শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

কোরআন-হাদিসের আলোকে নারীর মোহর

মুফতি মুহিউদ্দিন কাসেম
পেশ ইমাম, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

ইসলামের যে বিধানগুলো স্বয়ং আল্লাহ বার বার বিভিন্ন আয়াতে তুলে ধরেছেন তার অপরিহার্যতা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষের অবহেলা ও অমনোযোগিতার কারণে সেসব বিধান সমাজের চোখে গুরুত্বহীন হয়ে গেলেও আল্লাহর কাছে তা গুরুত্বহীন নয়। ওইসব বিধানের অন্যতম হচ্ছে নারীর মোহর। কত প্রসঙ্গে কতভাবে যে আল্লাহ এ বিধানটি তুলে ধরেছেন। বিবাহবন্ধন, বিচ্ছেদ, ইমানদার ব্যক্তি ও সমাজের বৈশিষ্ট্য এবং জাহেলি সমাজের বর্বরতা রোধ— অনেকভাবে অনেক জায়গায় মোহরের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। তাই কোরআন মাজিদে যেমন আছে এর আইন ও বিধানগত দিক তেমন আছে নৈতিক ও মানবিক দিক, যা মুমিনের চিন্তা ও মস্তিষ্কের পাশাপাশি আলোড়িত করে তার কলব ও হৃদয়ও। এসব কিছুর সঙ্গে মুমিন নরনারীকে স্মরণ করানো হয়েছে আল্লাহর আদালত ও বিচার দিবসের অমোঘ সত্যের কথা। তাই একমাত্র কোরআনই পারে নারী-পুরুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে এবং সঠিক পথের দিশা দিতে যদি তারা সমর্পিত হয় কোরআনের বিধান ও শিক্ষার প্রতি।

মোহর ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ফরজ এবং বিয়ের অপরিহার্য বিষয়। মোহর ছাড়া বিয়ে হয় না। আকদের সময় উল্লেখ না করলেও কিংবা না দেওয়ার শর্ত করলেও মোহর বাতিল হয় না। স্বামীর কর্তব্য যথাযথভাবে মোহর পরিশোধ করা। বিয়ের পর সহবাস হলে (কিংবা একান্তে সাক্ষাৎ হলে, যাকে পরিভাষায় ‘খালওয়াতে সহিহা’ বলে), পূর্ণ মোহর আদায় করা অপরিহার্য। সুতরাং আকদের সময় মোহর ধার্য করা হলেও ধার্যকৃত পূর্ণ মোহর আর ধার্য না হয়ে থাকলে মোহরে মিসল দিতে হয়।

ধার্যকৃত মোহর থেকে স্ত্রী যেমন কিছু ছেড়ে দিতে পারে তেমন স্বামীও কিছু বেশি দিতে পারে। স্বেচ্ছায় সাগ্রহে হলে এতে কোনো দোষ নেই।

মোহর এমন কিছু হতে হবে, যা শরিয়তের দৃষ্টিতে ‘মাল’ (সম্পদ) বলে গণ্য। মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ কোরআন মাজিদে স্পষ্টভাবে বলা হয়নি। হাদিস আসার ও শরিয়তের অন্যান্য দলিলে তা বলা হয়েছে। ফিকহে হানাফি অনুসারে সর্বনিম্ন মোহর ১০ দিরহাম। এ শর্তগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা হাদিসে রয়েছে। (দেখুন : আহকামুল কোরআন, জাসসাস ২/১৪০/১৪৬; আহকামুল কোরআন, ইবনুল আরাবি ১/৩৮৪-৩৯০; তাফসিরে উসমানি পৃ. ১০৫)। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, মোহর যদিও একটি মধুর লেনদেন এবং সেভাবেই তা আদায় করা উচিত, তবে তা নিছক কোনো উপহার নয় যে, ইচ্ছা হলে দেওয়া যায়, ইচ্ছা হলে বিরত থাকা যায়; বরং তা হলো স্ত্রীর প্রাপ্য। স্ত্রী যেমন প্রীতি ও ভালোবাসার সঙ্গে নিজেকে সমর্পণ করেছে, স্বামীরও কর্তব্য সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে তার মোহর আদায় করা।

স্ত্রীর মোহর ফাঁকি দেওয়া অতি হীন কাজ। যে স্বামীর মনে স্ত্রীর মোহর আদায়ের ইচ্ছাটুকুও নেই হাদিসে তাকে বলা হয়েছে ‘ব্যভিচারী’। (দেখুন : মাজমাউজ জাওয়াইদ ৪/৫২২-৫২৩)।

অনেক বড় অঙ্কের মোহর ধার্য করা যেমন শরিয়তে কাম্য নয়, তেমন তা একেবারে তুচ্ছ ও সামান্য হওয়াও উচিত নয়। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ও সাহাবায়ে কিরামের সাধারণ রীতি এ ক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি হাদিস। আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান বলেন, আমি (উম্মুল মুমিনিন) আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী পরিমাণ মোহর দিয়েছেন? তিনি বললেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্ত্রীদের সাড়ে ১২ উকিয়া অর্থাৎ ৫০০ দিরহাম মোহর দিয়েছেন। (সহি মুসলিম ১৪২৬ : সুনানে আবু দাউদ ২১০৫ : সুনানে নাসায়ি ৬/১১৬, ১১৭)।

উম্মুল মুমিনিনদের মাঝে উম্মে হাবিবার (রা.) মোহর বেশি ছিল। তার মোহর ছিল ৪ হাজার দিরহাম। হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশি তাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন এবং মোহরও তিনিই পরিশোধ করেছিলেন। (সুনানে আবু দাউদ ২১০৭ : সুনানে নাসায়ি ৬/১১৯)।

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে আমাদের মোহর ছিল ১০ উকিয়া (৪০০ দিরহাম) (সুনানে নাসায়ি ৬/১১৭)।

মোহর সম্পূর্ণরূপে নারীর প্রাপ্য। তার স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি ছাড়া অন্য কারোর তাতে হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। সুতরাং স্বামী যেমন স্ত্রীকে মোহর থেকে বঞ্চিত করতে, কিংবা পরিশোধ করার পর ফেরত দিতে পারে না তেমন পিতা-মাতা, ভাই-বোন বা অন্য কেউ নিজ কন্যার, বোনের বা আত্মীয়ের মোহর স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি ছাড়া নিতে পারে না। মুমিনের কর্তব্য খুশিমনে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে স্ত্রীর মোহর আদায় করা। কারও অনুরোধ-উপরোধ বা জোর-জবরদস্তির অপেক্ষায় থাকা কোরআনি শিক্ষার পরিপন্থী ও অতি নিন্দনীয় প্রবণতা।

স্বামী যদি চাপ দিয়ে বা কৌশলে পূর্ণ মোহর বা কিছু অংশ মাফ করিয়ে নেয় তাহলে আল্লাহর বিচারে তা মাফ হবে না। (দেখুন : আহকামুল কোরআন, জাসসাস ২/৫৭-৫৮; তাফসিরে ইবনে কাসির ১/৪৪২; বয়ানুল কোরআন ২/৯৩; তাফসিরে উসমানি, পৃ.-১০০)।

উল্লেখ্য, উত্তম আচরণ করা কিংবা প্রাপ্য ছেড়ে দেওয়া সাধারণ অবস্থায় সওয়াবের কাজ হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে না-করাও উত্তম ও অগ্রগণ্য হতে পারে। যেমন কারও পাওনা ত্যাগের ইচ্ছা থাকলেও যদি অর্থের প্রয়োজন থাকে এবং পাওনা ত্যাগ করলে অসুবিধায় পড়ে যাওয়া ও সবর করতে না পারার আশঙ্কা থাকে সে ক্ষেত্রে পাওনা উসুল করাই সমীচীন। (দেখুন : আহকামুল কোরআন, জাসসাস ১/৪৩৩-৪৪২; বয়ানুল কোরআন ১/১৪০-১৪১)।

সর্বশেষ খবর