শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

গার্মেন্টে এই অস্থিরতা কেন

হঠাৎ করেই অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে তৈরি পোশাক কারখানায়। ঢাকার আশুলিয়ায় শ্রমিক অসন্তোষ ঘিরে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে কারখানা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সতর্ক অবস্থান নিলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। কর্মবিরতিতে ইন্ধনের অভিযোগে ১২১ শ্রমিককে সাময়িক বরখাস্ত ও থানায় মামলা হয়েছে। আটক করা হয়েছে বেশ কয়েকজনকে। সরকার চেষ্টা করছে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার অথবা যে কোনোভাবে সংকটের সমাধান করতে। কী কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হলো সে প্রশ্ন থেকেই যায়। গার্মেন্ট শিল্পের সংকট নিয়ে আমরা কথা বলেছি মালিক ও শ্রমিক দুই পক্ষের সঙ্গে। তারা বলেছেন মূল সমস্যার কথা। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন সংকট অব্যাহত থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই শিল্প। সমাধান নিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ও শ্রমিক নেতা বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি ডা. ওয়াজেদ উল ইসলাম খানের সঙ্গে কথা বলেছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক রুহুল আমিন রাসেল ও আলী রিয়াজ। তাদের সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো—

 

অস্থিরতার পেছনে ষড়যন্ত্র আছে

সিদ্দিকুর রহমান

বাংলাদেশ প্রতিদিন : হঠাৎ করে পোশাকশিল্পে অস্থিরতা কেন?

সিদ্দিকুর রহমান : দেশে তৈরি পোশাকশিল্প কারখানাগুলোয় এ অস্থিরতার কোনো কারণ ছিল না। একটি কারখানায় সমস্যা ছিল। সেই কারখানার অস্থিরতা আস্তে আস্তে বেড়ে অন্য কারখানায় ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও এর কোনো কারণ নেই। যদি কারণ থাকত, তাহলে শ্রমিকরা বা তাদের প্রতিনিধি শ্রম মন্ত্রণালয়, শ্রম অধিদফতর ও বিজিএমইএর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি। বরং অবৈধভাবে ধর্মঘট করেছে, যা পুরোপুরি শ্রম আইন পরিপন্থী। আমরা মালিকরা যেমন সব আইনকানুন ও নিয়মনীতি মেনে ব্যবসা করছি, তেমনি শ্রমিক ভাইবোন ও তাদের নেতাদেরও উচিত হবে আইন মেনে তাদের দাবি আদায়ের পথে এগোনো।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : এ অস্থিরতার পেছনে দেশি-বিদেশি কোনো ষড়যন্ত্র আছে?

সিদ্দিকুর রহমান : দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের প্রাণ তৈরি পোশাকশিল্পের চলমান এ অস্থিরতার পেছনে দেশি-বিদেশি অশুভ শক্তির গভীর ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত আছে। আর চক্রান্ত না থাকলে এ অস্থিরতা হতো না। আমি পরিষ্কার বলছি, এ অস্থিরতার মূলে রয়েছে গভীর চক্রান্ত। অস্থিরতা হলে স্বার্থান্বেষী মহল লাভবান হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে কোনো অশুভ চক্রান্তে যেন এ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিকের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। অর্থনীতিতে অচল অবস্থা দেখা দেবে। তাই দেশপ্রেমিক শ্রমিক ভাইবোনদের প্রতি আমাদের অনুরোধ, কোনো ষড়যন্ত্রে পা দেবেন না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : অস্থিরতার প্রভাব বিদেশি বাজারে পড়বে?

সিদ্দিকুর রহমান : হ্যাঁ, প্রভাব তো কিছুটা পড়বেই। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে আমাদের ভাবমূর্তিতে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পোশাকশিল্পের ভাবমূর্তির ব্যাপক ক্ষতি হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রতিবেশী ভারতের সংসদে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তারা পোশাক পণ্য রপ্তানিতে আগামীতে দ্বিতীয় অবস্থানে যেতে চায়। বর্তমানে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে। ভারত দ্বিতীয় অবস্থানে যেতে তাদের ব্যবসায়ীদের জন্য বিপুল পরিমাণে প্রণোদনা ও ভর্তুকি দিচ্ছে। বিষয়টি আমাদের সরকারকে মনে রাখতে হবে। আমাদের সরকারেরও উচিত পোশাক খাতের উন্নয়নে বিপুল পরিমাণে প্রণোদনা দেওয়া।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : শ্রমিক ছাঁটাইয়ে কি সমাধান আসবে?

সিদ্দিকুর রহমান : শ্রমিক ছাঁটাই কেউ এমনিতেই করে না। এটা কোনো সমাধানও নয়। আমরা চাই, শ্রমিকরা তাদের অবস্থানে থাকবেন। কারণ, একজন শ্রমিক যখন কোনো কারখানায় দীর্ঘদিন কাজ করেন, তখন তিনি হয়ে ওঠেন অনেক প্রশিক্ষিত। সেই প্রশিক্ষিত শ্রমিককে কোনো মালিক ছাঁটাই করতে চান না। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মালিকদের শেষ রক্ষাকবচ হিসেবে ছাঁটাই ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। তবে সাধারণত কোনো পোশাক শ্রমিক ছোটখাটো অন্যায় করলে ছাঁটাই হয় না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : মালিকরা যথাযথ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছেন?

সিদ্দিকুর রহমান : আমি মনে করি পোশাকশিল্প কারখানার মালিকরা যথাযথ ভূমিকা পালন করেছেন। তবে টুকটাক সমস্যা থাকতে পারে। তা সমাধানে বিজিএমইএ ও সরকার আছে। একটি কথা সত্য— আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দুনিয়ার সব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। আমাদের মালিকরা এসব বিষয়ে অনেক সচেতন। কোনো মালিক কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে তা নদীতে ফেলতে যেমন চান না তেমনি কোনো সমস্যাও বেশি দিন তারা জিইয়ে রাখতে চান না। মালিকদের এ আন্তরিকতাকে কেউ দুর্বলতা মনে না করাই ভালো।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : পোশাকশিল্পের চলমান সংকট সমাধানে আপনার সুপারিশ কী?

সিদ্দিকুর রহমান : আমাদের পরিবারের সদস্য প্রিয় শ্রমিক ভাই-বোনদের প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ ও আহ্বান, আপনারা কাজে যোগদান করুন। তারা কাজে যোগদান করতে চাইলে আমরা সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেব। তারা নিজ নিজ কারখানায় কাজে যোগদানের জন্য আবেদন করুক। শ্রমিক ভাই-বোনদের নিজের কর্মস্থলে যোগদানে কোনো সমস্যা হলে তা সমাধানে এবং প্রয়োজনে আমাদের কাছে অভিযোগ করতে পারেন।  প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, শ্রমিকদের সে অভিযোগ আমরা খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।

 

 

 

অস্থিরতা থামাতে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করতে হবে

ডা. ওয়াজেদ উল ইসলাম

বাংলাদেশ প্রতিদিন : হঠাৎ করে পোশাকশিল্পে অস্থিরতা কেন?

ওয়াজেদ উল ইসলাম খান : আমার মনে হয় এর সূত্রপাত বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি নিয়েই। সাভার এলাকায় তিন-চার জন মিলে একটি কামরায় বাস করেন। যে বেতন পান তাতে তাদের মোট খরচ চলে যায়। কিন্তু বছর শেষ হলে জানুয়ারি থেকেই এসব কক্ষপ্রতি ভাড়া ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা বাড়ানো হয়, এমন সংবাদ পাওয়া যায়। তাই, বেতন বৃদ্ধির দাবি করেছেন তারা। আমার মনে হয় এটাকে নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : এই অস্থিরতার পেছনে দেশি-বিদেশি কোনো ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত আছে কি?

ওয়াজেদ উল ইসলাম খান : ষড়যন্ত্র বা চক্রান্ত অনেক ক্ষেত্রে হয়। বাংলাদেশ থেকে অন্য কোনো দেশে এই শিল্প শিফট করা বা অন্য কারণেও ঘটতে পারে। রাজনৈতিক ইস্যুও আছে। আমরা দেখেছি বিদেশিদের ষড়যন্ত্রে আমাদের পাটশিল্প ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন দেশের বড় খাত পোশাকশিল্প। সেখানেও কোনো চক্রান্ত তো কাজ করেই। এখানেও তারা সুযোগ নিতে পারে। দাবি বিবেচনায় না নিয়ে ষড়যন্ত্রকে বড় করে দেখলে হবে না। শ্রমিকদের দাবি এখানে মুখ্য।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : অস্থিরতার প্রভাব বিদেশি বাজারে পড়বে কি?

ওয়াজেদ উল ইসলাম খান : দেশের বড় রপ্তানি খাত পোশাকশিল্প। এখানে যে কোনো অস্থিরতা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এখন এমন অস্থিরতা যদি দীর্ঘদিন ধরে চলে, তার প্রভাব বিদেশি বাজারে তো পড়বেই। রাজনৈতিক অস্থিরতায় যেমন দেশের উৎপাদন কমে যায়, বিনিয়োগও কমে যায়। একটি সেক্টরে এ রকম অস্থিরতা থাকলে ক্রেতারা আসবেন কেন? তাদের মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কা কাজ করতে পারে। স্বল্পসময়ে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। সেটা নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না। ক্রেতা বা বিদেশিরাও সেটা জানে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে থাকলে অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : শ্রমিক ছাঁটাইয়ে কোনো সমাধান আসবে কি?

ওয়াজেদ উল ইসলাম খান : শ্রমিকদের দাবি যৌক্তিক কিনা সেটা বিবেচ্য বিষয়। পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের বেতন তিন বছর আগে বাড়ানো হয়েছে। তিন বছরে অনেক কিছুর দাম বেড়েছে। এখন বাড়ি ভাড়া বেড়েছে বলে জানা গেছে। তাই শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির দাবি তুলতেই পারেন। সেজন্য শ্রমিক ছাঁটাই কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। এটা করে সমস্যা জিইয়ে রাখা হবে। কোনো সমাধান আসবে না। যারা নিজেদের কথা বলতে গেছেন তাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। যেখানে অস্থিরতা বন্ধ করতে হবে সেখানে ছাঁটাই তো উল্টো অস্থিরতাকে জিইয়েই রাখবে।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : মালিকরা যথাযথ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছেন কি?

ওয়াজেদ উল ইসলাম খান : মোটেই না। তারা আলোচনা করবেন। তাদের হাতেই সমাধান হবে। উল্টো তারা দ্বৈত ভূমিকা নিয়েছেন। একদিকে মাইকিং করে কাজে যোগদান করতে বলছেন শ্রমিকদের। অন্যদিকে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার ছাঁটাই করছেন। এটা তো হলো না। শ্রমিক নেতা বা শ্রমিকের নামে মামলা করে কী হবে। তাতে কি সমাধান আসবে? আসবে না। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কারখানা খুলে দিতে হবে। কিন্তু মালিকরা শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করছেন না। মনে হয় তারা আলোচনা করতে রাজি নন। এটা হতে পারে না।

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন : চলমান সংকট সমাধানে আপনার সুপারিশ কী?

ওয়াজেদ উল ইসলাম খান : এমন সংকট, অস্থিরতা চলতে পারে না। এর সমাধানে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আলোচনা করতে হবে। শ্রমিকরা তো চাহিদা অনুযায়ী দাবি করেছেন। সেটা নিয়েই আলোচনা। সরকার ওই এলাকায় তিন বছর বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি করা যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। এ ঘোষণা কোনো বাড়ি মালিক মানবেন? আমার তা মনে হয় না।  এ ধরনের কথা না বলে, কাউকে গ্রেফতার না করে আলোচনায় বসা উচিত।

সর্বশেষ খবর