শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

ব্যবসা সম্পর্কে ইসলামী নির্দেশনা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

ব্যবসা সম্পর্কে ইসলামী নির্দেশনা

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ওহে ওইসব লোক যারা ইমান এনেছ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কর না। তবে পরস্পরের রাজি-খুশির মাধ্যমে ব্যবসা করাতে দোষ নেই। তোমরা নিজেদের হত্যা কর না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি করুণাময়। (সূরা নিসা, ৪ : ২৯)। ব্যবসা একটি মহান পেশা। রিজিকের খোঁজে ব্যবসা করা বড় ইবাদতও বটে। অনেক নবীই ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) এবং চার খলিফাসহ অসংখ্য সাহাবি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ইমাম আজম আবু হানিফা (র.) তার সময়ে শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী ছিলেন। দিনে ব্যবসা রাতে ইলমি ইলহাম জ্ঞানচর্চা; এই ছিল তার রুটিন। জ্ঞানচর্চার কারণে রাতে তিনি ঘুমাতে পারতেন না। তাই জোহর থেকে আসর পর্যন্ত সময়টুকু ঘুমের জন্য নির্ধারণ করেছিলেন ইমাম আজম (র.)। এমনিভাবে ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, আল্লাহর মাহবুব বান্দাদের কাছে ব্যবসায় ছিল পছন্দনীয় পেশা। তাই তো প্রিয় নবী (সা.) ঘোষণা করেছেন- ‘জীবিকার দশ ভাগের নয় ভাগই আছে ব্যবসার মধ্যে।’ (এহইয়াউল উলুমুদ্দিন)। ব্যবসার কারণেই পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ইসলামের আলো জ্বলেছে। সাহাবিরা ব্যবসা ও দাওয়াত— এই দুই নিয়তেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। আর ইসলামের মহান আদর্শ পৌঁছে দিয়েছিলেন মানুষের ঘরে ঘরে। কালের আবর্তনে ইমানদারদের পছন্দনীয় পেশা ব্যবসা কলুষিত হয়েছে দুনিয়ালোভীদের হাতে। কখনো বেশি দামের লোভে, আবার কখনো দোষণীয় পণ্য গছিয়ে দেওয়া প্রবণতায় ব্যবসায়ীরা আখেরাত বিকিয়ে দিচ্ছে খুব সহজেই। এমনই কিছু বিষয় উল্লেখ করছি যা ব্যবসায়ীদের আখেরাত নষ্টের কারণ।

বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা : বেশি মুনাফার লোভে দ্রব্যসামগ্রী গুদামজাত করা স্পষ্ট হারাম। মানুষকে কষ্ট দিয়ে খাদ্যদ্রব্য গুদামজাতের ব্যাপারে রসুল (সা.) কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। হজরত মা’মার (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘জনগণের জীবিকা সংকীর্ণ করে যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করবে সে বড় অপরাধী। আর জেনে রাখ! সে গুনাহগার সাব্যস্ত হবে। (মুসলিম ও তিরমিজি।) হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসুল (সা.)কে বলতে শুনেছি, ‘গুদামজাতকারী কতই না ঘৃণিত মানুষ। আল্লাহতায়ালা দ্রব্যমূল্য কমিয়ে দিলে সে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আর বাড়িয়ে দিলে সে আনন্দিত হয়। (শুআবুল ইমান) হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিন খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে রাখবে, (এর মাধ্যমে মানুষকে কষ্ট দিবে), সে এ সম্পদ দান করে দিলেও তার গুনাহ মাফের জন্য যথেষ্ট হবে না। (মেশকাত) খাদ্যদ্রব্য গুদামজাতকারী সম্পর্কে রসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমদানি করবে সে রিজিকপ্রাপ্ত হবে। আর যে গুদামজাত করবে সে অভিশপ্ত হবে। (ইবনে মাজাহ সুনান দারেমি)

খাদ্যে ভেজাল দেওয়া : খাদ্যে ভেজাল দিয়ে মানুষ ঠকানো বড় ধরনের গুনাহ। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশিয়ে ফেল না। আর জেনে বুঝে সত্য গোপন কর না। তোমরা খুব ভালো করেই জান সত্য কী।’ (সূরা বাকারা : ৪২।) যারা এমন কাজ করে রসুল (সা.) তাদের নিজ উম্মতের অন্তর্ভুক্ত করেননি। সহি মুসলিমে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন— ‘যে প্রতারণা করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ মুসলিমের অন্য বর্ণনায় রয়েছে, একবার রসুল (সা.) বাজারে গিয়ে একটি বস্তায় হাত ঢুকালেন। তিনি দেখলেন উপরের খাদ্যগুলো শুকনো কিন্তু ভিতরের খাবারগুলো ভেজা। রসুল (সা.) বললেন, ওহে সওদাগর! তুমি ভেজা খাবারগুলো উপরে রাখলে না কেন? যাতে কেউ প্রতারিত না হয়। ব্যবসায়ী বলল, হুজুর! বৃষ্টির পানিতে পণ্যগুলো ভিজে গেছে, তাই নিচে রেখেছি। রসুল (সা.) বললেন, জেনে রাখ! যে প্রতারণা করে সে আমার উম্মত নয়। (মুসলিম।)

ওজনে কম দেওয়া : ওজনে কিংবা মাপে কম দেওয়ার প্রবণতা ব্যবসায়ীদের আখেরাত নষ্ট করে দেয়। অতীতে অনেক সম্প্রদায়কে এ অপকর্মের জন্য ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের মধ্যেও এ ব্যাধিটি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। যারা মাপে কম দেওয়ার মতো মহাঅন্যায়ের সঙ্গে জাড়িত তাদের ধ্বংসের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আল্লাহতায়ালা বলেন— ‘যারা ওজনে কিংবা মাপে কম দেয় তাদের জন্য ধ্বংস। তারা মানুষের কাছ থেকে পুরোপুরি মেপে নেয়। কিন্তু যখন মানুষকে মেপে দেয় তখন প্রাপ্যের চেয়েও কম দেয়।’ (সূরা মুতাফফিফিন : ১-৩।) ওজনে কম দেওয়া মানে বান্দার হক নষ্ট করা। ওই বান্দা যদি ক্ষমা না করেন তবে আল্লাহতায়ালাও ক্ষমা করবেন না। তাই এ বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখবেন, ওজনে কম দিয়ে আপনি যে সম্পদ গড়ছেন তা না কবরে নিয়ে যেতে পারবেন, না পরকালের কঠিন সময়ে সম্পদ কোনো উপকারে আসবে না। বরং এর জন্য জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে।

বেশি বেশি কসম করা : পণ্য বিক্রির জন্য ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে নিন্দনীয় কাজ হলো বেশি পণ্য নিয়ে বেশি কসম করা। এ সম্পর্কে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন তিন শ্রেণির মানুষের প্রতি আল্লাহ তাকাবেন না। তাদের পবিত্রও করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। মিথ্যা কসম করে পণ্য বিক্রিকারী ব্যবসায়ী এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। (মুসলিম) আবু সায়ীদ (রা.) বলেন, এক বেদুইন একটি ছাগী নিয়ে যাচ্ছে। আমি তাকে বললাম, এটি তিন দিরহামে আমার কাছে বিক্রি কর। সে বলল, আল্লাহর কসম! এত কম দামে আমি এটি বিক্রি করব না। পরে সে আমাকে তিন দিরহামেই ছাগীটি দিয়ে দিল। আমি এ ঘটনা রসুল (সা.)কে বললে তিনি (সা.) বললেন, ‘সে দুনিয়ার বিনিময়ে তার আখেরাত বিক্রি করে ফেলেছে।’ (ইবনে মাজাহ)

হে আমার মুসলিম ব্যবসায়ী ভাইয়েরা, লেখাটি পড়ে দয়া করে একবার ভেবে দেখুন, এসব পাপ থেকে আপনি কতটুকু মুক্ত?  আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর