রবিবার, ১ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

নাসিকে ফেয়ার ভোটে বিএনপির আনফেয়ার ফলের গল্প

কাজী সিরাজ

নাসিকে ফেয়ার ভোটে বিএনপির আনফেয়ার ফলের গল্প

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনটি কেমন হয়েছে এ প্রশ্নের জবাব নেতিবাচক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে যা লিখেছি পরের এ লেখায় মৌলিক বিষয়ে পার্থক্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। লিখেছিলাম, নির্বাচনটি শেষ পর্যন্ত অংশগ্রহণমূলক থাকবে এবং সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। সত্যিই ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নাসিক নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কারচুপি, সিল মারামারি, কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই এবং প্রতিপক্ষের এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়া বা বের করে দেওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি।  সব নারী-পুরুষ ভোটার নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে ভোটকেন্দ্রে যেতে পেরেছেন এবং ভোটও দিয়েছেন পছন্দের প্রার্থীকে।  আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। সেনাবাহিনী নিয়োগ ছাড়াই উৎসবমুখর পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে নির্বাচন। অথচ নির্বাচনের আগে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই মূল প্রতিদ্বন্দ্বীই শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। বিএনপি প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক রেখে ভোটারদের সব ভয়ভীতি ও শঙ্কা দূর করার জন্য সেনাবাহিনী নিয়োগের দাবি জানিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীও প্রথম দিকে একবার সেনাবাহিনী নিয়োগের দাবি করেছিলেন এবং অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানের সেনা নিয়োগের উপর্যুপরি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন, তাতে তারও কোনো আপত্তি নেই। তিনি আবার ‘তৃতীয় কোনো পক্ষের’ অপতত্পরতার শঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন। ‘তৃতীয় পক্ষ’ বলতে আমাদের দেশের রাজনৈতিক বিবেচনায় সাধারণত যে রাষ্ট্রীয় শক্তিটির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়, ডা. আইভী এ ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই তা মীন করেননি। আবার বিএনপিকেও বোঝাতে চাননি। কেননা, বিএনপি তো তার প্রতিদ্বন্দ্বী দ্বিতীয় পক্ষ— তৃতীয় পক্ষ নয়। নারায়ণগঞ্জবাসী তো বটেই, সারা দেশের রাজনীতিসচেতন মানুষও তার ওই ‘তৃতীয় শক্তি’ চিনতে পেরেছে। বলাই বাহুল্য, সে শক্তি আইভীর নিজের দলেরই একটি সবল-শক্তিশালী অংশ। পারিবারিক প্রভাব, সাংগঠনিক প্রভাব এবং ব্যক্তিগত প্রভাবে ‘ওই শক্তি’ নারায়ণগঞ্জে যে কোনো ঘটন-অঘটন ঘটাতে সক্ষম। একই দলের অন্তর্গত মানুষ, একই রাজনৈতিক পরিবারের হওয়ার পরও উভয়ের সম্পর্ক বৈরী, অনেকটা ‘সাপে-নেউলে’। এটা নারায়ণগঞ্জবাসী আলবত জানেনই, বাইরের লোকজনও কম-বেশি জানে। খোদ নির্বাচন কমিশনও নাসিক নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার মধ্যে ছিল। প্রথমে তো তারা বলেছিল, ১৭৪ কেন্দ্রের সবই ঝুঁকিপূর্ণ। নির্বাচনের আগের দিনও বলেছে, অন্তত ১৪৭ কেন্দ্র নিয়ে শঙ্কা আছে। খোদ নির্বাচন কমিশনই যদি এমন কথা বলে, জনমনে আতঙ্ক তো ছড়াতেই পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভোটের দিন দেখা গেল, প্রার্থী, নির্বাচন কমিশন সবাইর ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে শঙ্কাহীন এক আনন্দঘন পরিবেশে নাসিকের ভোটপর্ব শেষ হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে পাঁচটি সিটি নির্বাচন ছাড়া সব সিটি নির্বাচন, প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ উপজেলা নির্বাচন ছাড়া বাকি সব ধাপের উপজেলা নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের যে কুিসত চেহারা জাতি দেখেছে তা থেকে নাসিক নির্বাচন নিয়েও উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, শঙ্কা একেবারে অমূলক ছিল না। কোন জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় এমন বদলে গেল একটি নির্বাচনী পরিবেশ? নির্বাচন কমিশন বেশ লম্বা লম্বা কথা বলছে। কিন্তু এখানে মূল ভূমিকা ছিল সরকারের। দৃঢ়ভাবেই বলা যায়, নাসিক নির্বাচন সুষুম, শান্তিপূর্ণ, কারচুপিমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য হোক, সরকার তা চেয়েছিল বলেই তা আমাদের নির্বাচনী ইতিহাসে একটি মাইলস্টোনে পরিণত হয়েছে। প্রার্থী বাছাইয়ে সরকার নির্ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল। কেন্দ্রের পরামর্শ অনুযায়ী দলের তৃণমূল নেতারা নাসিক মেয়র পদে আনোয়ার হোসেনের নাম প্রস্তাব করেছিল। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র নেতা শামীম ওসমান এমপির উপস্থিতিতে মেয়র পদে আরও যে দুজনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল, ডাক্তার সেলিনা হায়াৎ আইভীর নাম তো দূরের কথা, গন্ধও ছিল না তাতে। প্রধানমন্ত্রী তখন দেশের বাইরে ছিলেন। তিনি ফিরে আসার পর দৃশ্যপট সম্পূর্ণ বদলে যায়। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে যান সদ্য-বিগত মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমানকে প্রায় লক্ষ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দেওয়া সিটিং মেয়র (নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরুর পর পদত্যাগ করেন) ডা. আইভী। তিনি গতবার লীগ সমর্থিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটযুদ্ধ করলেও তিনিও আওয়ামী পরিবারেরই লোক। তার পিতা প্রয়াত আলী আহমদ চুনকা নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের এককালের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা ছিলেন। নির্বাচিত প্রতিনিধিও ছিলেন। আওয়ামী ঘরানার বাইরেও নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষের মধ্যে তার একটা দিগন্তপ্লাবিত প্রভাব এখনো বিদ্যমান। সেটা আইভীর প্রাথমিক পুঁজি। দ্বিতীয়ত, নারায়ণগঞ্জের শিক্ষিত, ভদ্র ও সুশীল সমাজ, সংস্কৃতিসেবী এবং খেটে খাওয়া নারী-পুরুষের অকৃপণ ভালোবাসা ও সমর্থন তার আর এক শক্তি। ১৩ বছর সিটি নারায়ণগঞ্জের শাসক থেকেও সততার পরীক্ষায় ‘গোল্ডেন ফাইভ’ পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার শক্তিটা তো বর্তমানকালে অনেকটাই দুর্লভ। তিনি একজন নারী হয়েও এক প্রচণ্ড শক্তির বিরুদ্ধে হার না মানা লড়াই করে টিকে থেকেছেন, টিকে আছেন। এই অসীম সাহস তার নেতৃত্বগুণকে নিয়ে গেছে আরও অনেক উচ্চতায়। সব শক্তি আর গুণের মিশ্রণ তাকে করেছে মহিমান্বিত। কিন্তু তিনি কখনো উদৃ্লত, দুর্বিনীত হননি। তাকে প্রার্থী করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন এবং নিশ্চিত হয়েছেন যে, আইভীকে ভোটে হারানোর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নারায়ণগঞ্জে নেই। অর্থাৎ মনোনয়ন নিশ্চিত করেই তিনি বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গেছেন। নির্বাচনটি সুষ্ঠু, অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও কারচুপিমুক্ত করার সরকারি সিদ্ধান্তের পেছনে এটা অন্যতম একটা কারণ হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের কাছে নাসিক নির্বাচনে হারা ও জেতা দুটোই ছিল লাভের বিষয়। জেতার লাভ তো ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। হারার লাভটা এখানে যে, এমন একটি প্রশংসনীয় নির্বাচনে হেরে গেলেও প্রধানমন্ত্রী দেশে এবং বিদেশে এই আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতেন যে, তার সরকারের অধীনে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়, এটা সম্ভব। ভবিষ্যতের সব নির্বাচনও তিনি এমনই করবেন, এই বার্তা পৌঁছে যেত সর্বত্র। তিনি যা বলেন, তা মীন করেন, তাও প্রমাণিত হতো। সবারই মনে থাকার কথা যে, আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিল শেষে ছাত্রলীগ নেতারা তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বলেছিলেন, আগামী নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ হোক তা তিনি চান না। সে বক্তব্যের পর সারা দেশের এমনকি বিদেশের অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণকারী অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনটি প্রথম হলো নারায়ণগঞ্জ সিটিতে। এ নির্বাচনটি যদি শেষ পর্যন্ত অংশগ্রহণমূলক ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য না হতো, তা হলে তার কথার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকত না এবং ভবিষ্যতের জন্যও তিনি মানুষের আস্থা হারাতেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি যে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল সে ব্যাপারে সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টার ও দলীয় নেতারা যা-ই বলুন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সে ব্যাপারে বিলম্বে হলেও পরোক্ষ স্বীকারোক্তি আছে। ওই নির্বাচনের পর পৃথিবীর বহু দেশ সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী। একটি ইনক্লুসিভ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মূল্য ও গুরুত্ব হয়তো তিনি বেশি করে উপলব্ধি করছেন এসব সফরে। একটি সু-নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ এবং সেই সংসদ নেত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও সদস্যদের মর্যাদা যে অনেক উচ্চতায় স্থাপিত হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তেমন একটি অবিতর্কিত সংসদ গঠন, তেমন একটি সংসদের নেত্রী হওয়ার আগ্রহ একটি দ্রুত বা আগাম নির্বাচনের চিন্তাও তার মাথায় ঢোকাতে পারে।

 

 

নাসিক নির্বাচনের সপ্তাহখানেক আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া একটি লিখিত বিবৃতি দিয়েছিলেন। খুবই পজিটিভ ও সুলিখিত ছিল বিবৃতিটি। তাতে এই আশাবাদ জেগেছিল যে, নির্বাচনটিকে বিএনপিও অর্থবহ করতে চায়। এর পেছনে আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বার্তাই দিয়েছেন তিনি। বলতে হবে, নাসিক নির্বাচনকে অর্থবহ করার ক্ষেত্রে তার বিবৃতি যথেষ্ট অবদান রেখেছে। পুরনো, পরিচিত, চাঁদাবাজ, তোলাবাজ, দুর্নীতিবাজ হিসেবে জনগণের কাছে চিহ্নিত কাউকে প্রার্থী না করে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে প্রায়-অনুল্লেখযোগ্য, কিন্তু সৎ, চরিত্রবান, আদর্শবাদী ও সাহসী একজন পুরুষকে প্রার্থী করেছিল বিএনপি। সাত খুন মামলায় বাদীপক্ষের আইনজীবী হয়ে লড়াই করা চাট্টিখানি কথা নয়। বিএনপির স্থানীয় নেতারা তাকে সহযোগিতা করেননি। ফটোসেশনে ছিলেন ওয়ার্কিং সেশনে ছিলেন না। এক নেতার ভাই যত ভোট পেয়ে তার ওয়ার্ডে কমিশনার হয়েছেন, সেই ওয়ার্ডে মেয়র প্রার্থী পেয়েছেন তার অর্ধেক ভোট। আরও দুই ওয়ার্ডে দুই নেতার ছেলে যত ভোট পেয়ে স্ব স্ব ওয়ার্ডে কমিশনার নির্বাচিত হয়েছেন দলের মেয়র প্রার্থী ভোট পেয়েছেন সে তুলনায় অনেক কম। নেতারা তাদের ভাই ও ছেলের জন্য কাজ করেছেন, মেয়র প্রার্থীর জন্য কাজ করেননি। করলেও জিততেন না, তাতে ভোটের ব্যবধান কিছুটা কমত। তারপরও ৯৬ হাজার— প্রায় ১ লাখ ভোট পাওয়া বিএনপির অর্জনই বলতে হবে। ২৭ ওয়ার্ডের কমিশনারদের মধ্যে আওয়ামী লীগ যেখানে পেয়েছে ১৩ জন, সেখানে বিএনপির কমিশনার জিতেছেন ১২ জন। মহিলা কমিশনার ৩ জন। বিএনপি খারাপ করল কোথায়? নির্বাচনের শুরু থেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিএনপির মেয়র প্রার্থী স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘ভোট শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হয়েছে’। এই নির্বাচনে ১৭৪ কেন্দ্রের সব কটিতে বিএনপির এজেন্ট ছিল। ভোট গণনা শেষ হওয়া পর্যন্ত তারা কেন্দ্রে ছিলেন। ভয়ভীতি প্রদর্শন, কাউকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া বা কেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়ার অভিযোগ প্রার্থীও করেননি। ফলাফল ঘোষণার পর ধারণা করা হয়েছিল এমন একটি সুন্দর নির্বাচনের ফলাফল খোলামনে মেনে নিয়ে বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানাবেন বিএনপি প্রার্থী। কিন্তু তা হলো না। ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলো। বলা হলো গণনায় ত্রুটি আছে। কেন্দ্র থেকে দুই-তিনজন দুই-তিন রকম কথা বললেন। গয়েশ্বর বাবু বললেন, নির্বাচন ফেয়ার, ফল আনফেয়ার। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যথার্থই বলেছেন যে, নির্বাচনে তাদের আংশিক বিজয় হয়েছে। সত্যিই তো, গর্ত থেকে নেতা-কর্মীরা সারা শহর দাবড়ে বেড়াতে পেরেছে নির্ভয়ে, সাহস সঞ্চার হয়েছে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের বুকে, সংগঠন মৃত্যুশয্যা থেকে আবার উঠে বসেছে। এক লাখ ভোট পেয়েছে বিএনপি। বোঝাই যায়, এই ভোট তাদের ‘কোর’ ভোট। ধানের শীষের অন্ধ ভোট। যারা বলে বিএনপি নেই, দলটি শেষ হয়ে গেছে, তাদের উদ্দেশ্যে নাসিক নির্বাচন এই বার্তাই ঘোষণা করেছে যে, বিএনপি এখনো দেশের অন্যতম প্রধান দল। আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশের অন্য সব দল মিলে (সরকারের পার্টনার দলসমূহসহ) নাসিক নির্বাচনে যদি একজন প্রার্থী দিত, সে প্রার্থী কি বিএনপির প্রাপ্ত ভোটের এক-চতুর্থাংশ ভোটও পেত? আওয়ামী লীগের যেসব দলদাস বিএনপি শেষ হয়ে গেছে বলে মিডিয়ায় গলা ফাটান, সেসব অ্যাংকরও উপহাস করেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন তাদের জন্যও একটি শিক্ষা। নির্বাচনে অংশ নিয়ে এসব তো বর্জন করেছে বিএনপি। নির্বাচনী ফলাফল গ্রহণ না করে হীনমন্যতার পরিচয়ই দিলেন বিএনপির কোনো কোনো ‘প্রকাণ্ড নেতা’। তাদের উচিত নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করে, ভুল-ত্রুটি বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ জাতীয় নির্বাচনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা। পরাজয় স্বীকার না করার কুসংস্কৃতির বৃত্তটা ভাঙা দরকার। এখনো সময় আছে। অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানের নির্বাচনী টিম বিজয়ী মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে একটা সংবর্ধনা দেওয়ার আয়োজন করতে পারে। ভবিষ্যতের জন্য এটা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

