শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বাড়তি পুষ্টিযুক্ত ফসল : প্রয়োজন আরও অগ্রসর গবেষণা

শাইখ সিরাজ

বাড়তি পুষ্টিযুক্ত ফসল : প্রয়োজন আরও অগ্রসর গবেষণা

একসময় পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা ছিল বড় এক চিন্তা ও উদ্বেগের বিষয়। আজকের দিনে চিন্তাটি একটু ঘুরে গেছে। অর্থাৎ খাদ্য নিরাপত্তা যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপদ খাদ্য। বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞের অগ্রগামী চিন্তায় যুক্ত হয়েছে পুষ্টিকর খাদ্যের বিষয়টি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে  পৃথিবীতে প্রায় তিনজনের একজন মানুষ ভুগছে অদৃশ্য পৃষ্টিহীনতায়। অর্থাৎ এমন পুষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা ২০০ কোটির বেশি। বিশেষ করে খাদ্য ও পুষ্টিতে ভিটামিন এ, জিঙ্ক ও আয়রনের ঘাটতি। যাকে বলে অদৃশ্য ক্ষুধা বা ‘হিডেন হাঙ্গার’; যা প্রতিনিয়ত বাড়াচ্ছে রক্তস্বল্পতা, অন্ধত্ব, সংক্রামক রোগ। বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক বিকাশ। এতে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে নারী ও শিশু। বিশ্বব্যাপী পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের বিষয় মাথায় রেখে ফসলের জাত উন্নয়নের কাজ করে চলেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন। এর অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, হার্ভেস্ট প্লাসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভিটামিন এ, জিঙ্ক ও আয়রনসমৃদ্ধ ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছে, যেগুলো মাঠপর্যায়ে কৃষক ব্যবহার করছে। কাসাভা, ভুট্টা ও কমলা রঙের মিষ্টি আলুতে ভিটামিন এ, বিনস এবং পার্ল মিলেটে আয়রন এবং ধান ও গমের জিঙ্কসমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবন করেছে। ফসলের জাতকে পুষ্টিসমৃদ্ধ করার এ কৌশলকে বলা হয় বায়োফর্টিফিকেশন। হার্ভেস্ট প্লাসের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রায় দেড় মিলিয়ন বা ১৫ লাখ কৃষক ইতিমধ্যে বায়োফর্টিফাইড বীজ দিয়ে ফসল চাষাবাদের সুযোগ পাচ্ছেন। এসব তথ্য পেয়েছি বছর দুয়েক আগে। ২০১৪ সালের মার্চে পূর্ব আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডায় গিয়েছিলাম দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বায়োফর্টিফিকেশন সম্মেলনে। ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন পৃথিবীর বড় বড় বিজ্ঞানী ও কৃষি বিশেষজ্ঞ। বিভিন্ন দেশের নীতিনির্ধারকও ছিলেন। বিশেষ করে ছিলেন আফ্রিকার দেশগুলোর কৃষি, খাদ্য ও স্বাস্থ্যবিষয়ক মন্ত্রীরা। সবুজ বিপ্লবের অন্যতম জনক ভারতীয় বিজ্ঞানী ড. স্বামী নাথান থেকে শুরু করে আমাদের দেশের বিশিষ্ট কৃষি বিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানী প্রয়াত ড. মাহবুব হোসেন পর্যন্ত উপস্থিত হন সেখানে। সেখান থেকেই পৃথিবীর মানুষের পুষ্টিহীনতার ভয়ানক চিত্র যেমন পাই, একইভাবে জানতে পাই বিভিন্ন ফসলে পুষ্টিযুক্ত করার বিষয়টি। রুয়ান্ডার বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরেছি। নাগাতারে ডিস্ট্রিক্ট, গাটসিবো সেক্টর এসব এলাকার প্রান্তিক কৃষকের জনপ্রিয় আয়রন বিন মুটিকি আবাদের উৎসাহ দেখে বেশ আশান্বিত হয়েছি। তারা এখন অন্যান্য বিনের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে পুষ্টিসমৃদ্ধ আয়রন বিনকেই বেশি গ্রহণ করছে। আফ্রিকার দেশগুলোয় অদৃশ্য ক্ষুধা দূরীকরণের কাজ শুরু হয়েছে বেশ জোরেশোরে। গত বছর গিয়েছিলাম পূর্ব আফ্রিকার আরেক দেশ উগান্ডায়। উদ্দেশ্য, সেখানকার মানুষের কৃষি, খাদ্য ও পুষ্টি উন্নয়নের চিত্রগুলো কাছ থেকে দেখা। সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংগঠন ব্র্যাক বেশ সাফল্যের সঙ্গে কমলা শাঁসযুক্ত মিষ্টি আলু, বায়োফর্টিফাইড আয়রন বিন এগুলোর চাষ সম্প্রসারণ করছে। একই সঙ্গে প্রসূতি মা ও শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের নিশ্চয়তায় নানাভাবে কাজ করছে। মনে পড়ছে উগান্ডার বৃহত্তর মাসাকো জেলার মুকোকো এলাকার কথা। সেখানে শতাধিক মা তার দুই বছরের নিচের বয়সী কোলের শিশু নিয়ে সমবেত হয়েছিলেন। সেখানে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ব্র্যাক ওই শিশুদের জন্য সবচেয়ে পুষ্টিকর খাবার হিসেবে দুধের সঙ্গে কমলা শাঁসযুক্ত মিষ্টি আলু বিতরণ করছে। মায়েরা ওই দুটি মিশিয়ে খাওয়াচ্ছেন। সেখানে কিছু দিন পরপর শিশুদের ওজন পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে, তারা পুষ্টি পাচ্ছে এবং ওজন বাড়ছে। সেখানকার কৃষক থেকে শুরু করে সাধারণ দরিদ্র পরিবারগুলো কৃষি উৎপাদনে তথা খাদ্য উপকরণে পুষ্টির হিসাব করতে শিখেছে। এর মধ্য দিয়ে আশা করা যায়, আগামী কয়েক বছরেই আফ্রিকার দেশগুলোয় পুষ্টি উন্নয়নে আশাব্যঞ্জক বার্তা পাওয়া যাবে।

 

 

পুষ্টির প্রশ্নে বাংলাদেশের চিত্র আফ্রিকার মতো অত করুণ নয়। তার পরও আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী পাঁচ বছরের নিচে বাংলাদেশের ৪০ ভাগ শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। এর পুরো অংশই জিঙ্কের ঘাটতি। বিশেষজ্ঞদের হিসাবে দেখা যায়, জিঙ্ক বা দস্তার ঘাটতির কারণে শুধু শিশু খর্বাকৃতিরই হয় না, তার সামগ্রিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়, ডায়রিয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়, একই সঙ্গে শ্বাসজনিত প্রদাহ দেখা দেয়। শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি, তার স্বাদ ও ঘট্টান গ্রহণ ক্ষমতাও গঠিত হয় জিঙ্কের সহায়তায়। অবশ্য, বলতেই হবে জিঙ্কের ঘাটতি পূরণ নিয়ে এখন স্বাস্থ্য খাত থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক পণ্য উৎপাদকরা পর্যন্ত ভাবছেন। এখন সারা দেশের দোকানে জিঙ্ক স্যালাইন বিক্রি হয়। বিষয়টি উপলব্ধি করে একই সঙ্গে আমাদের দেশেও প্রধান খাদ্যশস্য ধানকে পুষ্টিসমৃদ্ধ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশে ধানের জিঙ্কসমৃদ্ধ চারটি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে ব্রিধান-৬২, ৬৪, ৭২ ও ৭৪। এর মধ্যে ৬২ ও ৬৪ আমন এবং ৭২ ও ৭৪ বোরো মৌসুমের জন্য। এবার আমন মৌসুমে প্রচলিত জাতগুলোর চেয়ে প্রায় ২০ দিন আগেই কাটা হয়েছে ব্রিধান-৬২। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এবার আমন মৌসুমে দেশের ৫৮ জেলার ৩৫০ উপজেলায় কৃষক আবাদ করেছেন এ ধান। আমি গত অক্টোবরে ঠিক মাঠে যখন ব্রিধান-৬২ কাটা শুরু হয়েছে সে সময় গিয়েছিলাম মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম নাজিরাকোনায়। সেখানে স্থানীয় একটি কৃষক সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহায়তায় আন্তর্জাতিক সংগঠন হার্ভেস্ট প্লাস প্রায় তিন হাজার কৃষককে দিয়ে এই জাতের ধান আবাদ করিয়েছে। কৃষক অনেক আগেই ফলন ঘরে তুলতে পারায় বেশ আনন্দিত। একই সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি হলেও একটি নির্দিষ্ট অংশের ধান কেটে (প্রচলিত ক্রপ কাটিং নিয়ম অনুযায়ী) মেপে দেখা গেল ফলনও হেক্টরে ৬ টনের মতো; যা কৃষকের জন্য অনেক বেশি আশাজাগানিয়া। আমি দেখলাম, যেসব কৃষক এবার আমনে ব্রিধান-৬২ আবাদ করেছিলেন তারা তিনভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। প্রথমত ধানটি স্বল্পমেয়াদি। এ ধান আবাদ করলে বছরে অনায়াসেই চারটি ফসল আবাদ করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত ধানটি পুষ্টিসমৃদ্ধ। এ ধানের ভাত খেলে জিঙ্কের ঘাটতি পূরণ হবে। পুষ্টিহীনতা থেকে রক্ষা পাবে মা, শিশুসহ সব বয়সী মানুষ। তৃতীয়ত এ ধানের ফলন আমনের প্রচলিত জাতগুলোর চেয়ে কম নয় বরং বেশি। নাজিরাকোনা গ্রামে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ‘বীজ উৎপাদন’ নামে কৃষকদের একটি সংগঠন রয়েছে। তার সভাপতি কৃষক ইসলাম জোয়ার্দার। তিনি ধানটির ব্যাপারে বেশ আশাবাদী। বলছিলেন, কৃষক বেশ আগ্রহের সঙ্গে ধানটি নিয়েছে। এমনকি তারা বোরো মৌসুমেও এ জাতটিরই আবাদ করতে আগ্রহী। যদিও খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বোরো মৌসুমের জন্য ব্রিধান-৬২ ছাড় দেওয়া হয়নি। যা হোক, যারা এই জাতের ধান আবাদ করেছেন, তাদের বাইরের সাধারণ কৃষকের কাছে এখনো জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান বা বায়োফর্টিফিকেশন সম্পর্কে কোনো ধারণা আসেনি। আমরা ওই নাজিরাকোনা গ্রামেই স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করে দেখলাম তারা শিশুর পুষ্টিহীনতার প্রশ্নে খুব বেশি সচেতন নন, এমনকি নিজেদের পুষ্টিহীনতার কথাও চিন্তা করেন না। ধানকে পুষ্টিসমৃদ্ধ করার বিষয়টি তাদের কাছে পুরোপুরি অস্পষ্ট। তবে আগেই যে তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করেছি, সেগুলো তাদের কাছে পরিষ্কার হলে জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান আবাদে অনেক বেশি আকৃষ্ট হবেন। আজকের দিনে কৃষক ফসলবৈচিত্র্য ও শস্যের নিবিড়তার প্রতি বেশি মনোযোগী। একই সঙ্গে তাদের আগ্রহ কীভাবে উচ্চমূল্যের ফল-ফসল আবাদ করা যায়। কৃষককে যদি দুই মৌসুমে স্বল্পমেয়াদি ধান করার সুযোগ রাখার পরও আরও দুটি উচ্চমূল্যের ফসল আবাদের সুযোগ করে দেওয়া যায় তাতে তারা অনেক বেশি আগ্রহী হবেন। এতে ধান আবাদের প্রতি তাদের অনীহাও কমবে। সারা দেশেই উচ্চমূল্যের ফল-ফসল আবাদে কৃষকের এখন অধিক আগ্রহ ধান আবাদের তুলনায়। তাদের যুক্তি, ধানে লাভ কম, অন্য ফসলে লাভ বেশি। এ ক্ষেত্রে তাদের স্বল্পমেয়াদি ও পুষ্টিকর ধান ঘুরে দাঁড়াতে সহায়ক হতে পারে।

আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। আমি মুজিবনগর থেকে ব্রিধান-৬২ আবাদের চিত্র ও কৃষকের কথাবার্তা হৃদয়ে মাটি ও মানুষ, চ্যানেল আই সংবাদ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরার পর একজন কৃষক এ জাতটি সম্পর্কে ঘোর আপত্তির কথা জানিয়েছেন।

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার আবু বক্কর সিদ্দিক নামে এক কৃষি উদ্যোক্তা ফেসবুক মন্তব্যে লিখেছেন, ব্রিধান-৬২-এর যে চাল হয়, তা খেতে সুস্বাদু নয় এবং ভোক্তাদের কাছে এ চালের ভাত গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। তিনি বলতে চান, প্রচলিত জাতগুলোর তুলনায় এই জাতের চালের স্বাদ অনেক কম। ভাতের বৈশিষ্ট্যও আকর্ষণীয় নয়। রান্না করলে নরম হয়ে যায়। শিশুরা পর্যন্ত খেতে চায় না। তিনি অবশ্য পরামর্শ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, এই জাতটি উন্নয়নে আরও কাজ হওয়া প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে আমি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও আন্তর্জাতিক সংস্থা হার্ভেস্ট প্লাসের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আশা করি সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা বিষয়টি ভেবে দেখবেন।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর