয়েছিল। তারপর ১৮টি ক্যাম্প বন্ধ করে দিয়ে অবশিষ্ট ২১ হাজার শরণার্থীকে কুতুপালং ও নয়াপাড়া ক্যাম্পে আশ্রয় দেওয়া হলো। এ দুই ক্যাম্পের শরণার্থী সংখ্যা বেড়ে এখন কত হয়েছে আমার জানা নেই। বেশির ভাগ রোহিঙ্গা পুরুষের বউয়ের সংখ্যা একাধিক এবং চার বউয়ের ঘরে ১৫-২০টি বাচ্চাকাচ্চা রোহিঙ্গা সমাজে সাধারণ ঘটনা। ক্যাম্পবাসী রোহিঙ্গার সংখ্যা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে এতদিনে অনেক হয়েছে নিশ্চয়ই। ২০টির মধ্যে ১৮টি ক্যাম্পের ২ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় স্বদেশে ফিরে গেলেও ২১ হাজার কিছুতেই ফিরতে পারল না, নাকি তাদের টোপ হিসেবে বাংলাদেশের মাটিতে রেখে দেওয়া হলো? ইউএনএইচসিআর তাদের ভালোবেসে নাম দিল ‘রেসিডুয়াল কেস লোড’ অর্থাৎ তলানিতে পড়ে থাকা শরণার্থী। এ তলানিতে পড়ে থাকা শরণার্থীদের নিয়ে জমে উঠল আরেক নাটক। ক্যাম্পবাসী রোহিঙ্গা যাদের মিয়ানমার ফেরত নিল না কিংবা যাদের ফেরত পাঠানো হলো না, তাদের ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশে প্রত্যাবাসন করা হবে— ইউএনএইচসিআরের অফিশিয়ালি গল্প রটিয়ে দিল। এ গল্পটি তারা ২০ বছর ধরে দুনিয়াকে খাওয়াচ্ছে। গল্পটি এখনো চালু আছে তার প্রমাণ গত সপ্তাহে বাংলাদেশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যিনি রোহিঙ্গা শরণার্থী কমিশনার তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের কোনো উন্নত তৃতীয় দেশে প্রত্যাবাসনের সুযোগ করে দিতে হবে। শরণার্থী কমিশনারের কাছে আমার প্রশ্ন, ২০ বছর ধরে কতজন রোহিঙ্গাকে আপনারা উন্নত দেশে পাঠাতে পেরেছেন? এ পরিসংখ্যান আপনার জানা না থাকলে আপনার সদয় অবগতির জন্য আমি পেশ করছি, আপনি দয়া করে খতিয়ে দেখুন। ২০০৬ সালে কুতুপালং ও নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার। এর মধ্য থেকে সাকল্যে ১৭১ পরিবারের ৭৪৯ সদস্যকে ইউএনএইচসিআর তৃতীয় দেশে প্রত্যাবাসিত করেছে। তাদের মধ্যে কানাডায় প্রত্যাবাসিত হয়েছেন এমন রোহিঙ্গার সংখ্যা ২৭৮, যুক্তরাজ্যে ১৬৬, অস্ট্রেলিয়ায় ১২৬ , আয়ারল্যান্ডে ৮২, নিউজিল্যান্ডে ৫০, সুইডেনে ১৯ ও নরওয়েতে ৪ জন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তৃতীয় কোনো দেশে প্রত্যাবাসন নিয়ে এত বিশাল গর্জনের পর একি স্বল্প বর্ষণ? এ যে পর্বতের মূষিক প্রসব। জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের সঙ্গে উন্নত বিশ্বের এ কেমন তামাশা! আমেরিকা, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে যেখানে লাখ লাখ হেক্টর জমি অনাবাদি পড়ে রয়েছে; সেসব দেশ পরান খুলে মাত্র হাজার জন শরণার্থীকে জায়গা দিতে পারল না? সবচেয়ে বড় কথা, ইউএনএইচসিআর মাত্র ৭৪৯ জন শরণার্থীকে উন্নত বিশ্বে প্রত্যাবাসিত হওয়ার সুযোগ দিয়ে শরণার্থী শিবিরবাসী ২৮ হাজার শরণার্থীকে শিবির ছেড়ে তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসিত হওয়ার তাগিদ নস্যাৎ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, শরণার্থী হলে আমেরিকা-কানাডার মতো উন্নত দেশে প্রত্যাবাসিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে— এমন তথ্য রাখাইন রাজ্যের লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে এসে শরণার্থী মর্যাদালাভের জন্য প্রলুব্ধ করেছে। বাংলাদেশ সরকারের উঁচু পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢ়তা ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঘিরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক রকমের কায়েমি স্বার্থ জন্ম নিয়েছে। সমস্যাটি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এটি নিয়ে ভাবতে গেলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা প্রাগৈতিহাসিক গল্পের ভিক্ষুক চরিত্রগুলোর কথা মনে পড়ে। প্রাগৈতিহাসিক গল্পের নায়ক ডাকাত ভিখু এক হাত হারিয়ে রাস্তার পাশে ভিক্ষুকের পেশা বেছে নিয়েছিল। রাস্তার মোড়ে ওর পাশে বসে একজন ভিক্ষা করত যার পায়ে দগদগে ঘা। পায়ে ঘাওয়ালা ভিক্ষুক তার ঘায়ের খুব যত্ন করত যাতে ওটি শুকিয়ে না যায়। বেচারা জানত, পায়ের ঘা শুকিয়ে গেলে তার ভিক্ষা পাওয়ার উৎস শুকিয়ে যাবে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গাবিষয়ক কর্মসূচির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু সরকারি-বেসরকারি মানুষ এবং বাংলাদেশে নিয়োজিত জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) জন্য রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা প্রাগৈতিহাসিক গল্পের ভিক্ষুকের পায়ের দগদগে ঘা। ওটি শুকিয়ে গেলে তাদের বাণিজ্যের উপায় হবে কি? শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন তিন দশক ধরে রোহিঙ্গা নামের পায়ের ঘা দেখিয়ে দুনিয়ার সব দেশের কাছ থেকে ভিক্ষা করে চলেছে।

তহবিল সংগ্রহ ভদ্র নাম দিয়ে ভিক্ষা করে পাওয়া টাকার বিশাল অংশ চলে যায় ইউএনএইচসিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে। বেতন-ভাতাই শেষ কথা নয়, তাদের ছুটিছাঁটা, আরাম-আয়েশ খাতেও কম টাকা ব্যয় হয় না। এরপর টাকার বস্তা গিয়ে পড়ে বাংলাদেশের কিছু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর হাতে। তারা সরকারের তরফ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত। তাদের খাত-উপখাতের সব ব্যয় মিটিয়ে সামান্য যা বাঁচে তা রোহিঙ্গারা পায়। রোহিঙ্গারা এ দেশে আছে বলেই তিন দশক ধরে ইউএনএইচসিআর ও বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি কিছু লোকের বাণিজ্যে অবিরাম তেজিভাব বজায় আছে। রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাদের কারবার তাদের বাণিজ্য ভালোই চলছে। এরাই রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ থেকে বেরিয়ে আসার পটভূমি তৈরি করছে। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, ভিটেমাটি ছেড়ে বাংলাদেশে ঠাঁই নিয়ে রোহিঙ্গারা নিজেরাও মরছে, আমাদেরও মারছে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর