মঙ্গলবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

যে সত্য আমরা বুঝতে চাই না

দিলরুবা শারমিন

অসাধারণ একটি হিন্দি ছবি দেখলাম ‘পিংক’। তিনটি বয়োপ্রাপ্ত মেয়ে চাকরি করে, একটি ফ্ল্যাটে নিজেরা নিজেদের মতো জীবন কাটায়। কারও সঙ্গে পাছে নেই। মাঝে মাঝে ক্লাবে যায়। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারে। পান করে আবার ঘরে ফিরে আসে। এ থেকে তাদের বন্ধুদের মাঝে তিনজন ধারণা করে নেয় যে, এদের বিছানায় নিয়ে যাওয়া যায়। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে মেয়েগুলোকে যখন ছেলেগুলো নানা ছলে বিছানায় নেওয়ার চেষ্টা করে তখন মেয়ে তিনটি আত্মরক্ষার্থে ছেলেগুলোকে আহত করে। পরবর্তীতে ছেলে তিনটি মেয়ে তিনটির বিরুদ্ধে ‘হত্যা প্রচেষ্টা’সহ নানা ধারায় মামলা করে। আদালতে মামলা চলার সময় সরকার পক্ষের ‘অপ্রস্তুত আইনজীবী’ নানা অপকৌশল এবং নানা বাজে/আইনবহির্ভূত প্রশ্ন করে মেয়েগুলোকে পাজলড করে দেয়। আর মেয়ে তিনটির পক্ষের আইনজীবী? এই প্রথম দেখলাম, মামলার বাদী ও সাক্ষীদের কোনো জেরা করল না। পাল্টা যে কাজটি করল, সাফাই সাক্ষীতে মেয়ে তিনটিকে নানা প্রশ্নবাণে নাজেহাল করে ছাড়ল! তারা ‘কুমারী’ কিনা? কী করে কুমারিত্ব হারিয়েছে? কীভাবে? কুমারিত্ব স্বেচ্ছায় হারিয়েছে কিনা? কুমারিত্ব হারানোর সময় তারা তাদের ছেলে বন্ধুর কাছ থেকে টাকা নিয়েছে কিনা? ইত্যাদি ইত্যাদি। সঙ্গত কারণেই সব প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর দিতে হয়েছে তাদের। ফলে উত্তর যা বেরিয়ে এসেছে তা হলো, তারা যাই করেছে ইতিপূর্বে সবই স্বেচ্ছায়। জোর করে কেউ কিছু তাদের সঙ্গে করেনি বা টাকার বিনিময়েও তারা কিছুই করেনি। আমার বিশ্বাস, এ ছবি যারা দেখেছেন তারাও হয়রানবোধ করেছেন অভিযুক্ত পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীর এসব হয়রানিমূলক প্রশ্নের জন্য। এমনকি এরকম অতি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করায় মেয়ে তিনটিও হয়রানিবোধ করছিল। ডিফেন্স ল’ ইয়ার প্রশ্ন করলেন, তাহলে কেন তারা এই মামলার বাদীকে (ছেলেগুলো) এমনভাবে আহত করলেন? তখন মেয়েগুলো ভয়ে ভয়ে জানাল, তারা তাদের পরিচিত ও বন্ধু। তাই তারা তাদের সঙ্গে আড্ডায় যোগ দিয়েছে। সুরা পান করেছে। কিন্তু তারা চায়নি তাদের সঙ্গে মিলিত হতে! তাই তারা বলেছিল, ‘নো উই ডোন্ট ওয়ান্ট দ্যাট!’ যখন তারা মানেনি, জোর করেছে তখন তারা চিত্কার করেই বলেছিল নো! তারপর তারা আঘাত হেনেছে এই হায়নাদের কাছ থেকে বাঁচার জন্য।

যুক্তিতর্কের সময় সরকার পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী তো একেবারে দুনিয়ার যুক্তি উপস্থাপন করেন, চিত্কার, চেঁচামেচি করে অস্থির! যখন বিজ্ঞ আদালত ডিফেন্স ল’ ইয়ারকে আর্গুমেন্ট করতে বললেন তিনি তখন স্থির-অবিচল দৃঢ়কণ্ঠে শুধু বললেন— নো। সবাই বিস্মিত, হতভম্ব হয়ে পড়লেন! তাহলে কি তিনি যুক্তিতর্ক করবেন না? যেমন তিনি অভিযোগকারী বা সাক্ষীদের ক্রস এক্সাম মানে জেরা করেননি?! কিন্তু না, ডিফেন্স ল’ ইয়ার যুক্তিতর্ক শুরু করলেন— বললেন, ‘নো মিনস নো’। একজন মেয়ে বিয়ে না করতে পারে, একা থাকতে পারে, ভার্জিন না হতে পারে, ক্লাবে যেতে পারে— এসব কিছুই সে করতে পারে বা করেছে ‘স্বেচ্ছায়’। কিন্তু কেউ তার ওপর জোর করতে পারে না। সে যখন বলেছে না তার মানে হলো না। কারও ওপর জোর করা যাবে না। এটাই বেআইনি। একটি মেয়ের একা থাকা, চাকরি করা, তার নিজ ইচ্ছায় পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান, চলাচল, ব্যক্তি আচরণ যাই হোক সেসব হতে হবে, তার নিজের ইচ্ছায়। স্বেচ্ছায়। এসবের ওপর নির্ভর করে কেউ তাকে ‘জোর করে বিছানায় নিয়ে যেতে পারে না’। তারপর কী ঘটেছে সেটা যারা ছবিটি দেখেছেন তারা জানেন আর যারা দেখেননি তারা দেখতে পারেন। ‘জোর করে’ আর ‘স্বেচ্ছায়’— এ শব্দ দুটির মাঝে যে বিশাল পার্থক্য আছে এটা আমরা কি বুঝি? এই একটি পার্থক্য বোঝাই যে কোনো ক্ষেত্রে যথেষ্ট। যা আমরা অহরহ গুলিয়ে ফেলি। নারীর প্রতি নানাবিধ সহিংসতা নিয়ে আমরা নানা সংবাদ গণমাধ্যমে পাই। যত ধরনের সহিংসতার সংবাদই আমরা পাই না কেন তারপর আমরা একযোগে যত সমবেদনা জানানোর চেষ্টা করি না কেন শেষ অবধি কিন্তু আমরা তার বিপক্ষে মানে মেয়েটির বিপক্ষে একটা যুক্তি খুঁজে পাই বা খোঁজার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকি। মেয়েটির চালচলন ভালো ছিল না। পোশাক-আশাক উসকানিমূলক ছিল। রাত করে ঘরে ফিরত— ইত্যাদি ইত্যাদি। মানে যে কোনো ফর্মুলা অ্যাপ্লাই করে মেয়েটিকে দুশ্চরিত্র প্রমাণ করতে পারলেই যেন ‘ধরিত্রীতে মহাশান্তি নেমে আসবে এবং তার প্রতি যে সহিংসতা হয়েছে সেটা অন্তত হালালিফাই হয়ে গেল। তারপর সে খুন হোক বা জখম হোক বা ধর্ষণ হোক মোটামুটি তার গায়ে পচা গন্ধ মাখাতে পারলেই তার প্রতি সহিংসতা হালাল হয়ে গেল। মামলার রায় ধর্ষকের পক্ষে এসে গেল। অসংখ্য বুশরা আদৌ খুন হয়েছে কিনা এ নিয়েই আমাদের প্রশ্ন! বা এরা কেউ ধর্ষণ হয়েছে কিনা এটা আমাদের দেশের প্রথিতযশা আইনজীবী তার কূটচালে প্রশ্ন করেন। কেউ দেখেনি ধর্ষিত হতে। তাহলে আইনজীবীরা কী বলতে চান ‘ধর্ষক, পুলিশ ও আইনজীবী এবং বিচারককে সংবাদ দিয়ে তারপর ধর্ষণ ও খুন করবেন?’ ইদানীং কিছু কিছু শক্তিশালী বলিষ্ঠ কণ্ঠ আর সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে দু-চারটি ঘটনায় আমরা সবাই ‘এই রঙ লাগানো গপ্পো ও প্রশ্ন’ একটু চেপে যাচ্ছি। নইলে প্রায় প্রতিটি নারী নির্যাতন, হত্যা, খুন, জখম, ধর্ষণের পরপরই প্রশ্ন ওঠে তার চাল-চলন, চরিত্র, আচার-আচরণ, পোশাক-আশাক, কাজকর্ম নিয়ে। এমনকি অনেক দিন আগে আর্ট কলেজের মেয়ে সিমি কাজ শেষে যখন ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে তার বাসায় ফিরতে মাঝে মাঝে রাত হয়ে যেত একদল বখাটে ছেলে তাকে কুিসত কদাকার ইঙ্গিত করত। এ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সিমি যখন সুইসাইড করল (যদিও আমি তার এই সিদ্ধান্তের পক্ষপাতী নই) তখন নানাজনের নানামুখী ইঙ্গিতপূর্ণ সংবাদ পড়ে আমরা বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছি। তারপরও থামেনি আমাদের দেশের মানুষের এসব স্বভাব! এ এক অদ্ভুত দেশ। অস্বাভাবিক সমাজ ব্যবস্থা! যা ইচ্ছে গোপনে কর। কেউ কিছুই বলবে না তোমাকে। রেখে ঢেকে চলো, হিপোক্র্যাসি কর, ধর্মের নামে অধর্ম কর কেউ দেখবে না, কেউ কিছু বলবে না। যত সমস্যা যখন তুমি প্রকাশ্যে বলে দেবে ‘না’। ওহ, আমাকে না বলে দিল? আঘাত হেনেছে পুরুষত্বে! ব্যস আর যায় কোথায়? হয় এসিড মারো, নইলে ধর্ষণ কর বা কিছু করতে না পারলে খুন কর। তারপর বলে দাও, চরিত্রহীন। চালচলন ভালো ছিল না। ইঙ্গিতপূর্ণ পোশাক-আশাক পরত। এ বিষয় নিয়ে পুলিশ আর আইনজীবীরা যাই করুক সবই বলে-করে টাকার জন্য। কিন্তু বিজ্ঞ আদালত? তার সহজাত ক্ষমতা নেই কিছু করার? তাকে আমরা সম্বোধন করি ‘মাই লর্ড’ বলে।  সেই মাই লর্ড কী পারেন সেটাও এ ছবিতে বাস্তবসম্মতভাবেই দেখিয়েছে। আমরাও কি পারি না বিজ্ঞজনের মতো বা মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষের মতো আচরণ করতে?

আমি বিশ্বাস করি, যারা ছবিটি দেখেছেন তারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে এ ছবি থেকে নিজেকে ঝালাই করে নিতে পেরেছেন! ‘না’ মানে ‘না’, ‘না’ কথাটার আভিধানিক অর্থ যে ‘না’ এ কথা কি জনে জনে আবারও বুঝাতে হবে?

লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর