শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
মতামত

জেলা পরিষদ স্থানীয় সরকারের কী কাজে আসবে?

মোশাররফ হোসেন মুসা

জেলা পরিষদ স্থানীয় সরকারের কী কাজে আসবে?

গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, জনগণের ক্ষমতায়ন কিংবা উন্নয়নকাজে জনগণের অংশগ্রহণ এসব কথা আমরা যেভাবেই বলি না কেন, কার্যকর স্থানীয় সরকার ছাড়া এগুলো বাস্তবায়ন করা মোটেই সম্ভবপর নয়। সেজন্য গণতন্ত্রমনা রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা সর্বাগ্রে প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা দেখতে চান। সরকার পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জেলা পরিষদের নির্বাচন ঘোষণা দেওয়ায় তাদের অনেকেই মহাখুশি। কেউ বলেছেন, ‘এটি মন্দের ভালো’। কেউ বলেছেন, ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’। কিন্তু নির্বাচন প্রক্রিয়া, বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা দেখে মনে হয় এ স্তরটি অনির্বাচিত প্রতিনিধির অধীনে থাকাই ভালো ছিল।

২৮ ডিসেম্বর দেশে প্রথমবারের মতো জেলা পরিষদের নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনে ভোটার সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা।

তারা ২১ জন প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। তাদের মধ্যে একজন চেয়ারম্যান (আগের নাম জেলা পরিষদ প্রশাসক), ১৫ জন সাধারণ ও ৫ জন সংরক্ষিত নারী সদস্য থাকবেন। মোট ২১ জন সদস্য মিলে জেলা পরিষদ গঠিত হবে। প্রার্থীদের অনেকেই জেলা কী, জেলা পরিষদ বলতে কী বোঝায়, জেলা পরিষদের কাজ কী, জেলা পরিষদের নিজস্ব আয় বলতে কী বোঝায় ইত্যাদি না জেনেই প্রার্থী হয়েছেন। অর্থাৎ তাদের লক্ষ্য একটাই— দলে ও সমাজে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য একটি পদ চাই। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বঞ্চিত নেতাদের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দিয়ে সান্ত্বনা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। কার্যকর স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারের সঠিক স্তরবিন্যাস না থাকায় প্রার্থীরা স্থানীয় উন্নয়ন চিন্তা মাথায় নেওয়ার সুযোগ পাননি। আবার যারা এতদিন জেলা পরিষদ প্রশাসক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তারাও একই মানসিকতা ধারণ করে সময় অতিবাহিত করেছেন। স্থানীয় সরকারে কাজ করার সুবাদে কয়েকজন জেলা পরিষদ প্রশাসকের সঙ্গে নিবন্ধকারের মতবিনিময়ের সুযোগ হয়েছিল। তাদের বড় অভিযোগ, ডিসিরা তাদের কথা শোনেন না। তারা স্থানীয় উন্নয়নের চেয়ে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব পাওয়ার ওপর জোর দিতে গিয়ে কোনোটাই পাননি। উল্লেখ্য, বিদ্যমান প্রশাসনিক ব্যবস্থায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জেলাকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হয়। সেজন্য সচিবালয়ের অধিকাংশ চিঠিপত্র জেলা প্রশাসককে উদ্দেশ করে ইস্যু হয়। ব্রিটিশ সরকার শুধু প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার স্বার্থে এ স্তরটি সৃষ্টি করলেও একসময় বেশকিছু কাজ করার ক্ষমতা প্রদান করে। স্থানীয় সরকার রূপকার প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীও জেলা বোর্ডের অধীন চাকরিতে যোগদান করে জীবন শুরু করেন এবং পরে এলজিইবি/এলজিইডি সৃষ্টি  করেন। সে সময় যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বেশকিছু কাজ জেলা বোর্ডের অধীন ছিল। পরে অনির্বাচিত সরকারগুলো তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির স্বার্থে এ কাজগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন করে। জেলা বোর্ডের রাস্তা ও ডাকবাংলোগুলো দেখভাল করা ছাড়া বর্তমান জেলা পরিষদের কোনো কাজ নেই। ২০১১ সালে ৬১টি জেলায় প্রশাসক নিয়োগ দিলেও অর্পিত কাজগুলো হস্তান্তর করা হয়নি। একইভাবে জেলা পরিষদের কাজ ও নিজস্ব আয়ের ব্যবস্থা না করেই নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে (যা অনেকটা উপজেলা পরিষদের মতো)। বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় এ পর্যন্ত ১৫ জন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। আবার ভোটার সীমিত হওয়ায় আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে ভোট কেনার প্রবণতাও শুরু হয়েছে। সেজন্য অনেকে এ নির্বাচনকে আইয়ুব খানের বিডি নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কাজেই নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা জেলা পরিষদ গঠিত হলেও এ স্তরটি কার্যকর হবে না, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আবার আগের মতো (জেলা বোর্ডের মতো) কিছু কাজ প্রদান করা হলেও বর্তমান সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকবে না। সে ক্ষেত্রে সিডিএলজির (সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক লোকাল গভর্ন্যান্স) বক্তব্য হলো, অব্যাহত নগরায়ণ ও পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে দুই প্রকারের সরকারব্যবস্থা তথা কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থাই সমাধান দিতে পারে। সেজন্য জেলাকে সর্বোচ্চ ইউনিট হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে।

সেই সঙ্গে প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটকে প্রজাতান্ত্রিক রূপ দিয়ে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। অর্থাৎ জেলা সরকার এক হাতে নগর সরকার (সিটি ও পৌরসভা) ও অন্য হাতে ইউনিয়ন সরকারগুলো তত্ত্বাবধান করবে। জেলা সরকার নিজস্ব আয়ে (প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতা নিয়ে) পরিচালিত হবে। তখন জেলা সরকারের নিজস্ব জনবল থাকবে। পদ্ধতিগত কারণেই জেলা সরকারের চেয়ারম্যান ও জেলা প্রশাসকের কাজ ও কক্ষপথ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়বে। একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকবে না।

লেখক : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক। 

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর