শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

দুর্গ আবি-তালিবে মহানবী (সা.)-এর ভাষণ

মাওলানা আবদুর রশিদ

রবিউল আউয়াল রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। এ মাসেই তিনি জন্মলাভ করেন। পৃথিবী থেকে বিদায়ও নেন। এ মাসে আমরা দুর্গ আবি-তালিবে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ পত্রস্থ করছি। মহান আল্লাহর তসবিহ ও পবিত্রতা ঘোষণা করার পর—

হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবের আনুগত্য কর এবং পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিরত থাকো। তা না হলে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে এবং তোমাদের ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাবে। তোমরা কি এ সত্য অবগত নও যে, আল্লাহর জমিন যখন চারদিক থেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল, বোত-পরস্তি যখন আল্লাহ-পরস্তির স্থান দখল করে নিয়েছিল, তখন মানবীয় নৈতিকতা মুছে গিয়েছিল, সর্বত্র ফিতনা-ফাসাদের তুফান প্রবাহিত ছিল। তোমরা সেই যুগ প্রত্যক্ষ করেছ। এখানের বাসিন্দারা শত শত বছর হিংস্র প্রাণীর মতো পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এ হানাহানি-খুনোখুনির জন্য দুনিয়ার কোথাও আরববাসীর সম্মান ছিল না। প্রত্যেক কওম তাদের নিকৃষ্ট ও লাঞ্ছিত মনে করত। যুদ্ধ-বিগ্রহ, শত্রুতা-দুশমনি ও ঘৃণা-বিদ্বেষ ছিল তাদের পরিচয়ের বৈশিষ্ট্য। নিজেদের এ দুর্ভাগ্য সম্পর্কে তারা অজ্ঞ ছিল।

অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অবস্থার ওপর রহম করেছেন। তোমাদের অন্তরে মহব্বত সৃষ্টি করেছেন এবং তার ফজলে তোমরা ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ হয়েছ। অতএব, তোমরা এই মেহেরবানির প্রতি অকৃতজ্ঞ হইও না। পরস্পর মিলেমিশে থাকো এবং আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা লক্ষ্য হাসিল করতে সক্ষম হও। হে মানুষ! নিঃসন্দেহে সব মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই এবং সব মুসলমান এক ব্যক্তিসদৃশ। তার শিরঃপীড়া উপস্থিত হলে সারাটা শরীর বেদনায় জর্জরিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এক মুসলমান অন্য মুসলমানের জন্য এক বুনিয়াদস্বরূপ, যার এক অংশ অন্য অংশের বোঝা বহনে সাহায্যকারী। আমি তোমাদের নসিহত করছি, প্রত্যেক মুসলমান পরস্পর ভাই, তাই কেউ যেন কাউকে জুলুম না করে এবং কাউকে যেন একাকী বন্ধুহীন বা সাহায্যহীন ছেড়ে না দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন। যে ব্যক্তি মুসলমানের কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার কষ্ট দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি অন্যের ত্রুটি গোপন করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার ত্রুটিও গোপন রাখবেন।

হে মানুষ! যথাসম্ভব ঐক্যবদ্ধভাবে জীবনযাপন কর। পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিরত থাকো। তোমাদের রব তোমাদের নিঃস্বার্থ কর্জের হুকুম দিচ্ছেন এবং ফিতনা-ফাসাদ ও খুনোখুনি নিষিদ্ধ করেছেন। যার হাতে আমার জীবন তার শপথ, তোমরা মুসলমান না হওয়া পর্যন্ত বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর নিজের জন্য তোমরা যা পছন্দ কর অন্য ভাইয়ের জন্যও তাই পছন্দ না করা পর্যন্ত তোমরা মুসলমান হতে পারবে না।

এবং হে মুসলমান! অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের ওপর করুণা করেছেন, তিনি তোমাদের অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং তোমাদের হিংসা-বিদ্বেষের অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছেন। এই নিয়ামতের সম্মান করা তোমাদের কর্তব্য এবং পরস্পরের সুখে-দুঃখে অংশগ্রহণ কর। আমি ইতিপূর্বে বলেছি যে, এক মুসলমান অন্য মুসলমানের জন্য বুনিয়াদস্বরূপ। তার অর্থ হলো এক মুসলমান অন্য মুসলমানের জন্য দেয়ালের ইটের মতো একে অন্যকে আঁকড়ে থাকে। যেরূপ দেয়ালের এক ইট অন্য ইটকে সংযুক্ত রাখে সেরূপ পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য আমি তোমাদের হেদায়েত করছি। তোমরা যে অবস্থায়ই থাকো না কেন একে অন্যের সাহায্য করবে। আমি তোমাদের হুঁশিয়ার করছি যে, তোমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকো, একে অন্যকে সাহায্য কর অর্থাৎ আশ্রয় দান কর তাহলে তোমরা প্রাচীরের মতো মজবুত থাকবে। অন্যথায় তোমরা স্তূপীকৃত ইটের মতো হবে, কোনো দৃঢ়তা থাকবে না এবং যে কেউ তা উড়িয়ে দিতে পারবে।

আর তোমাদের মধ্যে যার সামর্থ্য রয়েছে, সে যেন অবশ্যই তার ভাইয়ের উপকার করে এবং আমি পুনরায় তোমাদের এ কথা বলছি যে, কোনো লোক ততক্ষণ পর্যন্ত ইমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে তার ভাইয়ের জন্যও তাই পছন্দ করে। আমি এ উদ্দেশে বলছি যে, প্রত্যেক মুসলমান লাভ-লোকসানের কাজে যেন অন্য মুসলমানকে তার নিজের মতো মনে করে এবং সে যা নিজের জন্য অপছন্দ করে তা যেন তার ভাইয়ের জন্যও অপছন্দ করে। যতদূর সম্ভব এক মুসলমান অন্য মুসলমান ভাইকে যেন নিজের সত্তার মতো প্রিয় মনে করে, নিজের সত্তাকে যেরূপ প্রিয় মনে করে সেরূপ যেন তার ভাইকেও প্রিয় মনে করে এবং নিজের সত্তার প্রতি যে আচরণ করে সেরূপ আচরণ যেন তার ভাইয়ের প্রতিও করে। কথাবার্তায় মুনাফিকও নিজেকে মুসলমান বলে। কিন্তু মুসলমান তো সেই ব্যক্তি, যার জিব ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।

হে মানুষ! মুসলমানের প্রত্যেক জিনিস অন্য মুসলমানের জন্য হারাম। পরস্পরের রক্ত, ইজ্জত-আবরু, সম্পদ— এর কোনোটারই ক্ষতিসাধন তোমরা করো না। মানুষের চারিত্রিক গুণাবলির মধ্যে এমন দুটি গুণ রয়েছে যার চেয়ে উত্তম আর কিছু নেই। এর প্রথমটি হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ইমান আর দ্বিতীয়টি মুসলমানের উপকারসাধন।

দোষাবলির মধ্যেও এমন দুটি দোষ রয়েছে যার চেয়ে নিকৃষ্টতর আর নেই। প্রথমটি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা, দ্বিতীয়টি কোনো মুসলমানের ক্ষতিসাধন। কোনো অবস্থাতেই মুসলমানের ওপর জুলুম করা অন্য মুসলমানের জন্য বৈধ নয়।  বিপদকালে মুসলমান ভাইকে সাধ্যমতো সাহায্য করা অবশ্যকর্তব্য।

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।

সর্বশেষ খবর