এবার ভিন্ন একটি প্রসঙ্গ। গত ২৮ ডিসেম্বর বিএনপির অন্যতম অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের উদ্যোগে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। প্রধান অতিথি থাকার কথা ছিল পার্টি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার বিজয় দিবসের ওই অনুষ্ঠানে আসায় অনীহার কারণে তা হয়নি, বাতিল হয়ে গেছে। ২৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠানটির কর্মসূচি সংগঠকরা বাতিল করায় অনেকে তা জানতে পারেননি। বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা এসে গিয়েছিলেন ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনের সামনে। জানা গেছে, প্রায় দেড় মাস আগে প্রোগ্রামটি সেট করা হয় এবং যথারীতি পার্টি চেয়ারপারসনের সম্মতি নিয়ে তাকে প্রধান অতিথি করে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়। পোস্টার ছাপা হয়, কার্ড বিলি করা হয়। সংগঠকদের সূত্রে জানা যায়, ঠিক তিন দিন আগে ম্যাডাম জানিয়ে দেন ওই প্রোগ্রামে তিনি যাবেন না। তিনি নাকি পারিবারিক কোনো প্রোগ্রামের কথা বলেছেন। সংগঠকরা তাকে এক ঘণ্টার জন্য আসতে বলেছিলেন, তাতেও নাকি তিনি রাজি হননি। এতে দারুণ বেকায়দায় পড়ে যান উদ্যোক্তারা। সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে অসন্তোষ। বাধ্য হয়ে তারা কর্মসূচিটি বাতিল করেন। ইতিমধ্যে তাদের হল ভাড়া, পোস্টার, কার্ড ছাপানো ৬০০ ক্যাপ তৈরি এবং অন্যান্য খাতে প্রায় ৩ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। ২৭ তারিখ রাতে এবং ২৮ তারিখ দুপুরের মধ্যে ঢাকার বাইরের সাতটি জেলা থেকে মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধিরা ঢাকায় পৌঁছে যান। নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত হন সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা। জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল বিএনপির একটি অ্যাকটিভ সংগঠন। দলীয় ও জাতীয় সব দিবস ও কর্মসূচিতেই তাদের সক্রিয় দেখা যায়। প্রতি বছর তারা বিজয় দিবস উপলক্ষে এমন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এবং ম্যাডাম তাতে প্রধান অতিথি থাকেন। এবারও তারা তিনটি প্রোগ্রাম ইতিমধ্যে করেছে। কয়দিন আগে নাসিক নির্বাচনেও তাদের অ্যাকটিভ দেখা গেছে। জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার পর দলটির ‘রাজাকারের দল’ দুর্নাম ঘুচানোর জন্য মুক্তিযোদ্ধা দল নিরলস কাজ করছে। বিএনপির শুভানুধ্যায়ীদের মতে, দুর্নাম ঘুচানোর জন্য মূল দলেরই উচিত মুক্তিযোদ্ধা দলকে কাজে লাগানো। এর সভাপতি উলফাৎ ও সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান দুজনই ‘ভ্যাটার্ন’ মুক্তিযোদ্ধা। সবমহলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে। এখন তারা বিপাকে পড়েছেন। কেউ কেউ এমনও বলছেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের হটিয়ে আবার অমুক্তিযোদ্ধা কারও কাছে মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্ব আগাম বিক্রি হয়ে থাকতে পারে। তাই কেউ ম্যাডামের কান ভারি করে কাজটি করেছে, যাতে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যার ছুঁতা ধরে কমিটি ভেঙে দেওয়া যায়। যাকে তাকে যখন তখন বের করে দেওয়া, অন্যায় হুকুম তামিল না করলে বা দুর্বৃত্ত ও দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির বিরোধিতা করলে দরকারি লোককেও ‘বেইমান’ বলে আখ্যায়িত করা বিএনপির একটা নিয়মিত প্র্যাকটিসে পরিণত হয়েছে এমন অভিযোগ এখন জোরালো।  মুক্তিযোদ্ধা দলের বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা নেতৃত্ব এবং মহান বিজয় দিবসের কর্মসূচির ব্যাপারে পার্টি চেয়ারপারসনের সিদ্ধান্ত নিয়ে আওয়ামী লীগ ও অন্যরা এখন প্রশ্ন তুলতে পারে যে, রাজাকার ও রাজাকার পরিবারকে সন্তুষ্ট করার জন্যই বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা দলের কর্মসূচিতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি?  কী জবাব আছে? কাজটা কি ভালো হলো?

     লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর