শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
স্মরণ

মুক্তিযুদ্ধের অগ্রসেনানী কমরেড মণি সিংহ

হাসান তারিক চৌধুরী

মুক্তিযুদ্ধের অগ্রসেনানী কমরেড মণি সিংহ

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অগ্রসেনানীদের মধ্যে কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মণি সিংহের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাঙালির জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এবং এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের সংগ্রামে অসামান্য অবদান ও দুঃসাহসিক সংগ্রাম তাকে এক জীবন্ত কিংবদন্তিতে পরিণত করেছিল। পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী এবং সেই সময়ের চীনপন্থি উগ্র বাম যারা কিনা পাকিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন এবং তাদের আন্তর্জাতিক মুরব্বি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। এদের সবার কাছে কমরেড মণি সিংহ ছিলেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। যে কারণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাকে বার বার হত্যা করতে চেয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাহিত্যিক সত্যেন সেন লিখেছেন, ‘১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পরে পূর্ণ গণতন্ত্র ও শোষণমুক্ত সমাজের আদর্শকে যারা সামনে এনেছেন মণি সিংহ তাদের একজন। বাংলার মেহনতি মানুষের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগঠক এই প্রিয় নেতাকে দমন করতে কায়েমি স্বার্থের রক্ষকেরা সবরকম চেষ্টাই করেছেন।’ তাই ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায় জনতার পক্ষে সংগ্রাম করতে গিয়ে বার বার কারা নির্যাতিত হয়েছেন এই মহান বিপ্লবী। পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে গ্রেফতার হওয়া পর্যন্ত তিনি কার্যত একটানা ২০ বছর আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হন। তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি ছিল। একই সঙ্গে আইয়ুব খানের সরকার তাকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে ১০ হাজার টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল। এই তো বিপ্লবী কমরেড মণি সিংহ।

কমরেড মণি সিংহ ছিলেন সেই নেতা যিনি সুবিধাবাদের কাছে কখনই মাথা নত করেননি। বাংলার কৃষকের স্বার্থে আন্দোলনের কারণে পাকিস্তানের প্রথম মুসলিম লীগ সরকার মণি সিংহের বাড়ি ভেঙে ভিটায় হালচাষ করায় এবং তার স্থাবর সম্পত্তি নিলাম করে দেয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে সেই বাড়ি ও সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এর জবাবে মণি সিংহ বলেছিলেন, ‘টঙ্ক আন্দোলন এবং বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে এবং তাদের বাড়িঘর উচ্ছেদ হয়েছে। যত দিন পর্যন্ত এই দেশের প্রতিটা মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা ও কর্মসংস্থান না হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত আমার বাড়ি-ভিটা ফিরিয়ে নেওয়ার প্রশ্নই উঠতে পারে না। যেদিন সবার ব্যবস্থা হবে সেদিন আমারও ব্যবস্থা হবে।’ তিনি ছিলেন আপাদমস্তক এক জনদরদি নেতা। নিজের এলাকায় টঙ্ক প্রথায় নিজেরই পরিবারের জমিদারদের শোষণের শিকার অসহায় কৃষকের পক্ষে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন। দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন কলকাতা শহরের নাগরিক রাজনীতির হাতছানি। সেটা সম্ভব হয়েছিল সর্বহারা শ্রেণির প্রতি তার অসাধারণ ভালোবাসা ও গভীর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। এ দৃষ্টিভঙ্গিই তাকে পর্যায়ক্রমে একজন মার্কসবাদী বিপ্লবীতে পরিণত করে। ’৭১ সালের ৭ এপ্রিল রাজশাহী জেল ভেঙে বন্দীরা তাকে মুক্ত করে আনে। এরপর তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের বহরমপুর হয়ে প্রথমে কলকাতা, পরে আগরতলায় গিয়ে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনী গঠন ও তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ আয়োজনের কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন। তার বিশেষ উদ্যোগের ফলে ’৭১ সালের ৩ মে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্যের আবেদন জানিয়ে একটি ঐতিহাসিক চিঠি বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশে পাঠানো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ’৭১ সালের ৯ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদিত হয়। যার ফলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মিত্রশক্তির সমর্থন এক ভিন্নমাত্রা লাভ করে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও রসদের সরবরাহ তখন আরও সমৃদ্ধ হয়। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বহুগুণে বেড়ে যায়। অন্যদিকে পাক হানাদার বাহিনীর মনোবল চরমভাবে ভেঙে যায়। বাংলার মুক্তিসেনারা রাশিয়ার একে-৪৭ রাইফেল নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে একে-৪৭ রাইফেলের মতো অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে পাওয়াটা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কতটা দরকারি এবং উদ্দীপনার ব্যাপার ছিল, তা সহজেই অনুধাবন করা যায়। কমরেড মণি সিংহ স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর পক্ষে ভারত সরকারের সমর্থন আদায় করেন। এই মহান বিপ্লবী ’৭১ সালে মুজিবনগর প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীতেও অন্তর্ভুক্ত হন।

৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬ মহান এই নেতার ২৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। সারা দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় এ দিনটি পালন করা হবে। বাংলাদেশের প্রগতিশীল মানুষ আবারও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে এই ক্ষণজন্মা বিপ্লবীকে। শুধু কি স্মরণ করার মধ্য দিয়েই তার প্রতি আমাদের ঋণ শোধ হবে? আমি মনে করি তিনি যে শোষণহীন, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে গেছেন, সেই সমাজ বিনির্মাণের মধ্য দিয়েই তার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন সম্ভব। কমরেড মণি সিংহের স্মৃতি অমর হোক।

লেখক : সম্পাদক, বিশ্ব গণতান্ত্রিক আইনজীবী পরিষদ।

            ই-মেইল :  [email protected]

সর্বশেষ খবর