শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

গমের ব্লাস্ট মোকাবিলা : সমন্বিত উদ্যোগের কতদূর

শাইখ সিরাজ

গমের ব্লাস্ট মোকাবিলা : সমন্বিত উদ্যোগের কতদূর

গত আগস্টে কালের কণ্ঠে লিখেছিলাম। শিরোনাম ছিল ‘গমের ব্লাস্ট, কতখানি গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছি আমরা?’ তখন গমের মৌসুম শেষ হয়েছে। দেশে প্রথমবারের মতো মহামারী আকার ধারণ করা ব্লাস্ট রোগ এবং এতে ক্ষতির হিসাবটি আমাদের কাছে এসে গেছে। রীতিমতো ১৫ হাজার হেক্টর জমির গম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতির হিসাবটি খুব বড় করে সামনে আনা হয়নি দেশবাসীর আতঙ্ক এড়াতে। সেই সঙ্গে খাদ্য উৎপাদনে আমাদের বহুমুখী সাফল্য থাকায় এই ক্ষতি বড় ধরনের দুর্যোগ বা সংকট ডেকে আনেনি। তবে গমে ব্লাস্টের আক্রমণের বিষয়টি কোনোভাবেই খাটো করে দেখার যে সুযোগ নেই, তা আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সব প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা বার বার বলেছেন। বলেছেন বাংলাদেশে ভবিষ্যতে গম আবাদ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কার কথাও। এ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে চলছিল নানামুখী তৎপরতা। ২৬ জুলাই এক আন্তর্জাতিক কর্মশালাও হয়েছে। গম ও ভুট্টা গবেষণার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সিমিট বাংলাদেশ ওই কর্মশালার আয়োজক হলেও অনুষ্ঠানের স্থান নির্ধারণ করা হয় নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে। সে সময় সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে জানতে পারি, আন্তর্জাতিক সংস্থা সিমিট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক ও দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এ প্রসঙ্গে এক হয়ে কাজ করছে; যার ফলাফল এই মৌসুমে এসে দেখার কথা। যা হোক, নভেম্বরের মাঝামাঝি ছিল গম রোপণের সময়। এবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষককে গম আবাদে নিরুৎসাহিত করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। খবরে আসছে, দক্ষিণের নয় জেলায় কৃষক ব্লাস্ট আতঙ্কে এবার গম আবাদ করছে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের তাগিদ দিচ্ছে বিকল্প ফসল আবাদের। এর বাইরেও অনেক কৃষক যে একেবারে গম আবাদ করছে না তা নয়। অনেকেই করছে। কিন্তু ব্লাস্ট রোগ এবার আক্রমণ করবে কিনা, তা বোঝার সময় এখনো আসেনি। বোঝা যাবে আগামী ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ।

গম গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাবে দেশে গম উৎপাদন হয় ১৩ থেকে ১৪ লাখ ম্যাট্রিক টন। আর আমদানি হয় কমপক্ষে ৪০ লাখ ম্যাট্রিক টন। সব মিলিয়ে দেশে বছরে গমের চাহিদা ৫৪ লাখ ম্যাট্রিক টনের মতো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর দেশের সাত জেলায় ব্লাস্ট সংক্রমিত হওয়ার কারণে ২৭ থেকে ৩০ হাজার ম্যাট্রিক টনের মতো উৎপাদন ব্যাহত হলেও সামগ্রিক উৎপাদনে তেমন প্রভাব পড়েনি। কারণ, প্রতি বছরই আবাদি এলাকা বাড়ছে। অন্যদিকে, এর উল্টো প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের বৈরী প্রভাবে গমের ফলনেও অনেক হেরফের হচ্ছে। যেমন এক বছর আগে সারা দেশে গমের ফলন ছিল হেক্টরপ্রতি ৩ দশমিক ৯ টনের মতো, গতবার ফলনের এ হার নেমে আসে ২ দশমিক ৭৮ টনে। গত মৌসুমে শিলাবৃষ্টির প্রভাব এর পেছনে ছিল অন্যতম দায়ী। (তথ্য : গম গবেষণা ইনস্টিটিউট)।

গমের ব্লাস্ট ইস্যুতে দুটি বিষয় আমাদের সামনে আসে। একটি হচ্ছে ব্লাস্টের জীবাণু বা রোগ সংক্রমণের কারণ ও তার প্রতিকার। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে এখনো উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে কারণটি এখনো অজ্ঞাত। এ বছরও এর সংক্রমণ ঘটতে পারে বলে যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। নতুন নতুন এলাকায় এই ব্লাস্ট ছড়িয়ে পড়বে কিনা, সে সম্পর্কেও স্পষ্ট কিছু বলা যাচ্ছে না। এ কারণে অন্তত যেসব জেলার কৃষক গমের ব্লাস্টের কারণে ক্ষতির শিকার হন, তাদের এবার গম আবাদ থেকে নিবৃত করা হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, কৃষককে আমরা নিষেধ করছি না। তবে নিরুৎসাহিত করছি। এ ক্ষেত্রে পাঁচটি শর্তারোপ করা হয়েছে। শর্তগুলো হচ্ছে, নির্দিষ্ট সময়ে অর্থাৎ ১৫ থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বীজ বোনা, বীজ প্রত্যায়িত কিনা তা সঠিকভাবে পরীক্ষা করা, বীজ শোধন করা, আবাদি জমি আগাছামুক্ত রাখা এবং গমের শীষ বেরোনোর মুহূর্তে ও ১৫ দিন পরে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ। উৎপাদনের প্রশ্নে তিনি বলেন, গতবার ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে গমের উৎপাদন ৩০ শতাংশ কম হয়। সেসব জায়গায় এবার আবাদ কমিয়ে উত্তরাঞ্চলের দিকে আবাদ সম্প্রসারণের চিন্তাভাবনা চলছে। কিন্তু এতেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেল না বরং সমস্যাটি রয়েই গেছে। গমের ব্লাস্টের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত রয়েছে ব্রাজিলে। ব্রাজিলে ১৯৮৫ সালের পর নব্বই দশকে অল্পবিস্তর দেখা দেয়। পরে দেখা দেয় ২০০৪ সালের দিকে। রীতিমতো মহামারী আকারে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে বাস্তবতা হচ্ছে, মাঠে ব্লাস্টের জীবাণু গতবার যেহেতু সংক্রমিত হয়েছে, এবারও জীবাণুর অস্তিত্ব রয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরাই বলছেন, রোগ সংক্রমণের মতো উপযুক্ত জলবায়ু ও ফসলি অবস্থান মিলে গেলে এবার হয়তো আরও বড় পরিসরে সংক্রমিত হবে। এ ক্ষেত্রে এ দেশে ব্লাস্ট রোগ সংক্রমণের কারণটি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে উদ্ঘাটনের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।

দিনাজপুর গম গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. নরেশচন্দ্র জানিয়েছেন, এবার দেশের ২৩টি জেলা থেকে গমের বীজ সংগ্রহ করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বীজ পরীক্ষাগার ও গম গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে ব্লাস্টের জীবাণু পাওয়া যায়নি। কিন্তু ব্লাস্টের জীবাণু সংক্রমিত এলাকাগুলোয় আছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কৃষক যদি সঠিক সময়ে বীজ বোনে, তাহলে আক্রান্তের আশঙ্কা কম। গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তিনি জানান, বারি গম ২৮ ও ৩০ জাতে ব্লাস্ট সংক্রমণের হার ও প্রবণতা কম। অন্য জাতগুলোর ক্ষেত্রে ব্লাস্ট সংক্রমিত হয়েছে। গম গবেষণা ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, ব্লাস্ট প্রতিরোধের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ে একটি ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ জমা দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে অঞ্চলভিত্তিক প্রশিক্ষণেরও আয়োজন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক গম গবেষণা ইনস্টিটিউট সিমিটের সঙ্গে একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে।

সব ক্ষেত্রে একই প্রশ্ন এসে যায়। গমে ব্লাস্টের কারণ উদ্ঘাটনের অগ্রগতি কোথাও নেই। একটি মৌসুম পেরিয়ে আরেক মৌসুম এসে গেল। স্বাভাবিকভাবেই দেশের মানুষের নিয়মিত চাহিদা পূরণের জন্য বাইরে থেকে গম আমদানির কার্যক্রমও শুরু হবে। সেখানে কতখানি সতর্কতা নিশ্চিত করা হচ্ছে সে ব্যাপারটিও অজানা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রফেসর ড. তোফাজ্জল ইসলামের মাঠপর্যায়ের একটি গবেষণা প্রতিবেদন মাস দুই আগে একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। মাঠপর্যায়ের নমুনা সংগ্রহ, জিনোম পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে প্রস্তুতকৃত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সংক্রমিত ব্লাস্টের জীবাণুর উৎস লাতিন আমেরিকা। এতে স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়, গতবার ব্রাজিল থেকে আমদানিকৃত পচা ও নিম্নমাণের গম ফেলে দেওয়ার পর তা কিছু ঘাসের মাধ্যমে গমে সংক্রমিত  হতে পারে বলে মনে করা সমীচীন।

সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, এ বিষয়ে সবচেয়ে দ্রুত যে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন তা হচ্ছে সবাইকে এক প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে জিনোম এডিটিংয়ের মাধ্যমে দ্রুত গমের নতুন একটি জাত উদ্ভাবন করা। ইতিমধ্যে পৃথিবীতে প্রথম একটি উদ্যোগ হিসেবে মলিকুলার ডায়াগনস্টিক মেথডে ব্লাস্টের জীবাণু আছে কিনা, তা সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে পরীক্ষা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এটি বায়োটেকনোলজি বিকাশের দিক থেকে অনেক বড় একটি সফলতা। কিন্তু কাজগুলো হচ্ছে বিচ্ছিন্নভাবে। নেপালে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পর বাংলাদেশে এ নিয়ে যে সমন্বিত তোড়জোড় শুরু হয়, তা থেমেই গেছে বলা যায়। সমন্বিত সিদ্ধান্ত ছিল, একটি তহবিল সংগ্রহ করে অথবা নিজেদের সামর্থ্যে একটি তহবিল গঠন করে ব্লাস্ট মোকাবিলার জন্য সবরকম উদ্যোগ নেওয়া হবে। কিন্তু কার্যত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে একটি লিফলেট প্রচার এবং কৃষকদের নিরুৎসাহিত করার জরুরি কাজটি ছাড়া গবেষণা ও উন্নয়ন পর্যায়ে কিছুই হয়নি।

এদিকে এ দেশের গমের ব্লাস্ট ইস্যুতে বেশ উদ্বিগ্ন ভারত। সে দেশের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে তাদের সীমান্ত এলাকায় গম আবাদ না করার জন্য। ব্লাস্ট সংক্রমণের ইতিহাস থেকেই দেখা যায়, ব্রাজিলে ১৯৮৫ সালে এটি প্রথম দেখা যায়। পরে পর্যায়ক্রমে ব্রাজিল ছাড়াও বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে ও আর্জেন্টিনায় ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের বিজ্ঞানীরা যথেষ্টই আশাবাদী, জলবায়ু অনুকূলে থাকলে এটি হয়তো এবার সংক্রমিত হবে না। কিছু সতর্কতা অবলম্বন, আক্রান্ত জেলাগুলোয় গম আবাদ থেকে বিরত থাকা, ব্লাস্ট প্রতিরোধী নতুন জাত উদ্ভাবনসহ আরও কিছু বিজ্ঞানসম্মত পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে হয়তো এড়ানো যাবে ব্লাস্ট। কিন্তু এর সবকিছুর জন্যই প্রয়োজন সমন্বিত প্রয়াস। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে আরও তৎপরতা আশা করি আমরা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। [email protected]

সর্বশেষ খবর